অন্য বর্ষা, অন্য যক্ষ


লকডাউনের দিনলিপি

অন্য বর্ষা, অন্য যক্ষ 

সঞ্চালিকা আচার্য 


তু নাম পাল্টে বর্ষা হয়ে এল। বর্ষা মানেই স্যাঁতস্যাঁতে দিন এবং রশিদ খাঁ-এর গলায় মেঘমল্লারের আশ্চর্য কন্ট্রাস্ট। বর্ষা মানে মন হারিয়ে পথ ভুলে যাওয়ার দিন, বৃষ্টির জল গোঁড়ালি ছুঁলে কদমরেণুর মতো মোহমগ্ন ভেসে যাওয়ার দিন। কামাতুর দাদুরীর আহ্বান শুনতে শুনতে রাধাহৃদির পিছলে যাওয়ার রাত। দামিনী দমকে প্রিয় বুকে মুখ গুঁজে বৃষ্টিফোঁটার মধুর ছন্দমহিমায় ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার রাত। এবারে যদিও তেমন বর্ষা নয়, বেশ অন্যরকম। এই বর্ষায় শিশুদের ভোকাবুলারিতেও ঢুকে গ্যাছে একটা নতুন শব্দ ‘লকডাউন’, যখন বাড়ির বাইরে বের হওয়া বারণ। তাই রেইনকোট চাপিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে জমা জলের ওপর লাফানো বন্ধ। কদমফুল নিয়ে পিংপং বল খেলার দিন নয় অদ্য। এই বর্ষা নিজস্ব বাতায়নে একাকী দাঁড়ানোর, প্রতিবেশীর দিকে দূরত্বের হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার, কর্মক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক থাকতে ঘাড় গুঁজে কাজ করে যাওয়ার, আর দু’তলার ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসা তীক্ষ্ণ চিৎকার উপেক্ষা করার।
পাঁচ মাস হতে চলল করোনাভাইরাস বিপর্যয়ের, সঙ্গে জোনাথনের বন্দিদশার আয়ুষ্কালও। একুশ বছরের জোনাথন আমার প্রতিবেশী— দু’হাতে রং মাখতে ভালোবাসে, অকারণে হা হা করে হেসে ওঠে, মনে রাখতে পারে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মদিন। নিজের ডাকনাম রেখেছে নিজেই, কিলিমাঞ্জারো। পাখির ডাক নকল করতে আর ঘুরতে খুব ভালোবাসে। ওর বাকেট লিস্টে দেখেছি লিখেছে, কলোসিয়ামের ভেতরে দাঁড়িয়ে একদিন চিৎকার করে গাইবে লিনকিন পার্ক— ‘I'm tired of being what you want me to be’, পাশে একটা ধাঁধার পেপারকাট। সেকেন্ডারি স্কুলের পর প্রথাগত পড়াশুনো বন্ধ করে দেওয়া ছেলেটার ঘরে দেখেছি গুচ্ছের বই ছড়ানো, হাইডেগার থেকে চমস্কি, হলুদ কমলা সবুজ মার্কারে হাইলাইট করা সব লাইন। মার্জিনে হিজিবিজি নোট, হাতের লেখা উদ্ধার করা দুঃসাধ্য। সিনেমাখোরও নাকি। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে কোনওদিন জড়িয়ে ধরে, তো কোনওদিন চিনতেও পারে না। এইটুকু আমরা জানি জোনাথনের সম্পর্কে, এর বেশি কিছু কেউ জানে না।
জোনাথনের বাবা-মা স্কিৎজোফ্রেনিক সন্তানের মানসকাঠামো বুঝতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফ্যালে। কর্পোরেটে উচ্চপদস্থ দুজনেই; কাচ, স্ফটিক ও টেরাকোটার বিলাস জোনাথনের বিস্ময়কর হৃদয় ও মননসম্পদ থেকে তাঁদের আলাদা ক’রে একটা দেওয়াল তুলে রেখেছে। তাঁদের সেরামিক এলিগ্যান্স জোনাথনের মন-স্লেটে আঁকা ম্যুরালের অর্থ বোঝে না। সেই খামতি ঢাকতে তাঁরাও ব্যস্ত রেখেছেন নিজেদের অন্যত্র। জোনাথন ফলত একা, বেশিরভাগ সময়টাই কাটে তার গৃহসেবিকার সঙ্গে। এহেন জোনাথনের ভাল থাকার দিনগুলোতে সকাল বিকেল এক ঘন্টা করে হাঁটা বহু বছরের অভ্যেস ছিল। করোনাভাইরাস আতঙ্কে সেই ফেব্রুয়ারি থেকে ওর বাইরে বের হওয়া বন্ধ।


মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে ওর আছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মত আরও এক গুচ্ছ গয়না, তাই সংক্রমণের ভয়ে প্রথম থেকেই বেরোতে দেওয়া হয়নি ওকে। সমস্যা হল স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা এই ধরণের মানসিক ব্যাধিতে ভোগা ব্যক্তিরা তাঁদের পারিপার্শ্বিকে রুটিন-সর্বস্ব জীবন পছন্দ করেন। তার মধ্যে নিরাপত্তা পান, ওটাই তাঁদের সেফটি-নেট। সেই রুটিনের কোনওরকম অন্যথা হলে তাঁরা গভীর আশঙ্কা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আশেপাশের কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না, ভাবতে থাকেন সবাই তাঁর কোনও ক্ষতি করতে চায়। এর ফলে সাইকোটিক এপিসোড বা বিভ্রান্তিমূলক আচরণের পুনরাবৃত্তির হার বেড়ে যায়। বাস্তব ও কল্পনার গণ্ডি ঝাপসা হতে থাকে আরো। বাইরে থেকে আমরা দেখতে পাই তাঁদের প্রচণ্ড জেদ, রাগ, খেতে না চাওয়া, চিৎকার চেঁচামেচি, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা ইত্যাদি। জোনাথনও তার ব্যতিক্রম নয়। এতগুলো দিন বাইরে হাঁটতে যেতে না পারার জন্য, প্রিয় গাছ ফুল পাখি না দেখতে পেয়ে ওর মধ্যে উক্ত লক্ষণগুলো আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। তাঁর ওপর অত্যন্ত প্রয়োজনে বাড়ির কেউ বাইরে বেরোলে তাঁকে তীব্র সন্দেহের চোখে দেখা তো আছেই। নিয়মিত যে ওষুধগুলো ও খায়, তার ডোজ বাড়িয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। প্রচণ্ড চিৎকার, কান্না, আর ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ শুনতে পাই মধ্যে মধ্যেই। শেষমেশ ইনজেকশন ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলে সব কোলাহল থেমে যায়। তারপর একে একে নিভে যায় প্রতিবেশী জানালার আলো। কোনও কোনও দিন রাতচরা পাখি ডাকে। এ’পাড়ার বাতাসে ঝুলতে থাকে বিষণ্ণ অন্ধকার।     
তাই এই বর্ষা অসহ্য গুমোটের। এই বর্ষা অথিরবিজুরি রাতে বৃষ্টির ঝমঝম পেরিয়ে আসা একটি একুশ বছরের ছেলের আকুল চিৎকার শুনতে শুনতে জানলা বন্ধ করে দেওয়ার, চিরনির্বাসিত বিরহতপ্ত চেতন-অচেতনের ফারাক ভোলা জোনাথনদের ভালবাসতে বাসতে হেডফোন গুঁজে মেঘদূতের মন্দাক্রান্তায় মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করার। 


Post a Comment

0 Comments