ব্লগ : দেশান্তর/ ৭ । ছায়া ঘনাইছে মনে মনে

ছায়া ঘনাইছে মনে মনে 

মৌমন মিত্র


জীবনের সূক্ষ্ম বিচারশক্তি অনেক সময় মনকে ভারাক্রান্ত করে। তারপর ভাবি, মন ভার করব কিনা। এক পা এগিয়ে চলি, তারপর পাঁচ পা পিছোলে পিছলে পড়ব না তো? প্রতিদিন দু'বেলা বাবা আমায় নিয়মিত টেক্সট করে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা ভাল আছ তো?’  যে উত্তরটা বাবা দৈনন্দিন ফোনের ওপার থেকে শুনতে চায়, সেই উত্তরের যোগান দিতে এপারে আমার নাজেহাল অবস্থা। বলতে চাইছি, ভাল থাকার যোগান জীবনের কী বিস্ময়কর উপকরণ!
নিউ জার্সির করোনা সংক্রমণ পুনরায় উর্দ্ধগামী। এবং সারা মার্কিন দেশ জুড়ে, গড়ে ৭৩০০০ জনের বেশি সংখ্যক মানুষ দৈনন্দিন এখন করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে। সেদিন কোথাও একটা পড়ছিলাম, এক পেন্সিল্ভেনিয়ার বান্ধবী তার নিউ জার্সির বান্ধবীকে কাদা ছুঁড়ছে নিউ জার্সির সংক্রমণ সংখ্যা নিয়ে, আবার নিউ জার্সির বান্ধবী কাদা ছুড়ছে ফ্লোরিডার বান্ধবীর দিকে। তাদের সংক্রমণের হার নিয়ে। ওদিক থেকে সিয়াটেলের একজন ফুট কাটল নিউ ইয়র্ক শহর নিয়ে। তার নিউ ইয়র্ক বাসিন্দা বান্ধবীর দিকে। এরা সকলেই বাঙালি। আচ্ছা, আমাদের কী হয়েছে বলতে পারেন? পরবাসের রাজ্য নিয়ে এত মাতামাতি কীসের? আর যদি ধরে নিই, এই পৃথিবীই আমার ঘর, তাহলে বিভিন্ন রাজ্যের এত ভেদাভেদ কীসের? তাও আবার এই মহামারিতে?


সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে বস্তু খুব খতিয়ে দেখলে চোখে পড়ে, তা হল ব্যাক্তিক সহমর্মিতার অভাব। আমরা এখন আমার রাজ্য, আমার পরিবার, আমাদের ‘আমি সিন্ড্রোম’— এই আটকে রয়েছি। আমার জন্মদিন, আমার সন্তানের জন্মদিনের পার্টি, আমার বার-বি-কিউ পার্টি, আমার কাউন্টি, আমার রাজ্য বেসড সংক্রমণ। এরপর আসা যাক প্রাতিষ্ঠানিক সহমর্মিতার কথায়। আমেরিকার প্রাথমিক দর্শনে আপনার যা চোখে পড়বে তা হল, এঁদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। নিখুঁত, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এখানে ভাববার বিষয় হল, কোন পরিস্থিতিতে এঁদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অতুলনীয়? এঁরা সর্বসেরা, যখন আপনার সঠিক স্বাস্থ্য বীমা করা রয়েছে, এবং আপনি তার বিল পেমেন্ট করতে আর্থিক ভাবে সক্ষম। এছাড়া জনসংখ্যা যখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আজ যে বা যাঁরা কলকাতার স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা নিয়ে সমালোচক, তাঁরা কী আদৌ জানেন আমেরিকার মতো একটা উন্নত দেশ করোনার বিপুল সংখ্যক মৃতজনদের কী পরিকাঠামো দিতে পারছেন বা পেরেছেন এই মহামারিতে? কেমন ছিল এই দেশের লড়াইটা? জীবনের দীর্ঘ পাঁচ বছর নিজের মা-কে নিয়ে আমি কলকাতার বেশ কিছু নামী সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেছি। দৈনন্দিন, পাঁচ ছ’ঘণ্টা করে। নব্বই দশকের সরকার ব্যাবস্থায় কলিকাতা শহর যেখানে দাঁড়িয়েছিল, আজও শহরের সেই একি অবস্থানের খবর পাই। হয়তো ২০২১-র নির্বাচনের পরবর্তীকালে অন্য সরকার এসে আগামী কোনও সুদিনের প্রশাসনিক ভিত তৈরি করবেন। জানি না, তবে প্রাতিষ্ঠানিক নির্মমতা কিংবা সহমর্মিতার অভাব, এই দেশের মহামারির লড়াই, সেই এক রকম নগ্নতায় চোখে ধরা দেয়। কয়েক শো মৃতদেহ একটি নার্সিং হোমের বেসমেন্টে রাখা ছিল, আড়ালে। দুর্গন্ধ বার হতে, সাফাইকর্মীরা খোঁজ শুরু করে। এরপর মৃত দেহগুলির কোনওরকমে সৎকার করা হয়। নিউ জার্সির একটি হাসপাতালের দৃশ্য। মাস দুই আগের পরিস্থিতির। ব্রুকলীনের মর্গের সামনে শয়ে শয়ে মৃতদেহ রেফ্রিজারেটেড ট্রাকে পড়ে থেকেছে দিনের পর দিন। মৃতদেহের দুর্গন্ধে পাড়াপড়শি পুলিশকে খবর দিয়েছেন। পুলিশ এসে সেই সমস্ত মৃতদেহের সৎকার ব্যবস্থা করেন। এই মুহূর্তে টেক্সাসের চিত্রও খানিকটা একই রকম। মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া যায় সেখানে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনা নিন্দনীয় হ’লে মানুষের অন্য রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে, কাউকে সরকার পশ্চিমবঙ্গে থাকতে বাধ্য করেননি। তবে বিশ্বাস করুন, এই গোটা মহাদেশের মানুষ এক জটিল স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার যন্ত্রণায় ভোগে। যা অপ্রকাশ্য রয়ে যায় মহাদেশটি উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বলে।
প্রতিবার এক একটা ঘটনা, এবং তার প্রতিক্রিয়া ঘিরে নিজের শ্বাসবায়ু পতনের সময়, চমকে উঠি নিজেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইদানিং দেওয়ালে দেওয়ালে ভয়ানক ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের ট্রোলিং লেখা পড়ি। প্রতিবাদের ভাষায় মনে হয়, এখনই সারা বিশ্বে আগুন জ্বলে উঠবে, কোনও রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়া কী পাড়ার বাবলু দা’র চা দোকানের জমাটি আড্ডার বেটার ভারশান? নেগেটিভ পাবলিসিটিও একজনকে বিখ্যাত করতে পারে। মিম তৈরি হলেও আপনি খবরে আছেন, আজকের দুনিয়ায় এটাই হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে পরিচিতি যে ক্ষণস্থায়ী তা সময় বলে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে ঠিকই, তবে যে মানুষটি আমাদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়া প্রবেশ করার বহু যুগ আগে থেকে নিজের বাকস্বাধীনতাকে মর্যাদা দিয়েছেন, সেই ভারাভারা রাও— কে নিয়ে আজ অবধি কোনও কবির দেওয়ালে এক বর্ণ লেখা পাইনি। কেন? তিনি বৃদ্ধ বলে? জীবনের শেষ পর্যায় লড়াই করছেন বলে? কবি ভারাভারা রাও সমাজের জন্য কোনও সদর্থক বার্তা দেননি? নাকি তাঁর বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে ট্রোল করলে রাতারাতি টাইমলাইনে লাইক, শেয়ারের বন্যা বয়ে যায়?
জীবাণুও জীবনধারণের কন্যাণ করে যায়। আমিও কী ভারাভারা রাও-কে নিয়ে এইটুকু সরব হতাম? ২০১৮ সালে যখন পুনরায় তাঁকে কারাগার বন্দি করা হয়, আমিও কী এক কলম লিখতে পারতাম না? এখন লিখছি। কারণ হয়তো তিনি করোনায় আক্রান্ত বলেই, ইদানিং নিউজে অল্পবিস্তর বিচরণ করছেন।
আমি এখন ফিরব। আমার নিজের আয়নায়, কোনও এক শনিবারের বিকেলে। আকাশে ঘুম ঘুম একটা মেঘ। প্রিয়া সিনেমার সামনে লাইনে আমি আর ও দাঁড়ানো। সেদিন অফিস থেকে মিটিং সেরে বেরোতে আমার দেরি হয়েছে, ও তো রেগে আগুন! ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ সিনেমা। একটা সিন্ও মিস করা চলে! হলের ভেতর অন্ধকারে হাতে হাত রাখতেই নিমেষে মানভঞ্জন। বাড়ি ফিরে দু’কাপ চায়ে দু’জনে-দুজনকে চাই। মনে মনে। এই মহামারীর বিশ্বে গ্লাভস, টুপি, মাস্ক পরে সমুদ্রতট ভ্রমণ কিংবা খাড়াই পাহাড়ের গায়ে উঠে ছবি তুলে ফেসবুকের স্টেটাস কিউও-র তুলনায় এই ফিরে যাওয়া আমার কাছে ঢের রোমাঞ্চকর। তখন তো সোশ্যাল মিডিয়া নেই। তবু যে শেষ পর্যন্ত ওকে চাই সেই গড়ার কথা, সেই গোড়ার কথা— সব ক্লিক করা রয়েছে মনের অন্তরালে। হয়তো সে-সব সময় মহামারি হলে, সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক এই দশার এত দুর্দশা হত না। জানি না ...হয়তো।
এত সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি আমার ডেস্কের ওপর রাখা পরুষালী ছাঁদের ইংরেজি অক্ষরে লেখা একটি লিফাফা। তার ভিতর একটি চিঠিতে লেখা কিছু ইংরেজি বাক্য। যার বাংলায় অর্থ হল এই যে, ‘‘মহামারি পুল্ড টেস্টিং কিংবা অতি-বিজ্ঞানও থামাতে পারবে না। কারণ মহামারি আমাদের মনে। তাই প্রসঙ্গত আমরা নিঃসঙ্গ। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ প্রশাসন, ফুলে ফেঁপে উঠে ভর করেছে অক্ষত কালিমার শীর্ষ স্থানে। সেখানে লাল, নীল, সবুজ, গেরুয়া,গাঢ় লাল— সব রং,রংমশালের আগুনে পুড়ে ধিক্কার দেবে ক্ষুদা, তৃষ্ণা, ছাদ ও শিক্ষাঙ্গনের আগ্নেয়গিরিকে। আমাকে ততোদিন টিকে থাকতে হবে কাঁচা- হলুদ জল খেয়ে। পক্ষপাত সয়ে, কবি হয়ে, স্বার্থসীমার ব্যাধিগ্রস্ত গাঢ় নীলচে অতলান্তিক সাগর অথবা বঙ্গোপসাগরে।
ততদিন আমি রোজ আসব, হঠাৎ একটা কান্না হয়ে, কারণ অনেক কান্না জমা আছে এই জটিল মনে। সন? লেখা থাকবে ভোর এবং মাঝরাতের কোনও একটা সময় ধরে। এই দুই সময়েই নিজের ব্যাধি গুলো বড্ড বেশি নিজেকে গ্রাস করে। যার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ছবি আপলোডেড থাকে না। তখনই উঁকি দেব এই পাথুরে সভ্যতায়।
আমি ড্রপলেট বাহিত। তাই আমার কোনও জাতীয়তার ধ্বজা কিংবা বেড়াজাল নেই। আমি সংক্রমিত, মনে মনে। ব্যাধির কুড়িতে… কে যেন লিখে গেছেন, ছায়া ঘনিয়ে আসা এই মনে মনে...!

Post a Comment

0 Comments