করোনা

কোয়ারেন্টিন এবং বেদানার কথা

তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায় । ৯ জুন, ২০২০ । কলকাতা


রে দাঁড়ান, সরে দাঁড়ান! আরেকটু সরে যান। সোশাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলা এখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আপনার বোঝা দরকার!
সরেই তো আছি। সরে গেছি দূরে। এমন সরে গেছি যেখান থেকে উত্তরণের উপায় মিলবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মনে পড়ছে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'উটপাখি' কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনদুটো— ‘‘ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে/ মনস্তাপেও লাগবে ওতে জোড়া।’’ করোনার জন্য সরে সরে দাঁড়ানো তো মাত্র ক’দিন শুরু হয়েছে কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের পাশ থেকে আমরা সরে দাঁড়াচ্ছি বহু বহু বছর ধরে। মনে করা যাক, পাশের বাড়ির বয়স্ক মানুষটি যাঁর ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করছে তাঁকে যখন বাজারের ভারী ব্যাগ হাতে ফ্ল্যাটের চারতলায় উঠতে দেখেছি তখন দোতলার বাসিন্দা এই আমি তাঁর ব্যাগটা তুলে দিইনি। অথচ ছুটির দিনে, কষা মাংস আর ফ্রায়েড রাইস খেয়ে জানালার পাশে বসে পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়— ‘‘মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও,
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও’’— পড়তে পড়তে বিড়বিড় করেছি! ভেবেছি- আহা! এমন করে ক'জন লিখতে পারেন...!
তারপর একদিন সময় নিয়ে হেঁটে গেছি ফুটপাত ধরে। বিকাল গড়িয়ে তখন খানিক সন্ধেই বলা যায়। নামী শপিংমল থেকে দু একটা টুকটাক জিনিস কিনতে হবে! ফেরার পথে ফুটপাতে দেখেছি সারি সারি অবোধ সংসার। এক সংসারের ক্লিষ্ট শিশুকে জ্বরে ভুগতে দেখেছি। শিশুটির মায়ের কান্নায় ভারতবর্ষ কেঁপে ওঠেনি! আরে ধুর! কীসব বলছি! নামী শহরের এই অজানা গলির রাস্তা কিংবা নিদেনপক্ষে আমিও তো কাঁপিনি!
বাড়ি ফিরে আসতে চাই...
ফেরার পথে দেখি মোড়ের মাথায় ফুচকার গাড়িটা বসেছে। দাঁড়িয়ে পড়ি। বলি- অর্জুনকাকু আজ বেশ ঝাল করে ফুচকা মাখো তো। কাকুর ঠোঁট থেকে একটা হাসি ঝুলে পড়ে, বলে— ‘‘মামনি! তোমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ফিজ কত?’’ আমি নাক টানতে টানতে উত্তর দিই— ওই কুড়ি হাজার মতো। কেন গো? অর্জুনকাকু উত্তর না দিয়ে বলে, ‘‘খাও...’’। দশ টাকার ফুচকা খেয়ে বাড়তি দুটো ফুচকা ফাও চেয়ে নিই। হাঁটতে শুরু করি...। ফেরার রাস্তায় একটা নার্সারি পড়ে। মায়ের জন্য এখান থেকে ফুলগাছ নিয়ে যাই। এই অন্ধকারেও সাদা বোগেনভিলিয়াগুলো কেমন তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ভাত পোড়ার গন্ধ পাই। দাঁড়িয়ে যাই। নার্সারিটা চালায় সীমা কাকিমা। ওনার স্বামী মারা যাওয়ার পর ব্যবসার হাল উনিই ধরেছেন। বাড়ির বাইরে অজস্র গাছ সাজানো থাকে৷ সীমা কাকিমার মেয়ে এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে বোধহয়। শেষ যেবার মাসিমণিকে দেবো বলে অর্কিড কিনতে এসেছিলাম মেয়েটা আমাকে বইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল, চেয়েইছিল একপ্রকার! ‘আচ্ছা! পরে জানাবো’ বলে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। আজ ভাত পোড়ার গন্ধে সেদিনের কথা মনে পড়লো। যাক গে! বই নিশ্চয় পেয়ে গেছে!
আবার হাঁটতে থাকি...
এই রাস্তাটা পেরোলেই আমার বাড়ি। ল্যাম্পপোস্টে হলুদ আলো জ্বলছে। চারিদিকে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মনে হচ্ছে কেউ নেই! এই পৃথিবীতে, আর কেউ নেই। হাতের ব্যাগটা হঠাৎ নড়ে ওঠে। খানিক আবাক হয়েই ব্যাগের ভেতর উঁকি দিই— একটা বিস্কুটের প্যাকেট,পাঁউরুটি, চারটে আপেল, দুটো পেয়ারা, একটা বেদানা... আমাকে চমকে দিয়ে বেদানাটা লাফিয়ে পড়ে ব্যাগ থেকে। ভয়ে আর উত্তেজনায় আড়ষ্ট হয়ে যাই আমি।
বেদানাটা লাফাতে লাফাতে খুলে ফেলছে খোলা। ভেতরে অজস্র দানা একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। হলুদ আলোয় একটা আস্ত টেলিফিল্ম দেখতে থাকি আমি... দানাগুলো আলগা হয়ে ঝরে যাচ্ছে রাস্তায়...একটা বেদানা, দুটো বেদানা, তিনটে, চারটে দেখতে দেখতে পৃথিবীর সমস্ত বেদানা থেকে দানারা ঝরে যাচ্ছে৷ আর একটাও বেদানা নেই। তাদের লাল রস গড়িয়ে একটা নদী, সে নদীতে স্নান করছে অপুষ্ট শিশু... তারা একনাগাড়ে বলে চলেছে— ‘‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ—/ তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান॥’’
বাড়ি ফেরা হল না...
আমি এখন কোয়ারেন্টিনে।

Post a Comment

0 Comments