ব্লগ : ওদের কথা/ ৭

ওদের কথা/ ৭

পরিযায়ী নাকি অন্য নাম

মঞ্জীরা সাহা


বিজয়া দশমী। ঢাক বাজছে  মণ্ডপে মণ্ডপে।
ওয়ান টু থ্রি ওয়ান ওয়ান আপ কালকা মেইল দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে সন্ধে সাতটা বেজে দশ মিনিটের ছাড়বে। এক ঘোষণা শেষ হতে হতেই আরেক ঘোষণা। জিরো ফোর জিরো জিরো সেভেন হাওড়া নিউ দিল্লি পুজো স্পেশাল এক্সপ্রেস…।
দশ এগারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে খুব ভিড়। প্ল্যাটফর্মদুটোতে হাঁটতে গিয়ে বারবার ধাক্কা খেতে হচ্ছে। গাড়িগুলি মাঝের রাস্তাটাতে যাত্রী নামিয়ে ফাঁক খুঁজে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কোনওটা সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিটা থামল একটু আগেই। লাল নীল হলুদ সবুজ ট্রলির চাকা ঘুরতে ঘুরতে কাদা ছিটেছে। বাক্সগুলোর রঙে কাদার দাগ মিলে গিয়ে বিজ্ঞাপনের মতো দেখতে আর লাগছে না। প্ল্যাটফর্ম দুটোতে লোকজনের মাঝে মাঝে হাতে ধরা প্ল্যাকার্ড উঁচু হয়ে আছে। ট্যুর এন্ড ট্রাভেল্‌স কোম্পানির প্ল্যাকার্ড। প্যাকেজ টুরের লোকজন তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে। যারা এখনও এসে পৌছোয়নি তাদের অপেক্ষায় প্ল্যাকার্ডগুলো। ওই জমাট বাঁধা মানুষ গুলোর বক্স ট্রলির সাথে ধাক্কা লেগে যাচ্ছে রেশন ব্যাগ চামড়া ওঠা রঙ চটা বাক্স কোদাল বালতি প্লাস্টিকের ব্যাগের। এসবের লাইন চলে গেছে প্ল্যাটফর্ম দুটোর দু পাশ দিয়ে। দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই রেশন দোকানের জেরিকেন বোতল ইট পাটকেলের লাইন। শুধু এখানে ওই ব্যাগ বোঁচকা কোদাল কাস্তের মালিকেরা পাশে পাশে উবু হয়ে বসে আছে কেউ। কেউ দাঁড়িয়ে। আর এই লাইনকে লাইন মানুষগুলোর মালিকেরা এপাশ ওপাশেই রয়েছে কোথাও। তাদের কারুর ডিউটি ছিল মালদা মুর্শিদাবাদ উত্তর দক্ষিন চব্বিশ পরগনা নদীয়ার গ্রাম থেকে কোনও বড় স্টেশন অবধি পৌঁছে দেওয়া। কারুর ডিউটি ছিল হাওড়া অবধি পৌঁছে অন্য হাতে হাত বদল করে দেওয়া। কারুর ডিউটি একেবারে দিল্লি হরিয়ানা অবধি নিয়ে যাওয়া। আর কারুর মালিক নেই। পাড়ার কারুর থেকে খবর পেয়ে বা চেনা জানা কোনও এড্রেসে চলেছে কাজে। এই লাইন গুলোর ম্যাক্সিমাম মানুষ চলেছে লেবারের কাজে। নানা রকম লেবার। সাথে কেউ লেবারের বৌ কেউ লেবারের বাচ্চা। ওদের ভাষায়, ‘লেবার খাটতে যাচ্ছি। লেবারি করতে যাচ্ছি’।
দুটো ট্রেনই প্রায় একটার পর একটা ঢুকছে দুই প্ল্যাটফর্মে। বৃষ্টিটা আবার নামলো। ওরা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে লাইন থেকে। ব্যাগ বাক্স কোদাল কুড়াল বালতি বস্তা বাচ্চা যে যার মতো তুলে নিয়েছে ঘাড়ে কাঁধে কোমরে মাথায়। মাঝের গ্যাপ গুলো আরও কমে গেছে। গায়ের সাথে গা লেগে গেছে। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। কোনও মেয়ের ভেজা রঙিন শাড়ি ভিড়ের মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। সাথের শক্তসামর্থ পুরুষটি তারজন্য লাইন রাখবে, ভেতরে ঢুকে সিট রাখবে সে নিয়ম এখানে চলে না। সিটের হিসেব ওই জেনারেল কামরায় আলাদা। ঝগড়া ঝামেলা শুধু ওই ফাঁক ফাঁক কাঠের সিটের জন্যই হয় না। ঝগড়া গালাগাল মারামারি চুল টানাটানি হয় সিট বাদে আরও অনেক রকম জায়গার জন্য। দুটো সিটের মধ্যিখানের মেঝে, বাঙ্কের জায়গা, হাঁটাহাটির জায়গা, বেসিনের নীচের জায়গা খানা, জল গন্ধ ভর্তি বাথরুমের সামনের জায়গা, জোড়া দেওয়া টিনের ভেস্টিবিউলের উপরের জায়গা, বাথরুমের ভেতরের জায়গা এরকম অনেক অনেক রকম জায়গায় বসার জন্য ঝামেলা ঝগড়া হয়।
এগারো নম্বর প্ল্যাটফর্মের শেড আর কালকা মেইলের বগির গ্যাপে ঝরঝর করে শেড গড়িয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। রিসার্ভ কামরায় উঠতে গিয়ে পেছন থেকে ছাতা ধরে থাকছে কেউ। কারুর ছাতার জলে অন্য কারুর জামা ভিজে গিয়ে নানান রকম বিরক্তিসূচক শব্দ বেরিয়ে আসছে মুখ দিয়ে। বৃষ্টি বাড়তে বাড়তে জেনারেল কামরার লাইন দুটো এলোমেলো হয়ে গেছে।
পুলিশ পাশ থেকে বাজিয়ে যাচ্ছে হুইসিল। হুইসিল এর আওয়াজ চেঁচামেচিতে আর শোনা যাচ্ছে না। হুড়মুড় করে ঢুকে চলেছে ভেতরে। ঘাড়ের উপর পা ফেলে বাক্সের উপর পা তুলে দিয়ে ডান বাঁ নিচ উপর যেখান দিয়ে পারা যায় লোকে কামরার ভেতর ঢুকে পড়তে চাইছে। এক কামরায় কত মানুষ ধরে সেসব হিসেব গুলিয়ে ভেতরে অন্য হিসেব শুরু হয়েছে। কোমরটাকে ঠিক কতটুকু জায়গা পেলে সেট করে নেওয়া যায়! ছাতের কাছে ফ্যানের উপর ক’টা জুতো রাখা যায়! কটা জুতো ঝোলানো যায় ফ্যান থেকে! কোথায় কোথায় বালতি উলটে টিনের ড্রাম উলটে বসা যায়, বস্তাটা ঠিক কোন্‌ ফাঁকটাতে পাতা যায়, কোন্‌ লোহার রড থেকে কোন্‌ রড অবধি চাদর বাঁধলে শূন্যে দুলতে দুলতে দিল্লি অবধি পৌঁছে যাওয়া যায় এরকম সব হিসেব।


এ সি কামরায় হিসেব চলছে অন্য কিছুর। এ সি দেরি করে চালিয়ে রেল কোম্পানি ঠিক কতটা লাভ করে নিল তার জন্য অজানা অংকের হিসেব চলছে। দুপাশের দুটো ট্রেনই একটার পর একটা রাইট টাইমে ছেড়ে দিল। পৌঁছেও গেল রাইট টাইমে নতুন দিল্লি।
তারপর এরকম আরও অনেক অনেক ভ্যাকেশান এসেছে, অনেক উৎসবে ছুটিতে মানুষ ফ্যামেলি ট্যুর গ্রুপ ট্যুর প্যাকেজ ট্যুরে গেছে। ট্রেনগুলো পৌঁছে গেছে রাইট টাইমে। কখনো লেট করেছে। সেগুলোর পাশ দিয়ে অনেক অনেক মানুষের লাইন পড়েছে প্ল্যাটফর্মে। লাইনে হোঁচট লেগে বিরক্ত লেগেছে। প্ল্যাটফর্মের শুয়ে থাকা লাইন ডিঙিয়ে যেতে হয়েছে। কত বিদেশী ভাষার  গালাগাল ব্যবহার হয়েছে মানুষের লাইনে ব্যাগ বোঁচকার  লাইনে হোঁচট খেয়ে পড়তে নিয়ে। সারা বছর তাও লাইন পড়েছে। ওভাবেই স্টেশনগুলোতে ওদের লাইন পড়েছে। ওভাবেই ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে পৌঁছে গেছে নিজের জায়গা ছেড়ে বড় বড় শহরে। হপ্তা মাসহারা দাদন দিন মজুরীর আশায়। কখনও এসি কামরার কাচের ভেতর থেকে নন এসি কামরার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে গেটের পাশের ওই লম্বা লাইনের মানুষ গুলোকে কোন নাম দেওয়া যায় কেউ ভেবে দেখেনি।
‘পরিযায়ী’ শব্দটা আগেও ছিল বাংলা অভিধানে। ওই ‘পরিযায়ী’ শব্দটার সাথে যে কোনওদিন ‘শ্রমিক’ শব্দটা জুড়ে যাবে ভাবা যায়নি। এই নামকরণের ব্যাপারটা আসলো সেই ওই আনন্দ বিহার বাস স্ট্যান্ডের জমাট হওয়া ভিড়ের দিন বা তার দু একদিন আগে থেকে। দলে দলে হাজারে হাজারে মানুষ ওই বাস স্ট্যান্ডে রাস্তায় ট্রাঙ্ক বাক্স ব্যাগ বোঁচকা নিয়ে বাস খুঁজছিল। উত্তর প্রদেশ বিহার ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া লেবার ছিল ওরা। যারা বছরের কোনও একটা দিনে দিল্লি হরিয়ানাতে কাজে গেছিল। খবরের চ্যানেলের নিউজ রুমের নিউজ পড়তে থাকা মানুষদের ঘুম উড়ে গেল করোনা সংক্রমণের ভেতর এরা এতো ভিড় করেছে দেখে। করোনা সংক্রমণের ভয়ে টিভি দেখা মানুষ গুলোর ঘুম উড়তে শুরু হল। তারপর হাজারে হাজারে মানুষকে হাঁটতে দেখা গেল বড় বড় হাইওয়ে দিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার। নিউজ চ্যানেলের হেড লাইনে ওদের নামকরণ হল ‘পরিযায়ী’। ব্যাস! লকডাউনে অফুরন্ত সময় মানুষের হাতে। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ শব্দটা  কয়েক দিন যেতে না যেতেই বেশ জানা শব্দের লিস্টে  ঢুকে পড়েছে। কিন্তু জানা হয়নি কাজের জায়গা গুলো বন্ধ হয়ে গেলে অন্য জায়গায় গিয়ে ভাড়ার ঘর থেকে তাড়িয়ে দিলে হপ্তা না পেলে পকেটের টাকা শেষ হয়ে গেলে মজুরী পাওয়ার আশা আর না থাকলে ঠিক কি কি করতে পারে মানুষ। মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে নতুন নতুন খবর আসতে থাকল। কোথাও গ্রামের বাইরে জঙ্গলে চাদর টাঙিয়ে ওরা দিন রাত কাটাচ্ছে। কোথাও পিচের রাস্তায় বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। কোথাও খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলেছে বাচ্চা কাঁধে নিয়ে। কোথাও নদী পেরিয়ে চলেছে নিজের রাজ্যের নিজের গ্রামের দিকে। কোথাও মরছে খাবার অভাবে রোদের তাপে। কোথাও শ্রমিক বোঝাই ট্রাক উলটেছে ।
এসবের মধ্যে হঠাৎ একদিন সকালবেলা এসব মানুষের বদলে অন্য কিছুর ছবি চোখে পড়ল নিউজ চ্যানেলে। রেল লাইনের উপর কয়েকটা রুটি পড়ে আছে। খবরটা ছিল, মালগাড়ি চলে গেছে ঘুমন্ত শরীর গুলোর উপর দিয়ে। ব্যাস! পরিযায়ী শ্রমিক শব্দের সাথে সেই ছবি, দুপুর গড়াতে গড়াতে এক্কেবারে হিট। সবার মোবাইল স্ক্রিনে স্ক্রিনে ঘুরছে সে ছবি। সে ছবির সাথে গান কবিতা প্রবন্ধ কার্টুন মিম পাঁচালী। ভাইরাল। তারপর আরও অনেক ছবি খবর বেরিয়েছে ওদের নিয়ে। কিন্তু এতোটা পপুলার হতে পারেনি সেসব। ফেসবুকের পাতায় তর্ক বিতর্ক হয়েছে নামটা ‘পরিযায়ী’ নাকি ‘পরিভাষী’ ‘প্রবাসী’ ‘চলমান’ রাখলে বেশি ভালো হত। কেউ হেরেছে তর্কে। কেউ যুক্তি দিয়ে জিতে গেছে। লাইক কমেন্ট শেয়ার হয়েছে। লাভ করেছে ফেসবুকের বিদেশী মালিক কোম্পানি।
হেঁটে লড়িতে ট্রেনে বাসে মরতে মরতে ফিরে এসেছে পাড়ার ছেলেগুলো। বাদ চলে গেছে কেউ কেউ। সুন্দর সুন্দর নামকরণের পরেও পাড়ার কালু বাপ্পা রহমান বাপি রাজুরা নিজেদের নামে রিসার্ভেশন টিকিট কাটার অপেক্ষা করছে। বা অপেক্ষায় আছে জেনারেল কামরায় ওঠার লাইনে প্রথমে গিয়ে দাঁড়ানোর!



Post a Comment

0 Comments