ব্লগ : হ্যালো হান্ড্রেড/ ৪ । বশির গেমায়েল হত্যাকান্ড

বশির গেমায়েল হত্যাকান্ড 

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য


১১মার্চ ১৯৭৮। ভূমধ্যসাগরের তীরে ইসরায়েলের সৈকতে শুধু সীগাল পাখির ডাক। কর্কশ। সৈকতে দুটো হাওয়া ভরা রবারের ডিঙ্গি করে এগারোজন প্যালেস্তিনীয় গেরিলা নামল। তাঁরা লেবাননের দিক থেকে এল। ডিঙ্গি ভর্তি একে ৪৭, গ্রেনেড আর টিএনটি বিস্ফোরক নিয়ে।
পক্ষীপ্রেমী গেইল রুবিন সীগালের ছবি তুলছিলেন এক মনে। হঠাৎ একটা বুলেট তাঁর মাথা ফুঁড়ে চলে যায়। বালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়েন তিনি। বালুকাবেলা রক্তিম হয়ে ওঠে। জঙ্গিরা সৈকত থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে হাইওয়েতে গিয়ে ওঠে। হাইফা-তেল আবিব সৈকত সড়কটি ইসরায়েলের প্রধান সংযোগকারী রাস্তা। উত্তর থেক দক্ষিণে গেছে।
হাইওয়েতে উঠেই তাঁরা কয়েকটি চলতি গাড়ির ওপর এলোপাথাড়ি গুলি চালালো। দুটো পিকনিক পার্টির বাস থামিয়ে একটাকে প্যাসেঞ্জার সমেত জিম্মি করল। হোসটেজ্‌। তারপর বাসটিতে চড়ে দক্ষিণ অভিমুখে রওনা দিল। ততক্ষণে হাইওয়ে প্যাট্রল এসে গেছে। তাঁরা বাসটির পেছু নিল, কিন্তু গুলি চালালো না। পাছে প্যাসেঞ্জারদের লেগে যায়। উল্টে তাদের দিকে জঙ্গিরা কিছুক্ষণ অন্তর গুলি ছুড়তে ছুড়তে চলল। প্যাট্রল গাড়িগুলো একটু দূরে দূরে চলল।
তেল আবিব শহরে ঢোকার উত্তর মুখে, গ্লিলট্‌ জংশনে পুলিশ ততক্ষণে রোড ব্যারিয়ার ইত্যাদি দিয়ে রাস্তা অবরুদ্ধ করেছে। বাসটা কাছে আসতেই গুলি ছুঁড়ে তাঁর টায়ারগুলো ফাটিয়ে দেওয়া হল। স্নাইপাররা জঙ্গিরা যেসব জানালা দিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল, তাদের একে একে মারতে লাগল। হঠাৎ একটা গ্রেনেড ফেটে বাসে আগুন লেগে গেল। তারপর সব নিশ্চুপ। শুধু আগুনে কড়কড় করে বাস পোড়ার শব্দ ছাড়া।
ফায়ার ব্রিগেড কাছেই ছিল। তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আগুন নেভার পর ন’জন জঙ্গি ও ৩৭জন নাগরিকের দেহ উদ্ধার করা হল। যারা বেঁচে ছিল, তাদের অবস্থাও সঙ্গিন।
এই জঙ্গিহানা ইসরায়েলের পক্ষে অস্বস্তিকর। এর আগে কোনও হানাদার দেশের প্রধান সড়কে হামলা চালায়নি। ইসরায়েল-লেবানন সম্পর্ক তলানীতে পৌঁছায়।



এর ফলাফল? ‘অপারেশন লিতানি’। জঙ্গিহানার পাঁচ দিন পরেই ৭০০০ ইসরায়েলি সেনা লেবাননের লিতানি নদী অবধি পৌঁছে যায়। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল যে সেনারা লেবাননের দশ কিলোমিটার অবধি ঢুকে প্যালেস্থিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) ক্যাম্পগুলো ধ্বংস করে দেওয়া। তারপর এলাকার দখল ইসরায়েলের মদতপুষ্ট খ্রিষ্টান্দের ফ্রি লেবানিজ আর্মির (এফেলএ) মেজর সাদ হাদাদের হাতে ন্যস্ত করা। কিন্তু অপারেশন এত সুষ্ঠভাবে চলে যে ইসরায়েলের সেনারা লিতানি নদী অব্ধি বহুদূর পৌঁছে যায়। ইসরায়েলি হানার ফলে পিএলওর কর্মকান্ড আম্মান আর জর্ডান নদী এলাকা থেকে সরে বেইরুট ও দক্ষিণ লেবাননে স্থানান্তরিত হয়।
এই ঝামেলার সূত্রপাত এক দশক আগে। ১৯৭০এ লেবাননে গৃহযুদ্ধ লাগে। ইসরায়েল সে সময় ফ্যালাঞ্জ পার্টিকে সমর্থন করে। ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরে রাজা হুসেনের সেনারা জর্ডনে প্যালেস্তিনীয়দের পরাজিত করে। পিএলও তাদের সদর দফতর বেইরুটে স্থানান্তরিত করে এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি রাষ্ট্রের স্থাপনা করেন। এতে লেবাননের সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। খ্রিষ্টান-প্রধান ফ্যালাঞ্জ পার্টি বনাম মুসলিম-বামপন্থী-শিয়া জোট। ১৯৭৬ নাগাদ ফ্যালাঞ্জরা ক্রমশ হেরে যাচ্ছিল। এই সময় ফ্যালাঞ্জ পার্টির আবু হালিল ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইটজ্যাক রাবিনের কাছে সাহায্য চায়। রাবিন তাঁর বিশ্বস্ত দুজনকে পাঠায় ফ্যালাঞ্জ পার্টির নেতাদ্বয় ও দুই ভাই বশির ও আমিন গেমায়েলের সঙ্গে দেখা করতে।
সেই বছর সিরিয়া লেবানন আক্রমন করে। ইসরায়েল আর হাত গুটিয়ে থাকতে পারল না। ফ্যালাঞ্জ পার্টি কর্মীদের জন্য অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল ও পুরনো শারমান ট্যাঙ্ক পাঠায় লেবাননের জৌনিয়েহ-তে। মোসাদ অধিকর্তা ডেভিড কিম্‌চে খ্রিষ্টান তথা ফ্যালাঞ্জ পার্টির সঙ্গে মধ্যস্থতা করছিলেন। গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বেশ কয়েক বছর থাকে।


১৯৮২তে বশির গেমায়েল ইসরায়েলের কাছে সরাসরি হস্তক্ষেপ চান। মোসাদ তাতে সায় দেয়। ৬ জুন, ১৯৮২তে ইসরায়েলি সেনা সীমান্ত পেরিয়ে লেবানন ঢোকে। তাঁরা ৮ তারিখের মধ্যেই সিরিয়ার সেনাদের একদম পশ্চিমে ঠেলে দেয়।
সিরিয়ার মিসাইল্গুলির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় ৯ জুন। দুপুর ২টোর সময় শুরু হওয়া এই অভিযান বিকেল ৪.১৫-র মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ভূমি থেকে ভূমি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র ও তাদের বিমান বাহিনী সিরীয়দের গুঁড়িয়ে দেয়। সিরিয়ার ৫০টি বিমান ধ্বংস হয়। ইসরায়েলের কোনও ক্ষয়ক্ষতি ছিল না।
বেইরুট থেকে পিএলও উৎখাতের দুদিন পরে, ২৩ অগস্ট ১৯৮২, ইসরায়েলের সমর্থনে বশির গেমায়েল লেবাননের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। ১২ সেপ্টেম্বর তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারণের সঙ্গে দেখা করেন। শ্যারণ বলেন যে এবার ফ্যালাঞ্জ পার্টি আর লেবাননের সেনাবাহিনীর উচিত পশ্চিম বেইরুট থেকে টিকে থাকা কিছু পিএলও-কেও নিকেশ করা। গেমায়েল তাতে সায় দেন এবং বলেন যে তিনি ওই এলাকায় একটি বিশাল চিড়িয়াখানা বানাবেন। ক্রমেই গেমায়েল সিরীয়দের চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন। তাঁরা গেমায়েলকে চিরতরে সরিয়ে দিতে সচেষ্ট হলেন। সিরিয়ান ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি)এই ব্যাপারে উঠে পড়ে লাগলেন। এসএনপির গুপ্ত সদস্য হাবিব শারতৌনিকে কাজে লাগানো হল। তাঁকে কোড মেসেজে পরিকল্পনা পাঠানো হল। সে বেইরুটের আস্রাফিয়া ডিস্ট্রিক্টে যায়, যেখানে ফ্যালাঞ্জ পার্টির সদরদফতর অবস্থিত। সেই বাড়ির চারতলায় শারতৌনির বোন থাকত।
১৩ সেপ্টেম্বর সকালে সেই চারতলায় শারতৌনি ৩০০ কেজির একটা বোম নিয়ে যায়, আসবাবপত্র নিয়ে যাওয়ার অছিলায়। ব্রেকফাস্ট করে সে তাঁর বোন ও বাচ্চাদের সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয়। বোমাটি সেট করে এবং তারপর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে নেমে যায়। কিছুক্ষণ রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে শারতৌনি একটা খবরের কাগজ কিনে কাছের একটি বিল্ডিঙয়ের ছাদে ওঠে। এখান থেকে ফ্যালাঞ্জের সদর দফতর ভালোভাবে দেখা যায়। সে তাঁর হাতে খবরের কাগজের আড়ালে রাখা রিমোট কন্ট্রোল ট্রান্সমিটারটিতে হাত বোলায়। অপেক্ষা করে। পলকহীন।
বশির গেমায়েল পার্টি সদর দফতরে পৌঁছান দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে দেখার জন্য সদস্যরা উদ্গ্রীব। সমবেত কলরোল ধ্বনিত হয় বশির বক্তব্য দিতে উঠে দাঁড়ালে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল চারটে দশ। বশির গেমায়েল তাঁর বক্তব্যের মাঝপথে। শারতৌনি তাঁর রিমোটের বোতামে চাপ দেন। একটা গগনভেদী বিস্ফোরণ। চিৎকার। পুরো এলাকাটি ধুলোয় ঢেকে যায়। ফ্যালাঞ্জ সদর দফতরটি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ২৭জন ফ্যালাঞ্জ সদস্য মারা যান ও ৩৭জন গুরুতর আহত হন।
প্রথম দিকে খবর চাউর হয় যে বশির পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এসেছিলেন ও অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যান। হাসপাতাল থেকে এই ব্যাপারে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়। সামরিক গোয়েন্দা দফতরের প্রধান জনি আব্দু জানান যে বশিরকে হেলিকপ্টারে করে হাইফাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ঘটনার সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পরে একজন মোসাদ এজেন্ট বশিরের দেহ সনাক্ত করেন একটি চার্চে। ঘটনাস্থলের অদূরে এই চার্চেই প্রাথমিকভাবে নিহতদের স্থানান্তরিত করা হয়। বশিরের মুখ উড়ে গেছিল। তাঁর আঙুলে হোয়াইট-গোল্ডের বিয়ের আংটি আর জামার পকেটে রাখা তাঁকে উদ্দেশ্য করে দুটি চিঠি এই শনাক্তকরণে সাহায্য করে।
শারতৌনি নিজে ছিলেন মেরোনীয় খ্রিস্টান। ঘটনার পরেই সে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারে সে হামলার কথা কবুল করে ও বলে যে বশির গেমায়েল দেশটাকে ইসরায়েলের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ৩৪ বছর বয়সে মারা যাওয়া বশির গেমায়েল ছিল সেদেশের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি এবং লেবাননের ইতিহাসে অন্যতম দক্ষ ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব।

(লেখক কলকাতা পুলিশের ডিসি পদমর্যাদায় কর্মরত)

Post a Comment

0 Comments