ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ২ । লকডাউন ক্রমেই লকআউট


লকডাউন ক্রমেই লকআউট

তড়িৎ রায় চৌধুরী

কডাউনটা ক্রমেই লকআউট হয়ে উঠছে অলকেশ।
আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য আর সুরক্ষার স্বার্থে
উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে একদল মানুষ।
উন্মাদের পাঠক্রমে লকডাউন ক্রমেই লকআউট হয়ে যাচ্ছে অলকেশ।

একে একে সবাই ছাড়া পেল— বাজার-হাট-অফিস-আদালত-ধর্মস্থান-শপিংমল। আনলক যখন শুরু হল তখন রোজকার আক্রান্ত দশ হাজার; এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের মুখে প্রায় বিশ হাজার। জীবন তবুও বেগবান।
অর্থনীতি চাঙ্গা করতে আমরা মদ্যপদের ও ভরসা করেছি কিন্তু জ্ঞানচর্চার জন্য বিদ্যার্থীদের না। শুধু ছোটদের না ১৪/১৫ বছর এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরকেও না। তারা বিজ্ঞান পড়ে ; তারা নিয়ম শৃঙ্খলার মূল্য বোঝে; ভবিষ্যতের যোগ্যতর নাগরিক হয়ে উঠবে আশা রাখি তবু তারা বিপর্যয়ে ততটা ভরসা যোগ্য নয়! আশ্চর্য! হয়তো বা জীবনের অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় এতটাই দূরস্থানে শিক্ষা। অথবা শিক্ষাচর্চার ক্ষেত্রে সামাজিক মনে এতটাই মূল্যহীন বিদ্যায়তনের ভূমিকা।
অথচ ভাইরাস অধ্যুষিত ভারতে বেঁচে থাকার নতুন রীতি চর্চার কেন্দ্র কি হতে পারত না বিদ্যায়তনিক গোষ্ঠীজীবন? অসম্ভব ছিল পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সংগতি রক্ষার উপায় উদ্ভাবন? হয়তো বদ্ধ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হত, হয়তো গাড়ির মতো জোড়-বিজোড় নম্বরে উপস্থিত হত বিদ্যার্থীদল, হয়তো একই পাঠ চর্চা চলত একাধিক বার দলে উপদলে। নতুন নতুন পথ  অনুসন্ধানে না হয় দীর্ঘদিনের সিলেবাসীয় জটাজাল ছেড়ে আর একটু সৃজনশীল হতেন বড়রা।
এই সমস্ত প্রস্তাবের উত্তর হিসেবে এল অনলাইন ক্লাস। আদতে যা এদেশে আন্তর্জাতিক বিপর্যয়ের মুখে অজুহাত স্যানিটাইজারে হাত ধুয়ে ফেলবার পদ্ধতি মাত্র। বিদেশি উদাহরণ বাতুলতা কারণ আমাদের পরিকাঠামোর অভাব ও প্রস্তুতিহীনতা। যে কারণে বহু কোম্পানির নমুনা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন অফিস না চালিয়ে আমরা হাজিরার খাতা খুলেছি।
মাত্রাগত বিচার বাদ দিয়ে পরিমাণগত দিক থেকেও এদেশে অনলাইন ক্লাসে নিয়মিত সংযুক্তের হার ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি নয়।
সুশান্তের অবসাদ-মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে আমাদের  নেপোটিজমের বাণে বিধ্বস্ত বহু মহারথী।আচ্ছা, শিবানী সাউ বা তার মতো আত্মহত্যাকারীদের অবসাদের কারণ কি? খবর বলছে অনলাইন ক্লাস না করতে পারা। এ অবসাদ কতদিনের? সেটা কি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন নাকি তাৎক্ষণিক উদ্বেগের হঠকারিতা? আমরা জানি  না। কেননা শরীরের অস্ত্বিস্ত রক্ষার লড়াইটাই সেখানে এত প্রবল মনের খোঁজ রাখে কে? এটাই আমাদের বাস্তবতা। শরীরের চাহিদা শেষ হলে আমরা মনের খোঁজ নিতে যাই।
তো এসব আত্মধংস্বের ধাক্কা কোথায় গিয়ে লাগে? ভিলেন হয়ে ওঠে অনলাইন ক্লাসের বঞ্চনা  আর সরকার।



কিন্তু বঞ্চনা তো পৃথিবীর জন্ম-জরুল। মানুষে মন আর মস্তিষ্কের বাইরে সাম্যাবস্থা এ পৃথিবীতে ছিল বা হবে কোনদিন? এতটা অন্ধ আশাবাদ কি ভালো পৃথিবীর স্বাস্থ্যের পক্ষে? এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তো আদ্যন্তই অসাম্য। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামোটাই পিরামিডের মতো। যতগুলো প্রাথমিক স্কুল আছে তত হাইস্কুল নেই; কলেজের সংখ্যা আরো কম। ক্রমে বৃত্ত ছোট হয়ে আসে। সুতরাং যত ভালো পড়াশোনাই করুক না কেন রাজরক্ত বা অভিজাততন্ত্র  নির্ভর এদেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল বাচ্চার জন্য সমানাধিকার নেহাৎ কল্প-গল্প মাত্র। হ্যাঁ প্রথাগত বিদ্যালয় ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় কিছু বৈষম্যকে কমানো গেছে। স্কুল থেকে বই দিয়েছে, জামা দিয়েছে, এখন দুপুরের খাবার অব্দি দিচ্ছে। যা অনলাইন ক্লাস দেয় না।


কিন্তু এই কি আমাদের একমাত্র সংকট?
চটজলদি সুরাহা হিসেবে এসেছে বলেই অনলাইন ক্লাস এতটা কাছাখোলা। কিন্তু সময় পেলেই সে নিজেকে গুছিয়ে ফেলবে। বই- খাতা জামা-কাপড়, দুপুরের খাবারের বদলে একটা করে মোবাইল ধরিয়ে দেওয়া তো অসম্ভব নয়।
কিন্তু মানবিক উষ্ণতা?
কাঠকয়লার উনুনের বিশেষ কিছু স্বাদু রান্না আমরা হারিয়েছি তবু আধুনিক রান্নাঘরে তাকে ফেরানো সম্ভব নয় আর। সেভাবেই অনলাইন ক্লাস ক্রমশ বিদ্যায়তনিক পরিকাঠামোকেই পাল্টে দিতে যাচ্ছে না তো? দীক্ষা দানের ক্লাস ভিত্তিক টি.ভি চ্যানেল বা এরকম সার্বিক নিয়ন্ত্রণ যোগ্য দূরমাধ্যম যদি চালু করা যায় ব্যাবসার দিক থেকে সুবিধা বিস্তর। শ্রমিকের(বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত নানা স্তরের মানুষজন) যোগান অতি অল্প হলেও চলবে।রাষ্ট্র ক্ষমতার মর্জি মাফিক ভবিষ্যৎ নাগরিক নির্মাণও সহজ কেন না তখন ব্যাখ্যাকারদের ব্যাক্তিগত সরন-প্রতিসরনও কিছুই থাকবে না। প্রাচীন পাঠশালা ছিল গুরু কেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথ  বলেছেন আশ্রমের কেন্দ্রে দেখেছি গুরু কে। আমরা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বহুদিন থেকেই গুরু কে প্রতিস্থাপিত করেছি গ্রন্থ দিয়ে। এখন ডিজিটাল করে দিলে সব ল্যাঠাই চোকে।
ফলে করোনা কালে যেমন সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে...মনুষ্যত্বের এই অবনমন; অবিশ্বাসের এই সমর্থন যোগ্যতা যেমন দীর্ঘ স্থায়ী অসুখের মতো মানবসমাজে থেকে যাবে তেমনি করোনা পরবর্তী শিক্ষা জগৎ থেকে মানবিক উষ্ণতা হ্রাস পাওয়াই প্রধান সংকট বলে মনে হয়। স্পর্শ  সান্নিধ্য যে একটা প্রাণশক্তি কে জাগরিত করে, গন্ধ যে স্নায়ু উদ্দীপক আমরা ভুলে যাব সেসব কথা?
পারস্পরিক উষ্ণতার পরিবর্তে কতগুলো নিষ্প্রাণ উপাদান মুখ্য হয়ে উঠবে? মনে হবে কয়েকটা ক্লাস মিস করলে জীবনের আর কোনও মূল্য রইল না!ভুলে যাব ক্লাস করে ভাল ফল করলেও হতাশা বধ করা এই সমাজব্যবস্থায় সহজ নয়।"পাশ ফেল" গল্প শুধু আমাদের সিলেবাসেই থেকে যাবে; উপলব্ধিতে নয়?
একটা ভাইরাসের ভয়ে আমরা সিটিয়ে গেছি। সতর্কতা  আর সিরিয়ে যাওয়া তো এক নয়। যদি সবই বন্ধ রাখতাম তো সন্দেহ হতো না কিন্তু সবাই মুক্ত শুধু শিক্ষাকেন্দ্র স্তব্ধ। এ বড় সুখের সময় নয়।
দীর্ঘদিন কারখানায় ধর্মঘট চলার পর একদিন শ্রমিকরা গিয়ে দেখত মালিকই লকআউট ঘোষণা করে দিয়েছে। টান মারো খেলা ঘুরবে। জনমানসে ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে বিদ্যালয়, নির্ভরতা কমছে তার প্রতি। যে প্রতিষ্ঠান বির্পযয়ে বাঁচতে শেখায় না মানুষ তাকে ভরসা করতে ভুলে যায়। এই এক সর্বনাশ এসে উপস্থিত। যাপন ছন্দ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে স্কুলবেলা।
আসলে দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা....আমরাই দুর্বল করছি আমাদের। পৃথিবী রোজ পাল্টে যাচ্ছে নিত্যনতুন উদ্ভাবনে। সেই সৃজন শক্তির চর্চা করি না, শুধু বহন করে চলি...তল্পিবাহক... সভ্য ভদ্র এক শ্রমসর্বস্বতা,মুখস্থ প্রবণতা।মেধাহীন বোধহীন রক্তকরবীর ব্যাঙ। যে শুধু টিকে থাকতে জানে।IQ মেপেছি চিরকাল EQ,SQ,AQ -এর খবর পর্যন্ত রাখিনি। ভুলে যাই বদমায়েশি করার বুদ্ধি,সাহস,স্পর্ধা  যার নেই সে পৃথিবী কে নতুন কিছু দেবে কোন সম্পদের জোরে? যে মান্যতার শর্তে অন্য কে খুশি করতে পারে কিন্তু বেয়ারা প্রশ্ন বাণে পর্যুদস্ত করতে পারে না;নিত্য পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তার জায়গা কোথায়? নিশ্চয় আমরা চাই না বাধ্য ভদ্র বিনয়ী কেরানী একা একা অনলাইন ক্লাস করুক।কম্পিউটারের সামনে বসে থাকুক আর এক যন্ত্রগণক।



Post a Comment

0 Comments