ছোটগল্প/ ৫ : চোরাবালি


চোরাবালি

অমিতকুমার কুণ্ডু


মুদ্রের পারে বালির ওপরে পা ছড়িয়ে বসেও সমুদ্রের সৌন্দর্যের আস্বাদ নেয়া থেকে বঞ্চিত হবার মতো দুর্ভাগ্য এ জগতে নেই। জামাকাপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বোঝার সঙ্গে সঙ্গে এই দুভার্গ্যের বোঝাও শহর থেকে পুরীতে বয়ে এনেছি। সমুদ্রের ভয়াল সৌন্দর্যে নিজেদের শরীর ও মন লবণাক্ত করা অগুনতি জনতার মধ্যে একমাত্র আমিই এরকম সঙ্গীবিহীন ভাবে বালির ওপর বসে রয়েছি। ভেজা নরম বালি। হাত দিয়ে ছেনে ছেনে একটা ছোটো দুর্গ বানিয়ে ফেলা যায়, যেখানে কল্পনায় অপেক্ষায় বসিয়ে দেয়া যায় কোনো বঙ্কিমী দুর্গেশনন্দিনীকে। কিন্তু সেটিও হবার নয়। বালি দিয়ে দুর্গ বানাবার মতো শিল্পজ্ঞান আমার নেই। বসে বসে না-শেখা হায়ারোগ্লিফিকের অনুশীলন করছিলাম তাইজন্যে।
“একা একা বসে যে?”
নারীকণ্ঠ। আমার সঙ্গীসাথী বলতে চারবছর আগে শেষ-হয়ে-যাওয়া কলেজের কয়েকজন বন্ধু। একটা বকেয়া গেট টুগেদার সারতে বহু মতবিরোধ ও আলোচনার পর পুরী অব্দি এসে পৌঁছেছি। বলাই বাহুল্য, তাতে কোনও নারীচরিত্র নেই। সুতরাং আগন্তুক অপরিচিতা।
জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে প্রশ্ন বললাম,
“আপনি?”
“সে কি! চেনাও যাচ্ছে না? এতটা বিস্মৃত হয়ে গেছি? তবে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।”
ব্যস্ত হয়ে বললাম,
“আরে, দাঁড়ান, দেখতে পেলে তবে তো চেনার কথা। আমার চশমাটা আনা যায়নি। আর আপনি দাঁড়িয়েছেন আমার খাটো দৃষ্টিসীমার বাইরে। আপনার অবয়বটা তাই, আমার চোখে এখন ঝাপসা। একটু কাছে এসে দাঁড়ান।”
“না থাক।”
মেয়েটি সেখানেই বালির ওপরে বসে পড়লো।
“দূরই ভালো। দূরেই তো আছি এখন। তা চশমার পাওয়ার বেড়ে ছয় হয়ে গেছে বুঝি এখন?”
“নাঃ, সাড়ে পাঁচ। আপনার পরিচয়টা?”
“সেটা এখন থাক। অপরিচয়ের একটা আলাদাই এসেন্স আছে। একাই?”
“না, ওই তো, বন্ধুরা আছে তো। কলেজের পুরোনো বন্ধুরা।”
দেখার তো সাধ্যি নেই, তাই যেদিকটায় ওদের ছেড়ে এসেছিলাম, সেদিকটায় আঙুল তুলে দেখালাম। সম্ভবত ওরা এখনও সেখানেই আছে, কারণ এরপরই অপরিচিতা বললো,
“ও ব্যাচেলর পার্টি দেখছি!”
“ওরকমই।”
“প্রেমিকা জুটেছিল? নাকি ডিরেক্ট অ্যারেঞ্জ ম্যারিজের পিঁড়ি?”
হেসে বললাম, “কোনওটাই নয়। প্রেম-ভালোবাসার সময় পেলাম কোথায়? কলেজ শেষ করেই প্রাইভেট ফার্মে চাকরিটা হয়ে গেল। বাব্বা, যে পরিমাণ খাটায়।”
ততক্ষণে আমার এইটুকু অনুমান হয়েই গেছে যে মেয়েটি আমার পূর্বপরিচিতা, এবং পরিচয় ভালরকমেরই ছিল। গলার আওয়াজটাও চেনা চেনা ঠেকছিল। সুতরাং এসব ব্যক্তিগত কথাও অবাধে বলে ফেললাম।
“সেই, কবে আর সময় হয়েছিল!”
সমু্দ্রের এবারের ঢেউটা একটু বেশিই শক্তিশালী ছিল। এতখানি বাইরের দিকে বসে আছি। তবুও বুক অব্দি ভিজিয়ে দিয়ে গেল। একটা রসিকতা মাথায় এলো। বলেও ফেললাম চট করে,
“আমার সময় হবার অপেক্ষাতে কেউ বসেছিল নাকি?”
“অ্যাঁ?”
মেয়েটি খানিক চমকে গেল যেন, বলল,
“হ্যাঁ, সে তো থাকতেও পারে। আর থাকলেও আমার জানার কথা নয়। কতদিন পর দেখা! কিন্তু এখনও কি চিনতে পারা যাচ্ছে না?’’
লজ্জিতভাবে স্বীকার করতেই হল। তারপর আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। বাধা পড়ল পিঠের ওপর প্রকাণ্ড একটা চাপড়ে। কর্ণ। আমার একজন প্রিয়তম বন্ধু তথা সহকর্মী। বলল,
“একা একা কী বকবক করছিস? চল, সবাই মজা করছে। অনেক তো রেস্ট নিলি!”
একা? চমকে তাকিয়ে দেখি কোথায় সেই মেয়ে। সামনে অন্য এক পরিবার জলের মধ্যে লাফালাফি করছে। ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। কর্ণকে কিছু বলতেও পারলাম না। নিজের পাগলামি প্রমাণ করার আরও একটি কারণ ওর হাতে তুলে দিয়ে লাভ নেই।

পরের দিন আমাদের জগন্নাথদর্শনে যাওয়ার কথা। কিন্তু সমুদ্রের স্বাদে আমি বাদে কারুরই ঠিকমতো হৃদয়পূর্তি হয়নি। ওই সমুদ্র এক অবয়বে ভালও লাগায়, আবার ভয়ও দেখায়। আমি আবার এই ভয়াল ভাললাগা একবারের বেশি পছন্দ করি না। তবে এবারে পুনর্ভ্রমণে দ্বিরুক্তি করিনি! আর তার কারণটা অন্যখানে।
সমুদ্রের সঙ্গে প্রায় ঘন্টাদুই দাপাদাপি করে আমি ক্ষান্ত দিলাম। বন্ধুরা জানে আমাকে। ওরা বাধা দিল না। আমি জল ভেঙে ভেঙে পারে এসে বসলাম। আশেপাশের লোকেদের উৎফুল্লতা সমুদ্রের মতোই উপচে পড়ছে। অনেকক্ষণ দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে ঠিক করলাম বালির মধ্যে একটা পুকুর কাটা যাক। নোনা জলের ছোটো পুকুর, পাশে না হয় বালির বেঞ্চি গড়ে দিয়ে পার্কের মতো করে দেব। বেশ হবে। হাত দিয়ে বালি তুলে তুলে বেশ খানিকটা গভীর গর্ত করে ফেলেছি। এমনি সময় সেই নারীকণ্ঠ, “সমু্দ্রের পারে বসে পুকুর কাটা হচ্ছে? ভারী মজা তো।”
মুখ তুলে ঝাপসা নারীমূর্তিটিকে আরেকবার চেনার চেষ্টা করলাম। নাঃ, সে আজও দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুর মতো হেহে করে হেসে বললাম
“হ্যাঁ, লোনা জলের পুকুর। চারধারে বেঞ্চিও পেতে দেব।’’
মেয়েটিও শব্দ করে হাসলো। তারপর সেখানেই ধপ করে বসে পড়ে বললো,
“আজকেও একা বসে যে? আমার অপেক্ষা করছিলেন?”
“নাঃ। আমি আর কারও অপেক্ষা করে কী করবো! জীবন তো চলেই গেল।”
ছদ্ম দীর্ঘশ্বাসটা অপরপক্ষের খিলখিলে হাসির আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল।
“অত পড়াশোনা না করে একটা প্রেম করে নিলেই হয়ে যেতো।”
“করবো করবো, এইবার একটা সুযোগ আসছে বলে মনে হচ্ছে।”
“সুযোগ আসছে? বেশ, আসুক। তবে আমার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে। আমার জীবনে কোনও আফসোস নেই।”
“এঃ যা!”
“কী হল?”
ফর্সা মুখে সাদা দাঁতের রেখা আমার অল্প দৃষ্টিতেও এড়ায়নি। বললাম,
“বালির বেঞ্চিটা ভেঙে গেল।”
মেয়েটি হেসে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলে নেবার ছলে জিজ্ঞেস করলাম,
“তা আপনি আপনার সঙ্গীদের ছেড়ে এই পারের দিকে কী করছেন?”
“আপনাকেই খুঁজছিলাম। গতকাল আমাকে হঠাৎ না খুঁজে পেয়ে আপনার যে মুখের ভাব হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল বোধহয় ভুতই দেখে ফেলেছেন।”
আবার হাসি।
“তাই-ই বটে। সাগরপিশাচিনী। তা ওরকম করে উধাও কী করে হয়েছিলেন?”
“উধাও হইনি তো। ওখানেই ছিলাম। কেবল পাশের পরিবারটার দিকে একটু ঘেষে গিয়েছিলাম। আপনি এমন কানা যে ওটাও ঠাহর করতে পারলেন না।”
“হ্যাঁ। কানাই বটে, নইলে…  যাকগে, কাদের সঙ্গে এসেছেন? বন্ধু না পরিবার?”
“পরিবার। ওই যে ওদিকে।”
বলে মেয়েটা হাত তুলে দেখালো। এবারেও যে দেখতে না পাওয়াটাই স্বাভাবিক হত, যদি আজকে বেরোবার আগে চশমাটাকে বাক্সে পুরে ট্রাউজারের চেনআঁটা পকেটে করে নিয়ে না আসতাম। এ বুদ্ধিটা কাল রাতেই এসেছিল। চশমাটা চটপট পরে নিয়ে বললাম,
“উঁ, কাকিমা, কাকাবাবু। ওটা বোধহয় তোর ভাই। বাব্বা, কতবড় হয়ে গেছে!”
ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়েছে। তবে এতদিন পরে ওকে দেখে যে উচ্ছ্বাসটা আমার মনের মধ্যে ঢেউ ভাঙছে, সেটা ওর চোখেমুখে নেই। হয়তো গতকাল ছিল। ইন্দ্রাণী এতগুলো বছরে বদলেছে অনেকটাই। সামুদ্রিক বিকিরণে তামাটে হয়ে যাওয়া ফর্সামুখেও বয়সগুলো দাগ কেটে আছে। তবে কিশোরীকালের সেই যে প্রাঞ্জলতা, ওটা ওর চোখের তারায় এখনও অনুভব করা যায়। চমক ভাঙিয়ে ইন্দ্রাণীই কথা বললো,
“আর দেখিস না। মুটিয়ে কুমড়ো হয়ে গেছি।”
“আর আমি যে আমসত্ত্ব হয়ে গেছি শুকিয়ে, তার বেলা?”
“তুই কোনকালে ফজলি আমটা ছিলি শুনি?”
“তা বটে। কতদিন কেটে গেল তাই না?”
“হ্যাঁ, প্রায় দশবছর। স্কুলের পরই আলাদা হয়ে গেছিলাম।”
“কিন্তু, আমাদের তো দেখা হবার কথা ছিল না।”
চকিতে আমার চোখের সামনে কতগুলো দিন চলচ্চিত্রের স্রোতের মতো বয়ে গেল। পাহাড়… ছুটি… সায়ন্তন…। ইন্দ্রাণী বলল,
“দেখা হবার কথা ছিল বলেই হয়েছে।”
আমি মরিয়া হয়ে বললাম,
“ইন্দ্রাণী, তোর মনে নেই ওই কথাগুলো?”
“না, নেই।”
ইন্দ্রাণীর গলার আওয়াজটা এতক্ষণে কঠোর শোনাল।
“আমার কিছু মনে নেই। ওগুলো মনে রেখে হবে-টা কী? তুইও ভুলে যা সব। যা হবার ছিল, তাই হয়েছিল। ভুলে যা সব।”
“এতদিন তো ভুলেই ছিলাম। আজ তোকে দেখেই সব এমন মনে পড়ে গেল। এই মনে পড়াটাই উচিত ছিল না। আমাদের দেখা হওয়া উচিত ছিল না।”
“শোন, তুই পড়ে থাক তোর কুসংস্কার নিয়ে। দশবছর অনেকটা সময়, অনিমেষ। এতবছর কোনও অতীতই পিছু করতে পারে না।”
এরপর খানিকটা সময় নীরবে কেটে গেল। এমন ভারী নীরবতা আমি বহুদিন অনুভব করিনি। কোলাহলে ভরা সমুদ্রসৈকতে নিজেদের দুটি বিচ্ছিন্ন প্রাণী মনে হচ্ছিল। ইন্দ্রাণী উঠে পড়লো। বললো,
“আমি যাই এবার। ওরা খুঁজছে। চিন্তা করিস না, আর দেখা হবে না আমাদের।”

গতকাল রাতে একটুও ঘুম হয়নি। নির্ঘুম চোখে পাখার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভোরের দিকটায় তন্দ্রা গভীর হয়ে এসেছিল। সেই ঘুমটাও সকাল না হতেই ভাঙিয়ে ছাড়ল কর্ণ। সসকা-সকাল মন্দিরে না গেলে নাকি পুজো দেয়া যাবে না, লাইন পড়ে যাবে। আমার তখন সারারাত্রির ক্লান্তিতে মনের অশান্তি মিশে একেবারে বিচ্ছিরি অবস্থা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“ধুর, আমি ওই মন্দিরে-টন্দিরে যেতে পারবো না। তোরা যা, আমি পরে নন্দনকানন যাবো।”
সকলে খেঁকিয়ে উঠলো। সুমন্ত বললো,
“ওর এখনও ঘুম ছাড়েনি, মুখে জল ঢেলে দে।”
আশীষ বললো,
“পাশের ঘরে কোনও মেয়ে আছে নাকি খোঁজ নে তো, কর্ণ। শালা, ওই কারণেই যাবে না লাগছে।”
শেষ অব্দি আর যাইনি। তার বদলে ঘুমটা পুরো করে নিয়ে দুপুরবেলা পায়ে হেঁটে শহর দেখতে বেরোলাম। অনেকক্ষণ ঘোরার পর রাস্তার ধারের একটা রেস্টুরেন্টে ঢোকার মুখে আবার হয়ে গেল দেখাটা। অগত্যা! এক টেবিলে বসে দুজনে দুরকম খাবারের হুকুম দিয়ে নীরব রইলাম অনেকক্ষণ। আমাকে সাধারণ মাছের ঝোলভাত আর ওকে চিকেন বিরিয়ানী দিয়ে গেলে পরে ইন্দ্রাণীই প্রথম কথা বলল,
“কোনও মানে হয় এসবের? এরকম গোমড়া মুখে বসে থাকার? আফটারঅল, ওটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই ছিল না।”
বললাম,
“কিন্তু পরের ঘটনাগুলো? ওগুলোর সঙ্গে সেদিনকার কোনও যোগ নেই বলতে পারবি তুই?”
“যোগ কোনটা? তোর সেই স্বপ্নে দৈববাণী শোনাটা তো?”
“স্বপ্ন হোক, আর যাই হোক, ইন্দ্রাণী, আমি স্পষ্ট শনেছিলাম গলাটা, বলেছিল, ‘খুব শিগগির দেখা হবে আমাদের, অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে।’ গলাটাও এক্কেবারে এক।”
“কাম অন, অনিমেষ।”
চিকেনটায় একটা কামড় দিয়ে ইন্দ্রাণী আবার বললো,
“এটা তোর কংসমামার যুগ নয়। ওইসব গাঁজাখুরি গল্প ছেড়ে চুপচাপ খা।”
আমি একগ্রাস খাবার মুখে নিয়ে খানিক চিবিয়ে বললাম, “কিন্তু তারপরের ঘটনাগুলো? স্কুল থেকে ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্টটা? ট্যাক্সিটা ফুটপাথে উঠে গিয়ে ধাক্কা মেরেছিল আমাদের মনে আছে? তোর তো খুবই সিরিয়াস অবস্থা হয়ে গেছিল।”
“হ্যাঁ, তারপর রেজাল্টের পরের দিন রেস্টুরেন্টের কাঠের সিঁড়িটা ভেঙে পড়ে গেছিলি তুই। সেবার তো তোর খুব চোট লেগেছিল। আর আমিও তোর সাথেই ছিলাম। এই উদাহরণটা দিবি না?”
“সেবারই হাসপাতালে বসে আমরা ঠিক করেছিলাম আর দেখা করবো না, মনে আছে?”
“তখন আমরা ছোটো ছিলাম অনিমেষ। সবকিছুর কার্যকারণ না খুঁজে কেবল সহজে যা ভাবা যায়, তাই ভেবে নিতাম।”
“তা, বড় হয়ে কী কার্যকারণ বার করেছিস শুনি?”
“ওগুলো অ্যাক্সিডেন্ট ছিল।”
“দুবারই?”
“হ্যাঁ। দুবারই। আর তৃতীয়বার বলে কিছু হয় না।”
“যদি হয়?”
আমি কয়েক সেকেন্ড থেমে গিয়ে বললাম। ইন্দ্রাণী সেই ফাঁকে একটুকরো আলু সমেত রাইস মুখে পুরে দিয়েছে। চিবোতে চিবোতেই কী একটা বলল, বোঝা গেল না। বললাম,
“খাবারটা গিলে নিয়ে বল।”
ইন্দ্রাণী গ্লাস থেকে একচুমুক জল খেল। আর সেই মুহূর্তেই অঘটনটা ঘটে গেল। ইন্দ্রাণীর হাত থেকে জলের গ্লাসটা পড়ে গিয়ে ওর জামাকাপড়, খাবার টেবিল সব জলে একাকার হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি, সে তখন গলায় দুহাত চেপে হাঁপাচ্ছে পাগলের মতো। মনে হচ্ছে হঠাৎই পৃথিবীর সমস্ত বাতাস তার সামনে থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তার চোখ উল্টে আসছে। গলায় আঙুল দিয়ে মাঝে মাঝে বমি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বাতাসের সঙ্গে তার যেন আজীবনের বিরোধ লেগে গেছে।
আমি প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর বুঝলাম, অর্ধচর্বিত খাবার চটপট জল দিয়ে গিলে ফেলতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ স্নায়ুকেন্দ্রের মুহূর্তের গোলযোগে খাবারের দলা গ্রাসনালীর বদলে ওর শ্বাসনালীতে ঢুকে গেছে। আমি আমার গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম। প্রচণ্ড বিষম লাগলেও বাঙালি মায়েরা দেখেছি জলই খেতে বলে। ইন্দ্রাণী জলের গ্লাসটা এক হাতে ধরেও খাবি খেতে লাগল, জল খেতে পারলো না। তখন ঘটনার গুরুত্বটা বুঝতে পারলাম আমি। চিৎকার করে অ্যাম্বুলেশ ডাকতে বললাম। আশেপাশের লোকেরা এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। কেউ বলছে পেটে চাপ দিতে, কেউ বলছে বুকে। অনভিজ্ঞ হাতে চেষ্টা করা হল সবরকম। কিন্তু নিয়তির হাত অনেক বেশি দক্ষ। ইন্দ্রাণী ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল।
নন্দনকাননে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি সেদিন। হাসপাতাল-মর্গ-থানা-পুলিশ করে যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন প্রায় আটটা বাজে। তবুও ভাল প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে আর ডাক্তারি পরীক্ষায় পুলিশ আশ্বস্ত হয়েছিল যে ঘটনাটা প্রকৃতই দুর্ঘটনা। নইলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া অব্দি আমার হাজতবাস নিশ্চিত ছিল। হোটেলে ফিরে বন্ধুদের রসিয়ে কৈফিয়ত দেবার মুড বা এনার্জি কোনওটাই ছিল না। রাতের খাবারটা খেয়ে ডায়েরিটা হতে নিয়ে বসেছিলাম, কর্ণ তাড়া দিল খানিক পরেই। আগামীকাল সকালেই আমাদের ফেরা। তাড়াতাড়ি শুয়ে না পড়লে ঘুম ভাঙবে না।
ঘুম ভাঙল মাঝরাতে, কী একটা স্বপ্ন দেখে। ঘুর্ণায়মান বৈদ্যুতিক পাখার আরামদায়ক বাতাসের নীচে আমি ঘেমে একসা। ঘরের মধ্যে ডিমলাইটের নীলচে আলো জ্বলছে। আর তাতে ঘুমন্ত কর্ণের চেহারাটা অচেনা দৈত্যের মতো লাগছে। জাগিয়ে দিলে যেন এক্ষুণি আমার গলাটা চেপে ধরবে।
কর্ণ আমার সহকর্মী। কলেজ- ইউনিভার্সিটি একসঙ্গে শেষ করে একই কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি দুজনে। একই পোস্টে। এমনকি প্রমোশনের জন্যেও আমরা দুজনই সমান দাবিদার। প্রমোশনটা হয়ে গেলে বেতনটা অনেক বেড়ে যাবে আর এত খাটতেও হবে না।
যাকগে সেসব। কিন্তু ঘুমটা কী জন্যে ভাঙল? স্বপ্নটা কী যেন ছিল! হঠাৎই মনে পড়লো, স্বপ্নে ইন্দ্রাণীকে দেখেছিলাম। হ্যাঁ, ওকে-ই দেখেছিলাম। রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি খেতে খেতে কথা বলছিল আমার সঙ্গে। যে কথাটা তখন বুঝিনি, সেকথাটা এখন বুঝলাম। স্বপ্নে এসে সে আরও স্পষ্ট করে বলে দিয়ে গেল কথাটা। “হলে হবে। আমি আগে মরলে, তুই পরে মরবি।” মে মাসের গরমেও আমার শরীরে শীতল বায়ুস্রোত বয়ে গেল।

প্রায় বছর দশেক আগের কথা। আমরা তখন শিলিগুড়ির সরকারি স্কুলে পড়ি। ক্লাস ইলেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে কয়েকজন মিলে ঠিক করে একদিন সেবকে বেড়াতে গেলাম। সেই সবার মধ্যে আমাদের একটা ছোট্টো গ্রুপ ছিল। তাতে ছিলাম আমি, ইন্দ্রাণী আর সায়ন্তন। সায়ন্তন আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ব্রাইট ছেলে ছিল। মাধ্যমিকে গোটা দার্জিলিং জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছিল ও। আমিও অবশ্য কম যেতাম না। ও প্রথম হয়েছিল, আর ওর চেয়ে দুটো নম্বর কম পেয়ে আমি হয়েছিলাম দ্বিতীয়। ওই দুই-তিন নম্বরের ব্যবধান আমি কোনোদিন কাটাতে পারতাম না। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষাগুলোতেও ওই ব্যবধান আমাকে দ্বিতীয় স্থানে আটকে রাখত। মাঝে মাঝে এ নিয়ে রাগ হত খুব। ছেলেটা কী এমন করে যে… অবশ্য বন্ধুত্বে কোনো সেই ব্যবধানের কোনো প্রভাব ছিল বলে আমার তখন মনে হত না।
শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে ছোট্টো পাহাড়ি এলাকা সেবক। পাহাড়ি নদী তিস্তা সেবকের বুকে গভীর গিরিখাত কেটে শীর্ণা রমণীর মতো এগিয়ে গেছে। গিরিখাতের একদিকে পাহাড়ের ওপরে একটা মন্দির। বাঁদর-হনুমানের উৎপাত এড়িয়ে মন্দিরের পিছনে ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়ালে নীচে জংলি গাছগাছড়া ঢাকা খাড়া পাহাড়ি ঢাল দেখা যায়। সেই ঢালের নীচেই তিস্তা। শক্ত শক্ত পাথরের ওপর গা এলিয়ে পড়ে থাকা এক শান্ত সুন্দর নদী। বারান্দাটায় রেলিং দেয়া যথারীতি। রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে আমরা তিনজনে পাহাড় দেখছিলাম। আর কেউ আশে পাশে ছিল না। জন্মমৃত্যুরহিত বিশাল প্রকৃতির সামনে কেবল আমরা তিনজন। মাঝখানে শুধু একটি রেলিংয়ের ব্যবধান। এমনি সময় ইন্দ্রাণী কথা বললো,
“এই, তোরা এই রেলিংটায় পা ঝুলিয়ে বসতে পারবি?”
“আমি আরামে পারব।” আমি বললাম।
“আমিও পারব। চল বসি, বেশ মজা হবে।”
ইন্দ্রাণী কথাটা বলেই হাঁটুর থেকে একটু উঁচু রেলিংটায় উঠে পড়ল। দেখাদেখি আমিও উঠলাম। সাপোর্টের জন্যে দুটো থামের পাশে বসেছিলাম আমরা। যদিও সাপোর্ট লাগেনি একেবারেই। সায়ন্তন কিন্তু উঠল না। একটা মেয়ে হয়ে ইন্দ্রাণী রেলিংয়ে বসে পড়েছে, আর ও ভয় পাচ্ছে। বন্ধুকে ক্ষেপাবার এর চেয়ে বড় অজুহাত হয় নাকি? আমরা নেমে এসে ওকে ক্ষেপাতে লাগলাম। ছেলেটা একটু আবেগী। কিছু কিছু ঠাট্টাও ওর গায়ে লেগে যেত। এর মধ্যে মোক্ষম চালটা দিল ইন্দ্রাণী,
“অনিমেষ, এ তো দেখছি পুরুষ জাতের কলঙ্ক রে। সেভেন-এইটের বাচ্চাছেলেরাও এর চেয়ে বেশি সাহসী হয়।”
বয়েসের হিসেবে পুরুষ আমাদের বলা যায় না বটে। কিন্তু তখন গলার আওয়াজ ভারী হয়ে গেছে, গালের ওপরে দাড়ির জঙ্গল বসতে শুরু করেছে। পুরুষত্বের ওপর খোঁটা দিলে গায়ে কিন্তু লাগেই। সায়ন্তনকে দেখলাম কোনও কিছু না ভেবে রেলিংয়ের ওপর চড়তে শুরু করলো। তার হাতের কাছে যে কোনও থাম অব্দি নেই ধরার জন্যে, পৌরুষের প্রমাণ দিতে সেটাও সে গ্রাহ্য করলো না। বসেছিল ঠিকঠাকই। গোলমাল হল নামার সময়। আমি তখন বলেছিলাম,
“নীচে দেখ সায়ন্তন। একবার যদি ব্যালেন্স হারাস, তোর বডি অব্দি খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
সায়ন্তন একবার নীচে তাকিয়েই রেলিং থেকে নেমে আসার জন্যে ঘুরলো। তার চেহারা আতঙ্কে কালো হয়ে গেছে। সেই আতঙ্কেই কি না কে জানে, সায়ন্তন সমতা হারিয়ে ফেলল। আমাদের কারও কিছু বোঝার আগেই সে জীবনময় পৃথিবীর নাগাল হারিয়ে ফেলল। পাহাড়ি আগাছায় আছাড় খেতে থাকা ওর শরীরটা দেখে আমার আচমকা মনে হল, দু’নম্বরের ব্যবধান আমার থেকে অপরিমেয় দূরত্বের ব্যবধানে চলে যাচ্ছে।
বলাবাহুল্য উচ্চমাধ্যমিকে জেলায় প্রথম স্থানটা আমারই হয়েছিল। কিন্তু তার আগে ও পরে হয়ে যাওয়া দু-দুটো দুর্ঘটনায় আমরা ভয় পেয়ে যাই। সায়ন্তনের মৃত্যুতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হলেও, আমরা নিজেদের মনে দায় এড়াতে পারিনি কোনওদিনই। সময়মতো হাতটা যদি ধরতে পারতাম ওর… তারপর ওই মুহূর্তে আমার মাথার মধ্যে যে অন্যায় স্বস্তিটা এসেছিল…  হতে পারে, আমাদের সেই অন্যায়ের আধিভৌতিক কিংবা আধিদৈবিক প্রতিশোধ নেবার একটা চক্রান্ত চলছে। আমরা আর ঝুঁকি নিইনি। সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর এতগুলো বছর কিছুই হয়নি। এই আবার হল। আমাদের পুনর্বার দেখা হবার পরই হল।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। আজ ২৩শে মে। এইদিনটাই সায়ন্তনের মৃত্যুদিবস। জানি না কী নিয়তি অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। তবে যাই থাকুক ভাগ্যে, স্বীকারোক্তিটা লেখা থাকল। পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে।

কর্ণ ডায়েরিটা বন্ধ করে আশীষের হাতে দিল। আজ হাওড়া স্টেশনে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুহূর্তে অনিমেষ হঠাৎ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ মেরেছে। নামার সময় হয়েছে বলে ব্যাগপত্র জোগাড় করে ওরা তখন ট্রেনের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। কর্ণ আর অনিমেষ প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজায়। আশীষ আর সুমন্ত উল্টো দিকের দরজায়, ওরা ওদের পকেটের শেষদুটো সিগারেট টেনে নিয়ে গাড়ি থেকে নামবে। ট্রেনের গতি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এতটাও কমে আসে নি যে ওভাবে লাফালে… অনিমেষ হঠাৎই ঝাঁপ মেরেছিল। কারো কিছু বোঝবার আগেই প্ল্যাটফর্মের শক্ত কংক্রিটে মাথা ঠুকে গিয়ে…।
অ্যাম্বুলেসের বেডটায় অনিমেষ এখন নিথর শুয়ে আছে। কর্ণ ওর রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো, ‌ভাগ্যের এমনই ষড়যন্ত্র, প্রমোশনের চিঠিটা এভাবেই তার হাতে আসার ছিল। অনিমেষের মৃতদেহটাকে জড়িয়ে ধরে তারপর হঠাৎ সে কান্নায় ভেঙে পড়লো। কান্নার ফাঁকে একবার দেহটাকে উল্টে দেখে নিল, না, জামার ওপরে কোনও হাতের ছাপ নেই। কেবল একটা ধাক্কা মারলে পিঠে হাতের ছাপ লেগে থাকে না।

শিল্পী : প্রমিতা বারুই

Post a Comment

1 Comments

  1. চোরাবালি গল্পটা মন ছুঁয়ে গেল।

    ReplyDelete