কবিতা


বিষাদসিন্ধু

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়


দহনের বিষাদ ঢালে, ঢালে বিষ বাষ্পের ফেনা
এই চোখ, এই মূর্তি, ঊষাকালে আমার অচেনা
কিম্ভুত সময় যেন, চারপাশে দেখি তার ছায়া
লোল জিহ্বা মেলে ধরে, সর্বগ্রাসী ভ্রান্তিময় মায়া...

কোথায় আলোর চিহ্ন, কোথা মুক্তি, শব্দময় প্রেম
আমার হারিয়ে ফেলা সব স্মৃতি, তোমায় দিলেম
রেখে দাও চক্ষুধারে, রাখো শিরে, আধেক কপালে
এমন ছিন্ন মালা কেন যে তুমি, আমাই পরালে?

হে দেবী, বিষাদসিন্ধু, এইভাবে ডাকো নাকো আর
পালাবার পথ দাও, ডেকো নাকো অন্তরে আবার
সন্মুখে অনেক যুদ্ধ, বহু পথ পেরোনোর ডাক
ভেঙে দিয়ে মনোরথ, আর তুমি, করো না অবাক...

তা হলেই বৃষ্টিজন্ম, ঢেকে যাবে, শরীরী শ্মশান
এ জীবনে সবকিছু ধুলায় ধূসর, হবে ম্লান...



ওই নিভে আসে, আন্দালুসিয়া

পিয়াস মজিদ


দীর্ণ দিনশেষে আমার আকাশে ‘রাত্রি’ নামের স্যানাটোরিয়াম নামে।
রোগা রূপে ভরে গেছে মানুষ আর গরু-পৃথিবীর হাট।
পাষাণ এই পুষ্পের নিকুঞ্জে খোঁজ করা বৃথা দরদি দরিয়া।
আত্মায় মরুর মহল তুলে আমাকে কী করে দেবে আকুল চুমুর চাঁদ!
খেয়ে-দেয়ে, মলিন মিথুনে জীবন টু মরণ মিশন।
প্রাত্যহিক মধুর বাত্যায় যোগ না হই আমি,
আমার জিপসি-শ্বাসে এখনও বিধুর বাঁচে, দূরের কমলাঝোঁপে।
আমাদের ইতিহাস মূলত আয়নার আখ্যান, আত্মদর্শনের আখড়ায়
দেখে আসি আমার প্রতিদিনের মরে বাঁচার কবরটা কোথায়!
খাঁ খাঁ মালঞ্চ উদ্ভিদ শূন্য পুষ্প ফল মানে থোকা থোকা ফ্র্যাঙ্কো,
কবির জন্য থাকে বাকি বুলেটের বীথি।
ফসলী সুবাস না পাও পাও তো দালি, আমার ক্ষুধার গন্ধ, আজও?
প্রতিটি গিটারে গান নয়, পাবে- গ্রানাদার সুর,
আলোর উৎসবে আছে আমার রক্তবিবাহের ভূত।
কবির মড়া মাড়িয়ে গেলে বহুদূরে দুয়েন্দে মেলে।
আমার বেদূইন-বন্দর লাওয়ারিশ আত্মার আতর-
সব ভরে নাও পিপে আর পিয়ানোতে,
তবু যথাযোগ্য পাপের মূল্য দিতে ব্যর্থ পৃথিবী, পবিত্ররিক্ত।
ওরা পায়নি আমাকে ও সীমিত স্বপ্ন ও স্থির গন্তব্য
আমি তো গুম হই একমাত্র আমার নাইটমেয়ারের স্রোতে;
বুনুয়েল  তাকে অনায়াসে ডাকতে পারে ‘আন্দালুসিয়ান কুকুর’ বলে।
খরাদীপ্ত আমি তো বয়ে বেড়াতে চাই সভ্যতার অনিবার্য উজান- ঘেউ ঘেউ ঘেউ।
ঝড় নও, যা দ্যাখছো তা তো আমারই প্রদাহের পবন।
দুনিয়া একটা ঠুঁটো স্বর্গের স্বপ্ন বড়জোর মাপা মাতালের মচ্ছব।
মাটির সুর থেকে অসুরের আবাসন- আমার চলার কোনো মাঝামাঝি পথ নেই।
মৃত্যুর মানে করেছি বুভুক্ষ নৃত্যের জীবনী।
আ কবিতা, জানো তুমি!
এক একটি শব্দের পেছনে এক লক্ষ ফ্যাসিস্ত ওঁৎ পেতে থাকে,
তুমি তাকে এড়িয়ে যাবে কোন দুর্জ্ঞেয় বিক্রমে?
বাতাসের ব্যালকনি আমার দিকে তাক করো না উদ্ধারের সিঁড়ি
কুয়াশার ক্যারাভান থেকে অন্ধকার অলঙ্কার-মোড়ে যেতে যেতে অবশেষে
লিলির লেফাফা শ্বেত ক্যামেলিয়া আর অমিয় আঙুরে,
বুলবুলি বিষের বায়োডাটা জানে; ঘোড়সওয়ার দুরন্ত ওই তো হ্রেষার সীমান্ত।
আমার এতটুকু বুকে কী করে ধরি কর্ডোভার দীঘল ধূলি।
যতই ওড়াও অভিরূপ কেতন অভিধান  প্রতিদিন প্রাক্তন।
প্রেম মানে প্রতারক ধ্বনি সঙ্গী মানে যথার্থ অবিশ্বাসী।
পারদ যতটা ভারী তরলিত দালির ঘড়ি জীবন যতই সচল ব্যাটারি ততই ফুরনো দম
ষাঁড় কিংবা কিন্নর।
হেরে যাওয়াই জরুরি কথা বুলফাইটের জিন্দেগেতি।
জিতে ফেরা প্রতিটি জোচ্চরের মুখে আমাকে টেনেহিঁচড়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার
ধূসর দাগ লেগে আছে, আর্তিই আসলে উল্লাস-রঙিন।
আমি গাছ কাঠুরিয়া, কাটো আমাকে।
এখানেই পাবে প্রার্থিত সবুজ রক্ত, প্রতিটি কবিতা
কবি, তোমার বেহিসেবি মৃত্যুর রোজনামচা।
অভিশপ্ত সূর্যের শোভাযাত্রায় পদাতিক নক্ষত্র হয়ে
এই উদয়ের তামাশায় কবি নিরুপম নিভে আসে
পৃথিবী-ক্ষণিকার অনন্ত আন্দালুসিয়ায়।

(লোরকার জন্মদিনে লেখা)

Post a Comment

0 Comments