লকডাউন ও কাফকা’র ছারপোকা


লকডাউন ও কাফকা’র ছারপোকা

শুচিস্মিতা দাস 


ন্দি যক্ষ এ-মেঘের রঙ দেখেই অস্থির হয়েছিল কিনা জানি না। বর্ষণে প্রকৃতির গাঢ় সবুজ ভারি হয়ে উঠেছে। মাসখানা আষাঢ়।
এক অধ্যাপক ক্লাসে একদিন বলেছিলেন, ‘আষাঢ়ের ঢ়-এ বৃষ্টির বসতি।’ তাই আমি এখনও ওনার মত করে আষাঢ় বলতে পারি না। রাস্তায় মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে কয়েকটা ছেলে আড্ডা মারছে, মুখে ‘মাস্ক’ বাঁধার দরকার এদের পরে না। এসময় রোজ এক বয়স্ক রাস্তা পার হন। মুখে কাপড়ের ‘মাস্ক’, সবুজের ধার দিয়ে খয়েরী ডোরা। হাতে দুটো ম্যাগি, আরেকটা লাল লঙ্কাগুড়োর প্যাকেট। সম্ভবত এটাই দিনের প্রথম খাওয়া— লাঞ্চ। বিকেল ৪ টে বাজে। পাশের ‘কুঞ্জলতা অ্যাপার্টমেন্টের’ গার্ড শিবু মহান্ত। লকডাউন না থাকতেও যতবার বাড়ি এসেছি ও দেওয়ালের গা ঘেঁষে বসে থাকে। ওর বসার ঘরের সিমেন্টের ওপর রঙ নাই। গরম-শীত-বর্ষণ-লকডাউন— ও সবসময়ই সামনে তাকিয়ে থাকে। পাড়ার এক কাকু নাম দিয়েছেন, “আহা! নীরস বুদ্ধদেব যেন।” আমার ধারণা ওই সিমেন্টরঙ দেওয়ালের সঙ্গে লেগে ও যে-কোনওদিনই পাথর হয়ে যাবে।   
লকডাউনে এক ক্রিয়ারই জোরালো প্রতিক্রিয়া আছে। ছ-বছর আগে ছেড়ে যাওয়া এক বাড়ির সংস্কার-কুসংস্কারের সঙ্গে বিস্তারিত গল্পগাচ্ছা। জীবজ কুসংস্কারের কারণে যা পাল্টে গেছে তার দিকে তাকাতে ভয় পাই। যা পাল্টায়নি তার দিকটায় কী পরম স্বস্তি। পুরোনো মনখারাপের সঙ্গে আলাপচারিতা বাড়ে। গাছ-গাছালিময় এক ছাদ বৃষ্টিতে ভিজে, ভেষজ গন্ধে নিজেই বুঁদ হয়ে আছে। টেরাকোটা রঙ ধরে যাওয়া টালির ওপর লাল তেলাকুচা ফলের ঝিলিক। লাল খোপকাটা গামছার নীচে নাদুসনুদুস পোয়াতি বেড়াল আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। এখনের মনখারাপ তখনের মতো নিখাদ নয়। বড়জোর ‘রিজেকশন মেইল’, ওয়ার্ডলিমিটস, সুপারভাইজারের ঠাণ্ডা চাউনি বিনিময়ের পর ঝিলপাড়ের মিষ্টি গন্ধ। চোখ টিপে দেখে নিই দুপুরের ঘনত্ব পাল্টেছে কীনা! ‘বাঙলার নিদাঘের তাপদদ্ধ নিস্তব্ধ মধ্যাহ্ন’— ছোটকালের বাঙলা বইয়ে রচনা শুরুর উদ্ধৃতি। গল্পে বলা প্রথম বয়স্কজনের ভালো নাম ‘সুজন-পাগলা’। ভালো বাড়ির ছেলে। এককালে সরকারি চাকরি-বাকরি করেছে। এখন বাড়িতে ভাই ও ভাই-বউ। সুস্থ। সে পাগল এক দুপুরে ভাঙা চিৎকার করে কাঁদছিল, জানতে চেয়ে- সে “কার কী ক্ষতি করেছে?” তখন থেকেই আমি জানি ওর সঙ্গে আমার কিছু বিষয়গত মিল আছে। 
লোকের বাড়ির অন্দরমহল দেখার এখন অবসর। কারণ বিকেলে সবার বাড়ির জানলাই প্রায় খোলা। বাঙ্কে রাখা বড় লোহার কড়াই, নতুন বাজারের থলে- চাল-ডাল-বিস্কুট। তারপাশে একটা গ্লোব। তুলোয় করে স্যানিটাইজার বোলাচ্ছে। টিভিতে বলেছে না! বাজারের জিনিসে, কড়াইতে, হাল্কা করে গ্লোব-এও। এ সময়টা অনেকেই ছাদে হাঁটছে। ‘কুঞ্জলতা অ্যাপার্টমেন্টের’ ভদ্রলোক ছাদ থেকে চিৎকার করে মুদির দোকানদারকে বলল, ঘড়ির ব্যাটারি পাঠাতে। লকডাউনে সবসময় দোকান খোলা থাকে না। মফস্বল। অতএব জীবনের গতি খানিকটা শান্তরসে বাঁধা। কিন্তু বাহ্যিক অনুষঙ্গ ছাড়া যাপন কী অসহায়! আগে ডেডলাইনের আশ্রয়ে দিন কেটে যেত। অসময় এখন দু-বাহু বাড়িয়ে সামনে সটান— “বলো দেখি, আমায় নিয়ে কী কী তুমি করতে পারোনি?”



এমনিতে বর্ষা। বেলি গোছ হয়ে ফুটছে। হলুদ সন্ধ্যামণির ভিতর রাণী রঙ। এবাড়ির একজন আছেন— যিনি চিনি ছাড়া চা খেয়ে চা-পাতা জমান গাছের জন্য। ওতে মাটি সারবান হয়। এখন বিষয় হল, তিনি সর্বত গাছ লাগান, বেড়ালকে খেতে দেওয়ার বাতিল প্লাস্টিকের বাটিতে, মাটির ভার, চারাগাছের শিকড় বের করার জন্য পুরোনো দুধের প্যাকেটেও। এত রাতে ছাদের একদিকে পচা সার-খইলের গন্ধ। হেডফোনে— ‘শাওন বিতো যায়ে পিহারবা’। বাড়িতে আরেকজনও আছেন তাকে আমরা ‘মিনির মা’ বলব। মিনির মা প্র্যাক্টিকাল। তার ধারণা, সময় কখনও একরকম যায় না—‘ইতিহাস পড়োনি?’ ভোগবাদের যুগ এমন সহজ হওয়ার শিক্ষা মানুষের থেকে আজকাল কেড়ে নিয়েছে। বিদ্যাপতির  মাথুরের পাখি মত্ত হলেও প্রবল বর্ষায় তাকে টেলিকমের তার বাচিয়ে চলতে হত। সংসারে কাজ বেড়েছে। অন্যশহরে থাকা মানুষ এখন বাড়িতে।


কিছু মানুষ অবশ্য বাড়ি ফিরতে পারল না— রাষ্ট্র নাম দিয়েছে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’। ঘরবন্দিতে মেয়েদের ওপর বেড়েছে ‘ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স’। যাকগে, ভাগ্যে বাড়িতে নেটফ্লিক্সটা আছে! শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে স্নান করতে মাঝেমধ্যে মাথার পিছন দিকে, পিঠে ব্যাথা হয়। লকডাউনে শুয়ে-বসে থাকার ফল হবে। বন্ধু থাকলে এদিনের নাম দিত ‘লকডাউন ও কাফকা’র ছারপোকা ইত্যাদি’। ইউনিভার্সিটিতে চাল-ডাল মিলিয়ে রিলিফ ফান্ড গড়া হচ্ছে। সমাজতন্ত্র বলে, উৎপাদনের যন্ত্র ঠিক থাকলে নাকি অভাব ঘুচে যেত, সমবণ্টন। উৎপাদনের যন্ত্র বাড়িতে নাই। প্যারাসিটামল সিক্স-ফিফটি আছে। মাথার ব্যাথাটা বাড়তে পারে তো। 

      

Post a Comment

0 Comments