ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ৫ । বর্ষা ঘন ঘোর


বর্ষা ঘন ঘোর

তড়িৎ রায় চৌধুরী


ষাঢ় শেষ ; শ্রাবণ শুরু হয়ে গেছে। তবু বাঙালি বর্ষা বিষয়ক ব্লগ লিখবে না? কিন্তু বর্ষা অতিচর্চিত বহুব্যবহৃত বিষয়। তাই তাকে নিয়ে যা বলা হবে সবই পুনরোক্তি হতে বাধ্য। কালিদাস থেকে কবিগুরু, হালের জয়গোসাঁই অব্দি বর্ষা-বন্দনার বিপুল বিস্তার। রূপে অরূপে সে অনবদ্য। কিন্তু সত্যিই কি স্মৃতি এমন কথা বলে? কেমন ছিল আমার শৈশবে মফস্বলের বর্ষা?
স্টেশন থেকে বাড়ি পুরোটাই বৃষ্টি-বিভুল পথ। সকালে সাইকেলে চেপে গেছি, সাঁঝে সাইকেল এল আমার কাঁধে চেপে। ঘরে ঘরে জেগে উঠেছে জলটুঙ্গি। ইঁটের উপর ইঁট আর ব্যাটারির খোল দিয়ে নির্মিত মঞ্চের উপর খাট, আলমারি। মেঝে মানে হাঁটুডোবা জল। সে জলে জলে যুক্ত হয়ে আছে গোটা পাড়া। তিন ঘর পরের বাড়ির প্রেমিকা কাগজের নৌকা ভাসালে সে হয়তো এসে ঠেকে আমার খাটের পায়ায়। আর শুধু তো প্রেমের নৌকা নয় সে জল বয়ে আনে কত শারীরিকতা। মনে মনে মিল হোক না হোক শরীরে শরীরে জ্বর-জ্বালা-সর্দি-কাশি; সাম্যবাদ। সাতদিন পর জল পুরো নেমে গেলে ব্লিচিং পাউডার আর ফিনাইলের গন্ধে ম ম করে গোটা পাড়া। আমি তো জানতাম ওটাই বর্ষার গন্ধ। ভেজা জুঁই, বকুল, মালতি বললে বুঝতাম আকাট ভেজা জলমহালের সেই একলা রোজগেরে দিদিদের; বাদল দিনের প্রথম বর্ষণেই কদম ফুলের মতো কাঁটা হয়ে যেত যারা। পঙ্গু বাবার শরীরের নিন্মচাপ কি করে সামলাবে এই প্রাকৃতিক নিন্মচাপের আক্রমণের জমানায়? হ্যাঁ, আক্রমণ। যে আক্রমণে তছনছ হয়ে যেত সব ছন্দ। তালগোল পাকিয়ে খিচুড়ি হয়ে যেত জীবন। বর্ষায় তাই আমাদের অনিবার্য আহার্য ছিল খিচুড়ি।
ছাড়ুন, আমাদের নিন্মবিত্ত জীবনের মফস্বলি বৃত্তান্ত। অভিজাত শহরেও বর্ষা কি খুব সৌন্দর্যময় সুসময় বয়ে আনে? “বর্ষা ঘন ঘোর/ ...গলিটার কোণে কোণে/ জমে ওঠে পচে ওঠে/ আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভুতি/ মাছের কানকা/ মরা বেড়ালের ছানা/ ছাইপাঁশ আরো কত কি যে” আমি কেন, এ তো ঠাকুর বাড়ির ছেলের বয়ান। এখনকার কথা কহতব্যই নয়। শহরে কি বর্ষা কোনদিন সুন্দর ছিল?
চিন্তা-চেতনা, ভাববিলাসে না নিত্যদিনের চর্চায়। বইয়ে না বাস্তবে। পর্দার দৃষ্টিসুখের মতো দূর থেকে নয়; শ্যাওলা পিচ্ছিল পদতল, স্যাঁতস্যাঁতে বস্ত্রদল, পলেস্তরা খসা পাঁশুটে পরিবেশ মহামারি ছাড়া আর কি মহান বার্তা বয়ে আনে নর্দমা লাঞ্ছিত নাগরিক বঙ্গ-বর্ষায়?
বর্ষালি বিনোদনের সেরা স্বাদ বোধহয় সোঁদা গন্ধ। দাবদাহে জ্বলা মাটির শরীরে যখন অল্পে অল্পে নেমে আসে স্বল্প বিন্দু জল। পতনের বুদবুদে ভরে বাতাস। তখন  অনুজীব (ব্যাক্টেরিয়া) এর দেহজাত যৌগ বিক্রিয়ায় উৎপাদন করে তীব্র সংবেদনশীল গন্ধ (১ কেজিতে ৫ ন্যানোগ্রামের উপস্থিতি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের জন্য যথেষ্ট) জিওস্মিন। মিট্টি কা আতর নামে এ গন্ধ বাষ্প-পাতনে বোতল বন্দি হয়ে বাজার মাত করেছে দীর্ঘদিন।
তো এই আমাদের বর্ষা মাদকতার মূল রহস্য। সে মৃতদেহ থেকে সুগন্ধ উৎপাদন করতে পারে; আর সে গন্ধের তীব্রতাও ভয়ংকর। বরিষণ আসলে আগ্রাসন। বৃষ্টি যখন আসে শুধু কি রাস্তা-ঘাট গলি-শহরতলি; সে আমাদের শরীরের প্রতিটি রোমকূপ অব্দি দখল করে নেয়। কাকভেজা হয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকি তবু কি অমোঘ তার আবেদন; শরীর উথলে ওঠে খুশি। আসন্ন অসুবিধা আর অসুস্থতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে নেশায় মাতাল করে দেয়। আসলে বর্ষণ একটা প্রক্রিয়া। একটা ক্রিয়াপদ মাত্র।যার শক্তির জোর তুলনারহিত। নন্দিনীকেও মুগ্ধ করেছিল ‘রাজার অদ্ভুত শক্তির চেহারা’। তাকে ভালবাসো অথবা ঘৃণা কর; কিন্তু অগ্রাহ্য করতে পারো না। বর্ষা সেই বদমাইশ যে বাদুলে বিষন্নতা আর বাস্তব বিপর্যয় নিয়েও জয়ী হতে জানি। প্রমাণ করে দেয় নিরবিচ্ছিন্ন ভালরও একটা বোরডম আছে। বর্ষা তাই অপ্রতিরোধ্য। সে নিজেই নিজেকে ভাঙে আর গড়ে। পুনর্জন্মদানের পরাবাস্তব ক্ষমতা আছে তার। ক্রমাগত বদলের বাণী তার শরীর জুড়ে। মেঘ-বৃষ্টি-রৌদ্দুর, জন্ম-মৃত্যু-ভালোবাসা, সুর-শব্দ-ছবি, ছন্দ-গন্ধ-ধন্ধ, সব মিলে সে ভারি বিচিত্র। আর কোনও ঋতু এত বহুরূপী নয়। মানুষ তো বেসিক্যালি বৈচিত্র্য-প্রেমী। বর্ষা সেই বৈচিত্র্যের বিজয় পতাকা।

Post a Comment

0 Comments