বইপাড়া : নজরুলের ভাষা বিপ্লব

নজরুলের ভাষা বিপ্লব নিয়ে কিছুই বলা হয় না 

বই-বাহিকের কড়চা/ ২

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় 


বৈশাখ যদি হয় রবীন্দ্রমাস তাহলে জ্যৈষ্ঠ নজরুলের। কিন্তু পশ্চিম বাংলার ক’জন মানুষই বা জানেন এগারোই জ্যৈষ্ঠ কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিন? না, এরমধ্যে হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার-ট্যাপার কিছু নেই। এ স্রেফ রবীন্দ্রসূর্যে আড়াল হয়ে যাওয়া তারাদের ট্র্যাজেডি। তেরই আষাঢ় যে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিন তারই বা খোঁজ রাখেন ক’জন? রবীন্দ্রনাথ এত ‘ইনডিভিচুয়াল’ হয়েও কী করে ‘পাবলিক’ হলেন, আর ‘পাবলিক-খ্যাত’ হয়েও কী করে অন্য অনেক সাহিত্যিকের জন্মদিনগুলো আড়াল হল তা নিয়ে একখানা চমৎকার সাহিত্য-জনমনস্তাত্ত্বিক থিসিস নামিয়ে দেওয়া যায়! আপাতত নজরুলের গুলবাগিচায় ফিরে আসা যাক।
ইউনিভার্সিটিগুলোর বাংলা বাজারে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে হাজার পাঁচেক গান এবং অসংখ্য প্রেমের কবিতা লিখলেও নজরুল আসলে ‘বিদ্রোহী’ কবি! যুগের হুজুগ কেটে যাওয়ার পর তাঁর কাছ থেকে চিরকেলে কোনও বাণী প্রত্যাশা করা— সুতরাং বাতুলতা। বড়জোর শ্রাবণ-শেষে পনেরোই আগস্ট নজরুলের জুতসই দুয়েকটা গা-গরম করা কবিতা সভা-সমিতিতে আওড়ানো যেতেই পারে! ব্যস্‌, ঐটুকুই। আমজনতারও নজরুল-সিলেবাস ওইখানেই খতম! বই-বাহিক এবার স্থির করেছিলেন নজরুলের রচনাবলী আগাগোড়া পড়ে দেখবেন। এর আগে ঢাকার ‘অবসর’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ নজরুল’ খুঁটিয়ে পড়া ছিল। তাতে বেশ কিছু অপ্রকাশিত রচনাও সংকলিত আছে। এখন ঢাকা বাংলা একাডেমির বারো খণ্ড রচনাবলী ধরে ধরে পড়া গেল। সত্যি বলতে কী, নজরুল যে এতগুলো নাটক লিখেছিলেন তা বই-বাহিকের অজ্ঞাতই ছিল এতকাল। কিন্তু ‘এহ বাহ্য’। দুটো-একটা নিবন্ধ পড়তে গিয়ে মনে হল এমন জোরালো বক্তব্যের গদ্য খুব কমই লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। যদি বলেন, — যেমন? তাহলে বলতে হয়, যথা ‘রুদ্রমঙ্গল’, ‘যুগবাণী’। একটু নমুনা চাই? তাহলে ‘মন্দির-মসজিদ’ রচনাটাই দেখুন। “আবার হিন্দু-মুসলানি কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। ...আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চীৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম —তখন তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরাণীর নাম লইতেছে না। ...দেখিলাম, হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদী চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।”
এ তো গেল একদিক। বেশ এই সময়ের সঙ্গে খাপ-খাওয়া দিক। কিন্তু এই চিরকিশোরের কাছ থেকে বাংলা সাহিত্য আরও কিছু সওগাত পেয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের ভাষাভূগোলটাই ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নজরুল। ‘ধুলার পৃথিবীতে সুন্দরের স্তবগান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে’ পড়া নজরুল স্বপ্নে শুনেছেন ও দেখেছেন ‘পারস্যের বুলবুলের গান, আরব্য উষ্ট্রচালকের বাঁশি, তুরস্কের নেকাব পরা মোমের মতো দেহ।’ এই ভুবন-প্রসারণ সম্ভব হয়েছিল কারণ তাঁর ব্যক্তিত্বের গড়নের মধ্যেই ছিল একরকম প্রসারণ ধর্ম। বাংলা সাহিত্যে তাঁর ‘মুসলমানি’ শব্দের প্রয়োগ-সাফল্য আসলে তারই পরিণাম।
অথচ নজরুলের ভাষাবিপ্লব নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হয় না। কেন? ঐ যে বুদ্ধদেব বসু আমাদের শিখিয়েছিলেন, নজরুল ‘প্রতিভাবান বালক’! আর ঐ পরিচয়টিই হল তাঁর জন্মজরুল!




Post a Comment

0 Comments