লকডাউনের দিনলিপি

ফিরতে ভালবাসি সবাই

অনসূয়া চন্দ্র। ১২ জুন, ২০২০ । ক‍্যালিফোর্নিয়া


যেকোনও কারণেই হোক, আমরা ফিরতে ভালোবাসি। তা সে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় প্রিয়জনের দিকে ফিরে তাকানোই হোক বা নিশ্চল সময়ে বসে ছেলেবেলার রোমন্থন করা অথবা হোক না সে ফেলে আসা শিকড়ের টান।
এখন গল্পটা অবশ্য অন‍্যরকম। হুড়মুড়িয়ে চলতে থাকা বর্তমানটা হুট্ করে অতীত হয়ে গেছে। হাতে রয়ে গেছে অঢেল সময়। যেখানে কর্তা টিভি দেখে ক্লান্ত, গিন্নি সব কাজ সামলাতে হিমসিম, বাচ্চারা রঙ-তুলিতে বোরড্, প্রেমিক বিরহে, প্রেমিকা পুরনো ডি-পি তে, পুলিশ ভিড় ঠেকাতে, জনতা রেশন নিতে এমন আরো কত কী!
এমতাবস্থায় সবাই আবার ফিরতে চায়ছে ১০-৫টার গরমে, ঘেঁষাঘেষিতে, ঝগড়ায়, একঘেয়েমিতে, মুঠোর ঝালমুড়ি, চুমুকের চা, পাড়ার পি এন পি সি, উইক্এন্ড পার্টির কাছে। এই ছেড়ে আসাটা  গুছিয়ে নেওয়ার সময় দেয়নি বলেই এর আকস্মিকতা কাজে যাওয়ার আকুলতাকে তীব্রতর করেছে বলেই আমার ধারণা। ‘আবার কবে দেখা হবে জানি না’— বলার মধ্যে যে অপেক্ষা ও ধৈর্য্যের টুইস্ট বা খিদে আছে তাকে স্কাইপ, ভিডিও কলও যে সামলাতে পারছে না, তা দেখে জাগতিক নৈকট্যের নেটওয়ার্কে বিশ্বাস জন্মায় বৈকি।
বাবা যখন প্রথম প্রথম ভুলতে শুরু করেছিল, সোডিয়াম-পটাশিয়ামের পর্যাপ্ত জোগানেও যখন কাজ হচ্ছে না, একটু একটু করে ভুল হচ্ছে সবেতেই তখন খুব রাগ হত। চেঁচিয়ে বলতাম, কী ক‍রে এত ভুলে যাও? হয়তো ভয়ও হত, এখনো হয়, যদি একদিন আমাকে আর চিনতে না পারে! তারপর এই সেদিনও বাবা জিজ্ঞেস করল, ‘তোর স্কুলের পরীক্ষা হয়ে গেছে?’ না আর রাগ করিনি; মনে করিয়েছি আমি কোথায় আছি, স্কুল ছেড়েছি এসব... এখন বাবাকে আমার পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ বলে মনে হয়। মনে পড়লেই, মনে থাকলেই তো যত জ্বালা!


এই প্রসঙ্গেই আমি ভাবছিলাম করোনা আমাদের ঠিক কী দিয়ে যাবে! দূষণমুক্ত, শিক্ষামূলক, মনুষ্যত্বসূচক, ফুটপাত-মলের বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখার মতো মূর্খ আমি নই। একবার ডিসট‍্যান্সিং উঠে গেলেই যে আমরা আবার ডিসটার্বিং হয়ে উঠব এ নিয়ে আমার অন্তত সন্দেহ নেই।
তবে আমি কল্পনায় ডুব দিই। কোরোনা, আক্রান্ত পৃথিবীকে  যদি ‘ভুলে যাওয়া’ দিয়ে যেত তাহলে বেশ হত না! এই এত ইতিহাস, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয়-তত্ত্ব, তথ্য, মতাদর্শ, শিল্প, রূপকথা, ফিকশন্, ছড়া-কবিতা গদ‍্য-পদ‍্য, খেলা-বিনোদন জারিজুরি মুছে সব কোরা কাগজ। আবার শুরু থেকে শুরু। সদ‍্যজাতকে জানানোর, বোঝানোর, চাপানোর কোনো দায় নেই— অগ্রজরাও শিখছে, জানছে, বুঝছে‌। পৃথিবীর নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে রোজ। ঐতিহাসিকরা ওয়ার্ক ফ্রম হোম! অমলের দইওয়ালা দুয়ারে এসে হাঁক পাড়ছে, গোডো স্ট্রিট ক্রিকেট খেলছে, নন্দিনী রক্তকরবী মাথায় গুঁজে রাজাকে টুইট করছে দিনে-দুপুরে, শিশুরা দল বেঁধে উলঙ্গ রাজার ভিডিও ভাইরাল করছে... এমনই হত হয়ত!
বন্ধুর মেসেজ এল—
‘‘চল্ তুই আর আমি কুমিরডাঙা খেলি!’’
‘‘কী করে?’’
‘‘তুই ইন্ডিয়া চলে আয়্ স্টেট বাস ধরে’’
‘‘ধুস্ ফিরব বললেই ফেরা যায় নাকি!’’
‘‘আর ভুলব বললে?’’
‘‘করোনা হেল্পলাইন ২৪*৭’’



Post a Comment

0 Comments