পান্থ/ ৪ । প্রেমের পাহাড় তাওয়াং

প্রেমের পাহাড় তাওয়াং

বর্ণালী রায়  


‘‘এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের
কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব,...।
...একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।’’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কলমের যাদুতে যে পাহাড় কিনতে চেয়েছিলেন, আমিও তেমন বারবার ফিরে যাই পাহাড়ের কাছে। কিনতে না পারি তার সৌন্দর্য আমাকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়। সেইরকমই এক পাহাড় অরুণাচল। আজ কিন্তু আমারা অরুণাচলের একটু অন্যরকম গল্প শুনব। এ গল্প ভালোবাসার গল্প, এ গল্প দেশ প্রেমের গল্প। যে ভালোবাসার সৃজনে আজকের টুরিস্ট হটস্পট অরুণাচলের সেলা পাস, নুরনাং জলপ্রপাত।
দিরাং থেকে তাওয়াং যাওয়ার গোটা রাস্তাতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে আছে ভালোবাসার ছাপ। আসামের জিয়াভরলি এখানে এসেই কখনও কামেং নদী, কখনও দিরাং নদী। এখানে গোটা পথে তার দেখা মেলে এক চঞ্চলা চপলা মেয়ের বেশে। দূরের পাহাড়ের গায়ে আটকে থাকা দলা পাকানো মেঘেদের রূপ দেখে মাঝেমধ্যেই ভাবছি বোধহয় ক্যানভাসে আঁকা কোনো ল্যান্ডস্কেপ।
সেদিন ছিল ১৭ নভেম্বর, ১৯৬২। নতুন সূর্যের আভা পূর্ব হিমালয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়েছিল চিনের কম্যান্ডোরা। খোলা আকাশের নিচে ৭২ ঘন্টা ধরে প্রবল শীতে, পরিশ্রমে ও অনাহারে বিপর্যস্ত তিন যুবক যুবতী কিছু বোঝার আগেই গ্রেনেড ছুঁড়েছিল চিনারা। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার এসে লেগেছিল সেলার মাথায়। যশবন্তের চোখের সামনে গড়িয়ে পড়েছিল প্রাণোচ্ছল তরুণী সেলা। ভারতের ইতিহাসের মোড় ঘোরানো দিনের প্রথম শহিদ হয়েছিলেন ১৯ বছরের মংপা যুবতী সেলা। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার আহত হলেও যশবন্তের হাতের রাইফেল থামেনি। গায়ে এসে বিঁধেছে শত্রুপক্ষের গোটা পাঁচেক বুলেট। এই অবস্থাতেও উঠে দাঁড়িয়ে একহাতে রাইফেল ধরে গুঁড়িয়ে দিলেন সাতজন চিনা কম্যান্ডোর মাথা। একসময় শেষ হয়ে গিয়েছিল রাইফেলের গুলি। ম্যাগাজিনে অবশিষ্ট আছে আর একটি মাত্র বুলেট। তাঁকে ছেড়ে পালাতে বলেছিলেন নুরানাংকে। মৃত্যুপথযাত্রী যশবন্তের শেষ কথাটুকু সজল চোখে মেনে নিয়েছিল নুরনাং। একবার সেলা দিদির রক্তাক্ত মৃতদেহের দিকে, আর একবার প্রিয়তম যশবন্তের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছিল নুরনাং। ভারতের তাওয়াং সীমান্তে একা পড়ে রইলেন, ভারতের পূর্ব সীমান্তের অতন্দ্রপ্রহরী, ২১ বছরের যশবন্ত সিং রাওয়াত। সারা গায়ে গুলি আর স্প্লিন্টারের ক্ষত। রক্তস্নাত দেহের পাশে পড়ে আছে সেলার মৃতদেহ। দুজনের রক্তের ধারা মিশে এক হয়ে গড়িয়ে পড়ছিল পাহাড়ের বুকে। বিধাতা বুঝি রক্তরেখায় যশোবন্তের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন প্রাণহীন সেলাকে। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছিল চিনা মিলিটারি বুটের আওয়াজ। দূরে, পাহাড়ে শোনা যাচ্ছে চিনা সৈন্যদলের উল্লাস। শেষবারের মতো পিছন ঘুরে ভারত মা’কে দেখেছিলেন যশবন্ত। নাকি মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে খুঁজেছিলেন গাড়োয়ালের পাহাড়ি গ্রামে তার পথ চেয়ে বসে থাকা বৃদ্ধা মা’কে। তারপর, ঠান্ডায় শক্ত হতে থাকা সেলার দেহের দিকে একবার তাকিয়ে, রাইফেলের নলটা গলার নিচে ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দিয়েছিলেন যশবন্ত সিং রাওয়াত। বাঙ্কার থেকে গড়িয়ে, গভীর খাদের বুকে হারিয়ে গিয়েছিল ২১ বছরের এক দুঃসাহসী যুবকের দেহ। পাথরের আড়াল থেকে নুরনাং চোখের সামনে দেখেছিল প্রিয়তমের মৃত্যু। নুরনাংকে পালাতে বলা সত্ত্বেও মৃত দিদি ও প্রিয়তম যশবন্তকে ছেড়ে পালায়নি নুরনাং। নাকি নুরনাং মরতে চেয়েছিল। মরে মিলতে চেয়েছিল সেলা দিদি আর যশোবন্তের সঙ্গে। চিনা সৈন্যের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল ১৭ বছরের নুরনাং। অকথ্য অত্যাচারের পর টেলিফোনের তার দিয়ে নুরনাংকে ফাঁসিতে লটকে দিয়েছিল চিনা সেনা। এক গাড়োয়ালি যুবকের প্রেমে পাগল হয়ে নিজেদের প্রাণ দিতে গিয়েছিল দুই মংপা যুবতী সেলা আর নুরনাং। এরপর গল্পের শেষটা সবাই জানে, ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে সেই কাহিনী। বীর সেনা যশোবন্ত সিং রাওয়াতের আত্মত্যাগের উপখ্যান, ভারত চিনের সেদিনকার যুদ্ধে ইতিহাস, রাইফেলম্যান যশবন্ত সিং এর বাবা যশবন্ত সিং রাওয়াত হয়ে ওঠার গল্প। কিন্তু যেটা বিরল সেটা হল, সেই দুই মংপা মেয়ে যারা যশোবন্তের সঙ্গে একদিন ঘর বাঁধতে চেয়েছিল, যশোবন্তের প্রেম প্রত্যাখ্যানের দু:খকে জয় করেও ভালবাসার জন্য প্রাণ দেওয়ার কাহিনি। 
দিরাং থেকে তাওয়াং যাওয়ার পথে ৬২ কিমি গেলেই ১৩৭০০ ফুট উচ্চতায় সেলা পাস আর পাসের নীচেই অদ্ভুত সুন্দর সেলা লেক। তাওয়াং সেখানে থেকে আরও ৭৩ কিমি। মংপা যুবতি সেলার নামেই এই গিরিপথ। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা -১০ ডিগ্রী থেকে নিম্নগামী হয়। বছরের অনেকগুলো মাস সেলা পাসটি বরফাবৃত হয়ে থাকে। এখানে থাকা সেলা লেকের সৌন্দর্য্য দেখে একে স্বর্গীয় সরোবর বললে ভুল হবে না। বছরের খুব স্বল্প সময়েই এখানে সূর্যের আলোর ঝলমলে রূপ দেখা যায়। শান্ত স্বচ্ছ জলে নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি সেবার আর দেখা হয়নি। ঝুরঝুরে বরফে ঢেকে যাচ্ছিল রাস্তাঘাট, গাড়ির কাঁচ। ধিরে ধিরে কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেল লেকটা। কল্পনায় ভাবতে থাকি ওই কুয়াশার ওপারে আজও বুঝি সেলা বসে আছে যশোবন্তের জন্য। হয়তো যশোবন্ত একবার ফিরে এসেছে দেখতে সেই মেয়েটাকে, যে তার জন্য শুধু  দেশপ্রেমিক হয়ে উঠেছিল তাই নয়, নিজের প্রাণ দিতে একবারও ভাবেনি।
অজানা সেই যুগলের উদ্দেশ্যে একফোঁটা মন খারাপ সেই পাসের মাথায় ফেলে রেখে নেমে আসি। আর কি ফেরা হবে কোনওদিন এখানে? হয়ত আসব। হঠাৎ জীবনানন্দ ভাস্বর হয়ে ওঠেন সমস্ত বোধ জুড়ে, কেমন হয় আবার যদি কোনদিন এখানে ফিরে আসি কুড়ি কুড়ি বছরের পর? হয়ত তখন, “বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের/ ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো/ তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা/ একটি পাখির গান কি রকম ভালো...।”
নীচে নামতেই বরফের বৃষ্টিটা কমে এসেছে। আকাশে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। মাঝে মাঝে সামরিক ছাউনি চোখে পড়ে এদিক ওদিক। একটি দুটি নয়, বেশ কিছু। হিসেবী সতর্কতা। গাড়ি পেরিয়ে চলে আরো পাহা, আরো অচেনা সরোবর। জলে, পাড়ে ঘন বরফের আস্তরণ। বরফের ঘোমটা সরিয়ে লাজুক নারীর মতো জেগে আছে টলটলে কালো জল। ঘন মেঘ জমেছে আকাশপারে। তাদের ছায়া ঘনিয়েছে লেকের জলটুকুর বুক জুড়ে। নরম হাওয়ার আদুরে আঁচড়ে জলের বুকে আঁকিবুকি কাটছে। চারিদিকের পরিবেশটা মনটাকে একেবারে ভীষণ শান্ত, সমাহিত করে দেয়। কী ভীষণ মায়াময় এ পৃথিবী! ‘চারিদিকে কী অসীম, শান্ত নীরবতা’। জারিত হতে থাকি সেই নীরবতায়।
যশোবন্তগড় ওয়ার মেমোরিয়াল থেকে দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার। আমরা বেশ খানিকটা নীচে নেমে এলাম। ফলে এখানে স্নোফল নেই, টিপটিপ করে বৃষ্টির পরে নীল আকাশ আর পেজা তুলোর মেঘের সারির দেখা মিললো অবশেষে। এটা জাং শহরের কাছাকাছি। এসেছি নুরনাংকে দেখতে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, সেই প্রেমিকা নুরনাং। নুরনাং এখানে বেঁচে আছে ঝরনা হয়ে। এটা নুরনাং বা জাং ফলস নামে পরিচিত। জলরাশি ১০০ মিটার উচ্চতা থেকে পড়ছে। সেলাপাস থেকে তৈরি হওয়া নুরানাং নদীর জল যা এখানে ফলস হয়ে পড়ে তাওয়াং নদীতে গিয়ে মিশেছে।
গাড়ি যেখানে দাঁড় করিয়েছিল সেখান থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি পেড়িয়ে নীচে নামতে হল। এই ফলস থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। উপকৃত হয় আশেপাশের গ্রামের মানুষ। অপূর্ব এই জলপ্রপাত। চারিদিকে পাহাড়। চারিপাশের ঘন জঙ্গল যেন আরও সবুজ রংয়ে সেজে উঠেছে জলের স্পর্শ পেয়ে। পাহাড়ের মাথা থেকে তীব্র গতিতে নীচে পাথরের উপরে পড়ে ধোঁয়াশাময় জলকণায় চারপাশে একটা কুয়াশার মতো আস্তরণ তৈরি হয়েছে। সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। তাতে কি! সকলে বাঁধন ছেড়া উদ্দাম আনন্দে বিভোর। ঝর্ণা, তা থেকে উৎপন্ন পাহাড়ি নদী, বিশাল বিশাল পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে রাস্তা করে ছোট ও মাঝারি পাথর টপকে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে জলরাশি। স্বচ্ছ কাঁচের মতো জল। নুরনাং তুমি কি এতটাই উচ্ছল ছিলে, নাকি শান্ত নুরনাং এর বাঁধন ছাড়া প্রেম এই জলপ্রপাতের ধারা। এই রূপ, রস ফেলে কোথায় যাব! যে সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, যে সৌন্দর্যকে ক্যামেরার লেন্সে ধরাও যায় না।
আসলে যশোবন্ত সিং, সেলা, নুরনাং সবাই বেঁচে আছে অরুণাচলের প্রকৃতির মধ্যে। দেশের মানুষের ভালোবাসায়—যার মৃত্যু নেই।
আরও কিছুটা দূরে তাওয়াং। গাড়ি ছুটতে লাগল।

Post a Comment

1 Comments