ব্লগ : দেশান্তর/ ৬ । মহামারি সত্যিই এত অভয় দিয়ে যাবে

মহামারি সত্যিই এত অভয় দিয়ে যাবে

মৌমন মিত্র 


তকাল পরিবারসহ একটু সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছি। বাড়িতে বসে বসে শরীর ও মনে কেমন জঙ ধরতে শুরু করেছে। একটু ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় ঘুরলে যদি মন, মেজাজ খানিকটা নির্ভার করতে পারি। আমার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করলেই একটি স্টেট পার্ক। চার হাজার একর জমির ওপর অবস্থিত এই পার্ক। রামাপো ভ্যালি কাউন্টি রিসার্ভেশান। এই পার্কের একদিকে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের নয়নসুখকর ছোট বড় সরোবর, অন্যদিকে পাহাড়ি উঁচু উঁচু হাইকিং ট্রেইল। গ্রীষ্মে বহুদূর থেকে এখানে পর্যটকরা আসে ফিশিং, ক্যাম্পিং, হাইকিং করতে। এক পাশ দিয়ে ঘন জঙ্গল, অন্যদিকে ঝর্ণার জল আঁচড়ে পড়ছে রামাপো নদীর বুকে।
আজ বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখি পার্কিং লটে আমার গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই। এত ভিড়! দেখে মনে হয় যে, এ যেন মহামারী বর্জিত একটি দ্বীপে এসে পৌঁছেছি। বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করছে না। পিছনের সিটে আমার পুত্র ও কন্যা বসা। ফেরার নাম করলে, অমনি তারাও কান্না ধরবে। কি করা যায়, কি করা যায়— গাড়িতে বসে ভেবে চলেছি। এদিক-ওদিক আর অন্য কোথাও যাওয়া যায় কিনা ভাবতে ভাবতে গুগল ম্যাপ্স খুঁজছি। এমন সময় পাশের গাড়ি থেকে নেমে এলেন অভয়বাবু।
অভয়বাবু আমাদের পাড়ার একজন মূলধারার বিশিষ্ট কবি। বছর দুই আগে আলাপ। পরিচয় হওয়ার পূর্বে শুনেছিলাম তিনি নিউ জার্সির এবং নিউ ইয়র্কের তাবড় তাবড় গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। নামও অভয় গাঙ্গুলি। নিউ জার্সিতে তাঁর দারুণ হাঁকডাক। কলকাতার একটি নামী সংবাদমাধ্যমে একসময় নাকি সাংবাদিকতাও করেছেন। তবে আমি নিজে তখনো তেমন ভাবে তাঁর লেখা পড়িনি। বুঝলাম রণে, বনে, জঙ্গলে অভয় বাবু ঠিক অভয় দেবেন। আচ্ছা, আজকাল বিখ্যাত লোকজনের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি না করলে কী আর সামাজিক বলা যায় নিজেকে?
মৃত বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে সেলফি, টিকটকে টিকটিকির মতো নাচন, ঝরঝরে গালাগাল, মানে গালাগালের এমন বন্যা বইতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন পাঠকরা ভুরু উঁচিয়ে স্মার্ট রাইটিং বলে, নিজে নিজের কাছে মিথ্যের বন্যা বইয়ে দিলেও ব্যাক্তিত্ব এমন হবে যেন সে অত্যন্ত  অকপট মানুষ। আগে সেলফ অ্যাডভোকেসির জন্য বিজ্ঞাপন ছিল, এখন ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রাম।প্রত্যেক মাধ্যমেই তিনি সক্রিয়। এই সময়ের সামাজিক সব কিছুর পারফেক্ট ব্লেন্ড হলেন অভয়বাবু।
রাস্তার ওই পার থেকেই তিনি আমায় দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বলেন, ‘‘এই যে মিসেস মিত্র, পার্কিং যে ফুল!’’


‘‘ফিরে যাব ভাবছি, এত ভিড়ে ঠিক সেফ নয় বেরোনো,’’ আমি জানলার কাঁচ খুলে উঁকি দিয়ে বলতে চাইলাম। অভয়বাবু না ওই পার্কের সকলকে?
আকাশে তখন আলো-আধারি বেশ আধাআধি মিশে আছে। গতকাল, গত পরশু এক ট্রপিকাল ঝড় এসেছিল এই এলাকায়। ট্রাই স্টেটের প্রায় এক হাজারের বেশি পরিবার চব্বিশ ঘন্টা বিদ্যুৎহীন ছিল। আমেরিকার বহু বাড়িতেই রান্না চুল্লিও চলে বিদ্যুতে। তাঁরা এই মহামারিতে, ঝড়ে কী করেছেন? যদি সেই সব পরিবারে খুদে অথবা বৃদ্ধবৃদ্ধা থেকে থাকে? কেমন আছে তারা? এত সব ভাবনা চারিত মনকে কোনও এক ঠিকানা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গুগল ম্যাপ্সে। পাশ থেকে অভয়বাবু আবার বলে উঠলেন, ‘‘আরে এত ভয় পেলে হয় নাকি মিসেস মিত্র! বেরিয়ে পড়তে হয়। নির্ভয়ে। কাজ থামলে চলবে?’’
‘‘এ তো কাজ নয় অভয়বাবু! এখানে তো সবাই বেড়াতে এসেছেন। তাতে এত ভিড়!’’
‘‘ফাঁকা মাঠ পাবেন কোথায়? সকলেই সামার উপভোগ করছেন। মহামারি-টারি এমনিই চলে যাবে, হা হা!’’
বছর দেড়েক আগে আমাদের পাড়ার একটি কিশোরী মেয়ে একজন বৃদ্ধ বাঙ্গালির দ্বারা মলেস্টেড হয়। প্রায় এক বছর ধরে মেয়েটি নিজের কষ্ট নিজের কাছে চেপে রাখে। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে।জানাজানির পর পাড়ার এত কাকু কাকিমা, জ্যাঠা-জ্যাঠাইমারা শুরুতে মাতামাতি করলেও, পরের দিকে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। আমি ছিলাম তখন বিপ্লবী গোছের। মানে বিপ্লবী আমি এখনও। তবে মনে মনে। এখন ছাঁকতে শিখে গিয়েছি, বেশ বুঝ এসে গেছে মনে। বিপ্লব একটা মেটাফর! যা কবিতা লিখতে, কবিকে সফল করতে, হয় ধাক্কা দেয় নয় সাহায্য করে। এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু তখন এমনটা ভাবতে শিখিনি। তখনও নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া শিখিনি। তো সেই বিপ্লবের আশায় একদিন এই অভয়বাবুর দ্বারস্থ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একটি ছোট্ট মেয়ে যদি অভয় পায়, সুবিচারের দ্বারা। জানতে পেরেছিলাম অপরাধী এক বিখ্যাত, ক্ষমতাশীল ব্যাক্তি।ফলে অভয় বাবু আমায় অভয় দিতে পারবেন না। দিলে, তিনিই বিপদে পড়বেন। অভয় বাবু সেদিনও আমার গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে, আমায় বিদায় দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘‘মিসেস মিত্র নো ওয়ারিজ্! মোলেস্টেশন-টোলেস্টেশন এমনি-এমনিই চলে যাবে।’’
সে যাক। এ ধরণের অপরাধ তো দৈনন্দিন সংবাদপত্রেই পাওয়া যায়। যত দিন আমার বাড়ির দরজায় কোনও ক্রাইম কড়া নাড়ছে না, আমি নিশ্চিন্তে ঘরের কেঁদো বাঘ হয়ে দিন যাপন করি।’’
এখন, অপরাধী বেশ দাপিয়ে চলছেন আমাদের আশেপাশে। অভয় বাবুর সঙ্গেও তাঁর বেশ ভাল মেলামেশা। বাকি পাড়া প্রতিবেশীও মেনে ও মানিয়ে নিয়েছেন। সকলেই প্রকৃত অর্থে বিদ্যান। সকলেই থামতে জানেন। তাই সব বিপ্লবই অসময় কাটিয়ে সঠিক সময় থিতু হয়ে যায়। সে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার নামক সর্বকালীন প্রতিবাদ হোক কিংবা পাড়ার-বেপাড়ার মোলেস্টেশন, রেপ জাতীয় বিপ্লব।
সেই অভয়বাবু আজকাল ফেসবুক লাইভ, কোভিড পার্টি, ফান্ড রিলিফ— এই সব সামাজিক কর্মকান্ডের দ্বারা নিজের উত্তরণ ঘটাতে বেশ ব্যাস্ত থাকেন।
এবার আমি অভয়বাবুকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম অন্য আরেকটি পার্কের দিকে। এই ভাবে সারা শহরে প্রায় আধ ঘণ্টা ঘুরে পৌঁছে গেলাম একটি ফাঁকা মাঠে। মাঠটি ঠিক ফাঁকা বলা চলে না। তবে এখানে দূরত্বে থাকা যায়। মানে দৈহিক দূরত্বে। আমার পুত্র কন্যা নিজেদের বাইক বের করে, রাইড করা  শুরু করল। ক’জন শ্বেতাঙ্গ একটু জোর করেই হাসলেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। বোধহয় ওঁদের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। আমিই একমাত্র মাস্ক পরা তো। তাই হয়তো বেমানান লাগছিল আমায়। আমার ধারণা। ওঁদের অব্যাক্ত চাহনি দেখে। মিনিট দশের মধ্যেই দেখি অভয়বাবু আবার এই পার্কে এসে হাজির। এপাশ-অপাশ তাকিয়ে বললেন,
‘‘দেখেছেন মিসেস মিত্র আমেরিকায় সব রকম খেলাধুলো শুরু।’’
‘‘বটে! আর জবলেস যাঁরা? আপনি জানেন ৫.৪ মিলিয়ন  আমেরিকানদের আজ হেলথ ইনস্যুরেন্স নেই? কারণ তাঁদের কাজ নেই? অসুখ কমলে এই সমস্ত থামত না?’’
‘‘সার্বিক ভাবে ভাবুন। কী লড়াই জিতলাম আমরা! দেখছেন তো! আর কী চাই!’’
আর নিজের কণ্ঠরোধ করতে পারছি না। এমনিতেও বড্ড প্রশ্ন করি আমি। বাকস্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে।
‘‘প্রেসিডেন্ট তো বলছেন বিদেশী শিক্ষার্থীদের ভিসা ক্যানসেল করবেন, যদি এই বছর অনলাইন ক্লাস হয়। আর কত লেখাপড়ায় ব্যবসা ঢুকবে অভয়বাবু, এ তো যা খুশি তাই নয় কী?’’
‘‘লেখাপড়া ব্যবসা না হ'লে, আপনার ছেলেপুলে এই পরিকাঠামো পাবেন বলছেন? পরিকাঠামো ঠিক রাখা কী কোনও এক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাত্যহিকতার অঙ্গ নয়?’’
অভয়বাবু বছর চার আগে আমেরিকান সিটিজেন হয়েছেন।আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ছাত্র ছাত্রীদের পরিণতি তাঁকে আর ভাবায় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্যত একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, তিনি এই দেশে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেন। ব্যাস এই তাঁর কাজ।
দূরে, আমার চোখ চলে যায় পুত্রের বাইকের চাকায়। ক্রমাগত ঘুরছে, ঘুরেই চলছে। একনাগাড়ে চলন্ত চাকা দেখলে আমার শরীর গুলিয়ে ওঠে। মাথা ঝিমঝিম করে। নিজেকে সামলে অভয়বাবুকে বললাম, ‘‘এখনও জানি না অভয়বাবু। সিটিজেন হ’লে বিদেশী থাকব না এই দেশীয়। কোনও এক শ্রেণীর মানুষের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের অন্যায় খণ্ডদর্শন করব কিনা, তা এখনো জানি না।’’
নাগরিক হলে নাগরিকের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট ভাবে নির্ভয়ে তুলে ধরা কী সত্যিই ভুলে যাব আমি? সেই ভীতিটিকেই কী সার্বজনীন করে তুলছে আমেরিকার শাসক?

আমার সান্ধ্য ভ্রমণ শেষ হল। ভাগ্যিস একটু ফাঁকা জমিতে স্বাধীন ভাবে ওরা খেলতে পারল ভাইবোনে। ওদের গাড়ির ভিতর তুলে অভয়বাবুকে হাত নাড়িয়ে আমি স্টার্ট দিলাম। ব্রেক চেপে যত পিছোতে থাকি,অভয়বাবু তত দূরে সরছেন। আস্তে আস্তে চোখের সামনে মিলিয়ে গেল মাঠটা। মাঠে খেলতে থাকা ছোট ছোট ছেলেরা, ওই পার্কের অসংখ্য গাড়ি, অভয়বাবু— সকলে মিশে গেল দূরের দিগ্বলয়ে।
আমি গাড়ির রেডিও অন করলাম। এখন আর আকাশবাণী শুনতে পাই না। তবে ছোটবেলায় এত শুনেছি যে, সন্তানদের এফ এম ফুঁড়েও আকাশের বাণী ঠিক কানে আসে। মাঝে মধ্যেই। আজ যেমন আসছে। দিকচক্রবালের বার্তা।
মহামারি নাকি থেকে যাবে। অভয় দিচ্ছে মনোদিগন্ত। বলছে, ভাইরাসের চিকিৎসা হয় না। লাগে পরিকাঠামো। ভাইরাসের প্রতিষেধক চটজলদি আসে না। আসলেও তা বছর বছর বদলাতে থাকে। অনেকটা ওই দিগন্তের মতো। অনিশ্চিত। অদেখা। তাই  নিজেকে অনাক্রম্য করতে হবে… বলতে বলতে সে শব্দরা মিলিয়ে গেল। ঘূর্ণির মতো, চক্রাকারে।
আমার পাড়ার যেই কিশোরীর কথা বলেছি, গাড়ি থেকে নেমে দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে। তাই না? বড্ড ঝাপসা দেখাচ্ছে চারিধার! ওর ছেলেমানুষি মুখটাই যেন বার বার ভেসে উঠছে আমার চোখের সামনে। ও খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ানো, মৃদু অনুযোগে। আজকাল ও ঝুঁকেই থাকে। ওকে বললাম, ‘‘অভয় দিতে চাই তোকে, ভাইরাস গেলেই সবাই সুস্থ হবে, তুই নিজের চিন আপ করে দাঁড়াবি আবার। খুব শিগ্রী।”
ও এক ছুট্টে কোথায় মিলিয়ে গেল! হরিণ পায়ে। আমি প্রশ্ন করার আগেই কোথায় যে চলে গেল মেয়েটা! ওর কাছে কত প্রশ্ন আমার! ‘‘কি রে? ভাল আছিস তো? এটুকু বলে যা আমায়।’’
পাখির মতো এবার ডানা ঝাপটে মিলিয়ে যাচ্ছে আজ সন্ধের সব চরিত্ররা! ‘সোনার খাঁচায়’ কেউ যেন আর ‘রইল না’। মহামারি কী সত্যিই আমাদের এত অভয় দিয়ে যাবে? জীবনের সত্যাসত্য নির্ধারণের? 

Post a Comment

0 Comments