ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ৩ । যোদ্ধা বিষণ্ণ হবার মন্ত্র শিখে যাবে


যোদ্ধা বিষণ্ণ হবার মন্ত্র শিখে যাবে

তড়িৎ রায় চৌধুরী 


‘ওজস্বিতা’ ‘উদ্দীপনা’ /ছুটাও ভাষা অগ্নিকণা,/ আমরা করি সমালোচনা/ জাগায়ে তুলি দেশ!/ যাক-না দেখা দিন-কতক/ যেখানে যত রয়েছে লোক/ সকলে মিলে লিখুক শ্লোক/ `জাতীয়’ উপদেশ।
বাস্তবিক যুদ্ধ-প্রীতি বা সমর্থনে মেতে ওঠার মধ্যে আমাদের মুখ্য কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও মনে হয়েছিল; এমন একটা খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে অহরহ উৎসাহে যেন আমরা উড়িয়া চলিতাম। লজ্জা ভয় সংকোচ কিছুই ছিল না। ব্যাক্তিগত ঝগড়ার স্তরেও এই তপ্ত হাওয়া আমরা টের পাই। তবু গোষ্ঠী আর ব্যষ্টিজীবন তো এক নয়। বীরত্ব জিনিসটা গোষ্ঠী জগতে প্রকাশে কিছু ধক্ লাগে। কিন্তু ওটার প্রতি মানুষের একটা গভীর শ্রদ্ধা আছে। সেই শ্রদ্ধার সাধ ভক্ষণই আমাদের লক্ষ্য। আমরা তাই খেলা দেখতেও বসি একদলের সমর্থক হয়ে। কারণ আমরা খেলা দেখি না জয় দেখতে চাই। সকল দেশের মনোরঞ্জনেই তাই বীরপূজার আয়োজন অন্তহীন। আর আমরা পুষ্পাঞ্জলি ধারক ভক্ত দল। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ফুল ছুঁড়ে দি।
আমরা সামান্য লোক। জীবিকার তরে আমরা যা কিছু হয় করে যেতে পারি। কিন্তুক তুমি তো আদর্শবাদী। তুমি মরে গেলে কতো লোক কতো যুগ ধরে তোমার কাহিনি গেঁথ্যে গ্রামে গ্রামে গান গায়্যা যাবে। আমাদের সেই কল্পনার মূর্তিট্যারে চূর্ণ করে দেওনের কোনও অধিকার নাই তোমার। তুমি তো কেবল তোমার নিজের নও। তুমি মানুষের কল্পনার। তোমার সে দায় তুমি মনে রেখো।
তাই অস্ত্র থাক বা না থাক সীমান্তে যোদ্ধার মূল অস্ত্র আবেগ। আর যার মধ্যে সেই আবেগ নেই। যে মানুষের কোনও দল নেই। দলবদ্ধ হবার কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। বার্নার্ড শ'এর আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান-এর সেই পেশাদার সৈনিক; সে বুঝেছিল যুদ্ধক্ষেত্রে গোলা বারুদ নয় অভাব হয় খাদ্যের। চকলেট রাখতে হয় সঙ্গে।
মানুষ যাতে আবেগ থেকে খাদ্যের দিকে চলে না যায় তার প্রস্তুতিও কম থাকে না গোষ্ঠপরিচালনায়। নাগরিকদের শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া হয় নানাভাবে।
অন্য বা অপর কেন খারাপ?
— ওরা খুব খারাপ, ভয়ানক খারাপ, সবাই জানে।
ব্যাস। যা সবাই জানে, মানে তা তো স্বতঃসিদ্ধ তখন আর যুক্তি গ্রাহ্য কারণ দরকার হয় না।
— উত্তরকূটের মানুষ কোনদিন যুদ্ধে হেরেছে জানিস।
— কোনওদিনই না।
— আমাদের পিতামহ দুশো তিরেনব্বই জন সৈন্য নিয়ে একত্রিশ হাজার সাড়ে সাতশো বর্বরকে হটিয়ে দিয়েছিলেন না?
— হ্যাঁ, দিয়েছিলেন।
এভাবেই জাতিগত মিথ তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠান বা পরিবার গত ঐতিহ্যের মিথও। সত্যেন্দ্রনাথের মতো কবি লিখে বসেন ‘আমরা’ কবিতা। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর মতো মানুষ ‘জননী জন্মভূমি’ কে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে বিদেশী আক্রমণকে ঘাড় ধরে সীমান্ত পার করে দেবার পংক্তি লিখে বসেন। হয়তো আশা ছিল। অজানা ছিল আকসাই চীনের কথা। যেমন আজও দেশের ম্যাপ তার প্রকৃত বাস্তবতা নয়। আসলে যুদ্ধ তো কোন সরল রৈখিক প্রক্রিয়া নয়; জটিলতায় তা নানা ভাবে নানা রূপে নানা স্তরে চলতেই থাকে।
আর আমরা তো জানতে চাই না, জয় চাই। তাই আত্মতৃপ্তির এক সুরক্ষিত আবহ নির্মাণ করতে চাই নিজের চারপাশে। ভিন্ন মতের মানুষ কে আনফ্রেন্ড করি, বন্ধুত্বের বোঝা হাল্কা করি সগর্ব ঘোষণায়। পরিধির খবর তাই সেন্সর হয় আসে অন্তর্গত বিন্দুতে। সেন্সরের মুখ্য লক্ষ্য তো স্বস্তি; সত্য নয়।
আমি তাই কাঁদি না, দোষ স্বীকার করি না বরং আগুন প্রবণতায় হয়ে উঠি ধ্বংসাত্মক। অশান্তি চরমে তুলব/ কাক চিল বসবে না বাড়িতে/ তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি/ আমি ভাঙব কাঁচের বাসন।
ভাঙনের শব্দ সবসময় শোনা যায় না। সেন্সর হয়ে যায়। প্রেম চলে যাবার মতো দুঃখে আকুল হই না; বরং গোছাতে থাকি। নিজেকে, নিজের চারপাশকে। দোষ আরোপের দায়ে ভারি হয়ে ওঠে ভালোবাসার বাতাস। কেন না তা যুদ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ শোকসভা করে না। এ যুদ্ধের শেষ কি সমর্পণে নাকি পরাজয়ে? সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে/ হবে দুই বিছানা আলাদা/ হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ/ মধ্যরাতে আচমকা মিলন।



যুদ্ধের স্বাদ ভারি তিতকুটে। আর ঢাকের বাদ্যি থামলেই মিষ্টি। বৈচিত্র্য  পিয়াসী জীবন কোনও স্বাদই ছাড়তে চায় না। মিলনে মুছে যায় সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ।
আর কে না জানে সব যুদ্ধেই নিয়ন্ত্রণ রেখার অবস্থান নিয়েই চলে চাপান-উতোর। যে নিয়ন্ত্রণ যজ্ঞের অভূতপূর্ব সন্তান লকডাউন। আজ শুরু হয়, কাল থেমে যায়, পরশু আবার পুনরায়। রেগুলেটার ঘোরাতে থাকে রাষ্ট্র। কুরুক্ষেত্র থেকে বিশ্বযুদ্ধ; কোল্ডওয়ার থেকে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম সীমাহীন বিচিত্র পথে আজ এসেছে জীবানু যুদ্ধ। চিকিৎসা-কর্মীদের পোশাক যেন সেনাবাহিনী কেই মনে পড়ায়। শান্তিবাহিনী। শান্তি স্থাপনের জন্য যুদ্ধ। বিশ্ব একাদশ বনাম অদৃশ্য ভাইরাস। যুদ্ধের এই আর এক মজা। পরিসর বদলে যুদ্ধের পক্ষ বদলে যায়। দুটো স্কুল ফাইনাল খেলেছিল জেলার কাপ জেতার জন্য। অথচ রাজ্যস্তরে সেই দুই শত্রু সৈন্য কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে লড়েছে অন্য জেলার সঙ্গে। বৃত্ত যত বড় হয় শত্রুরা মিত্র হয়ে যায়। যুদ্ধের রং ঢং সবই বদলে যাচ্ছে ঘরে বাইরে। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়— একদিন সমস্ত যোদ্ধা বিষণ্ণ হবার মন্ত্র শিখে যাবে/ একদিন সমস্ত নারী চোখের ইঙ্গিতে বলবে, এসো/ একদিন ছেলেরাও মেয়েদের বন্ধু হয়ে যাবে/ একদিন এইসব হবে বলেই এখনও/ সূর্য ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, এবং কবিতা লেখা হয়।


যাঁদের লেখা ব্যবহৃত হয়েছে— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শম্ভু মিত্র, জয় গোস্বামী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।


Post a Comment

1 Comments

  1. "যোদ্ধা বিষণ্ন হবার মন্ত্র শিখে যাবে "তড়িৎ এর লেখা পড়লাম। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে "আমরা সামান্য লোক...."ভাষার আঞ্চলিক ধাঁচাটি ভীষণ মন কেড়েছে।বার্নার্ড শ,সত্যেন দত্ত,কবি সুভাষ,রবি ঠাকুর, শম্ভু মিত্র সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে খুব মনোজ্ঞ একটি লেখা হয়েছে। বেশ ভালো লাগলো পড়ে।

    ReplyDelete