আনন্দপাঠশালা

বন্ধু-দাদার চিঠি


প্রিয় ছোট্ট বন্ধুরা,
অনেকদিন তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। কি ভাবেই বা হবে, বলো? আমরা তো সবাই সেই মার্চ মাস থেকে গৃহবন্দি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে। পৃথিবী থেকে যেন খুব শিগগির এই ভয়ানক সংক্রামক ভাইরাসটি বিদায় নেয়, সেই চেষ্টায় দিনরাত লড়াই চালাচ্ছেন পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানীরা। তাঁদের কাজের দিকে মুখিয়ে বসে আছি নিরুপায় আমরা।
আমাদের পড়াশুনো, লেখালেখি, খেলাধুলো, গানবাজনা, সবকিছুই এখন নেটনির্ভর হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে আমাদেরও মানসিকভাবে শক্ত থাকা প্রয়োজন। কোনও কাজ থামিয়ে রাখলে আমাদের চলবে না, তাই না?
তাই অন্যভাবেই হোক, অন্য মাধ্যমেই হোক, তোমাদের প্রিয় বিভাগ ‘আনন্দ পাঠশালা’ আবার ফিরে এল  ‘এখন শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার ই-সংস্করণে।
রইল লেখা, ছবি। প্রতি রবিবার পাবে তোমরা এই বিভাগটি।
ভাল লাগলো তো বন্ধুরা খবরটি পেয়ে? এবার পাতা খুলে পড়ো আর আমাদের জানাও কেমন লাগলো এই আয়োজন।
ভাল থেকো, সাবধানে থেকো সবাই।

তোমাদের বন্ধু-দাদা
অঙ্কন রায়


ছড়ার জন্য এঁকেছে অর্চিতা মুন্সী

আজগুবি

অঙ্কন রায়

আচমকা এক দমকা হাওয়া
চমকে তাকাই জানলা দিয়ে
উড়ছে কিছু ধুলোয় ছাওয়া
শুকনো পাতা শনশনিয়ে।

কোত্থেকে এক ষন্ডা ছাগল
এতোল বেতোল রাস্তা জুড়ে
ছুটতে গিয়ে বেজায় পাগল
পড়লো ধপাস শূন্যে উড়ে!

ওই ধারে এক বাড়ির পাশে
লড়ঝড়ে সেই খেঁষ্টি বুড়ো
লাফিয়ে উঠে নীল আকাশে
লোফেন গোটা মাছের মুড়ো!

কুকুর দুটো ভয়ের চোটে
মুখ লুকোনোর খুঁজছে ফিকির,
তাসুড়েদের দলটি জোটে
খেলছে ক'ষে ইকিড় মিকিড়!

গরুর লেজে আটকে প্রবল
শব্দে বাজে গাবগুবি খান!
যেই মেরেছে শীতটা ছোবল,
ছন্দে সাজে আজগুবি গান।

অলৌকিক

তনুশ্রী চক্রবর্তী


সময়টা বর্ষার মাঝামাঝি। যখন তখন আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামছে। আমি তখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আমার ছোড়দা একটা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করত। গ্রামের দূরত্ব আমাদের বাড়ি থেকে অনেকখানি। ছোড়দা রোজ সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেত। সেই গ্রামেই আমার এক বান্ধবীর বাড়ি।
এক রবিবার ঠিক করলাম মা আর আমি ছোড়দার সঙ্গে ওদের বাড়ি যাব। ঘনঘোর মেঘ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা রওনা হলাম। স্টেশন পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমাদের রিক্সা চলল। দুপাশে কোথাও ধূ ধূ প্রান্তর, কোথাও গাছপালায় ভরা জঙ্গল দেখতে দেখতে আর বৃষ্টির ছাট গায়ে মাখতে মাখতে দুপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য মন্দ লাগছিল না।
একসময় বান্ধবীর বাড়ির সামনে রিক্সা থেকে নামলাম। পুরনো আমলের বিশাল বাড়ি। প্রকাণ্ড উঠোন। একদিকে দোতলা দালান। পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর। উঠোনের একপাশে কুয়োতলা, গোয়ালঘর, সংলগ্ন ধানের গোলা। সব মিলিয়ে বেশ ভাল লাগছিল দেখতে। বান্ধবীদের বাড়িতে অনেক লোকজন। একান্নবর্তী পরিবার। বেশ কিছুজনের সঙ্গে আলাপ হল। চা জলখাবার খেলাম। তারপর গল্পগুজবে অনেকটা সময় কেটে গেল।
সন্ধে হতে হতেই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি, অমনি বান্ধবী আর তার দিদি সেই রাতটা থেকে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। ওদের জেদের কাছে নতি স্বীকার করে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই হল। কিন্তু মা আর ছোড়দা আষাঢ়ে মেঘ মাথায় করেই ফিরে যাবার পথ ধরল। ওরা চোখের আড়ালে চলে যেতেই মনটা একটু বুঝি হু হু করে উঠেছিল।
সাঁঝবাতি ধরিয়ে কিছু পরেই বাড়ির কাকিমা, জেঠিমারা এক জায়গায় এসে জড়ো হয়ে বসলেন। আমি পর পর কয়েকটা বর্ষার গান শোনালাম কবিগুরুর। মুড়ি আর গরম তেলেভাজাও এল। বাইরে বৃষ্টি আর তার সঙ্গে ঝিঁঝিঁর ডাক গোটা পরিবেশটাকে কেমন যেন থম্‌থমে আর রহস্যময় করে তুলেছে। 
আটটা বাজতে না বাজতেই রাতের খাবার। বান্ধবীর দিদি অনুদি বলল, ‘এখানে ইলেকট্রিক নেই তো, তাই সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। চলো আমরাও খেয়েদেয়ে চলে যাই নিজেদের ঘরে। তারপর অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে প্রচুর আড্ডা দেওয়া যাবে তিনজন মিলে।’
বান্ধবী রুমা, তার দিদি অনু আর আমি তিনজন মিলে দোতলায় চলে এলাম। ওদের শোবার ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বড়সড়ো পালঙ্ক। চারদিকের দেওয়ালে অনেকগুলো জানলা। জানলার কাচে বৃষ্টির শব্দ আছড়ে পড়ছে। অনুদি জানালো দক্ষিণ দিকে জানলার নীচেই একটা পুকুর আছে। অন্ধকারে দেখতে পেলাম না।
হারিকেন জ্বলছিল ঘরে। আলোটা অল্প করে আমরা তিনজনই শুয়ে পড়লাম পালঙ্কে। আমি বরাবরই একটু ভীতু প্রকৃতির। তাই ওদের দুজনের মাঝখানে থাকলাম।
পুরনো আমলের কড়ি বরগাওলা বাড়ি। ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি বড় বড় বিম দেওয়া কড়িকাঠ। হারিকেনের অল্প আলোয় ছাদে আমাদের ছায়া পড়ে কেমন গা ছম্‌ছম্‌ করছে। 
গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। হয়তো তখন মধ্যরাত। আচমকা চোখদুটো খুলে গিয়ে দেখলাম আমার ঠিক মাথার উপরেই কড়িকাঠ থেকে দুটো সাদা পাজামা পরা পা দুলছে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। অনুদি আমাকে ঠেলে তুলল। আমি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। বন্ধু রুমাও উঠে পড়েছে। অনুদি আমায় জল খাইয়ে দিল। আমি আবার শুয়ে পড়লাম। ওরা কিছু জিজ্ঞেস করল না। করলেও আমি বলতে পারতাম না। আমার হাত পা সব তখন অবশ লাগছে। এভাবে কাঠের মতো পড়ে থাকতে থাকতে আর বৃষ্টির শব্দের রেশ কানে বাজতে বাজতে কখন জানি আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়। সারারাত বৃষ্টির পর মেঘ কেটে গিয়ে এখন দিনের আলো ঝলমল করছে। জানলা বেয়ে রোদ এসে পড়েছে আমার মুখে।
একটু পরে বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে ফেরার তোড়জোর শুরু করলাম। বেরোবার আগে রাতের ঘরটার দিকে একবার তাকিয়েই কেমন আতঙ্কে ভরে গেল মনটা। 
ফেরার পথে রিক্সা পাইনি। আমাকে এগিয়ে দিতে আমার সঙ্গে হেঁটে আসছিল রুমা আর অনুদি। হঠাৎ অনুদি জানতে চাইল আমি রাতে কি দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম। আমি জানালাম, ‘সাদা পাজামা পরা দুটো পা ছাদের কড়িকাঠ থেকে ঝুলছিল। আমার মনে হল এ স্বপ্ন নয়। একেবারে সত্যিই দেখছি।’
অনুদি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যা বলল, শুনে আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। অনুদি জানালো বারো বছর আগে ওদের ছোটকাকা ঐ ঘরের কড়িকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ঘরটা অনেকদিন ব্যবহার করা হয়নি। আবার কয়েক বছর বাদে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাড়ির লোকেরা কখনও এই দৃশ্য দেখেনি। নতুন কেউ এলে দেখতে পায়।
শুনে আমার শরীরে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি হাঁটার শক্তি যেন হারিয়ে ফেললাম। কোথায় চলেছি তাও বুঝি মনে নেই। খানিকটা আচ্ছন্নকর অবস্থায় স্টেশন পেরিয়ে, বাজার এলাকা পেরিয়ে কখন যেন বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছেছি। অনুদি আর রুমা আমায় পৌঁছে দিয়েই ফিরে গেল। 
দুপুরে খেতে বসে বাড়ির সকলকে রাতের ঘটনার কথা বললাম। ওরা বলল মনের ভুল। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস আমি যা দেখেছি সবটাই সত্যি, না হলে বারো বছর আগের ঘটনার সঙ্গে এ দৃশ্য মিলে যাবে কি করে! এখনও সেই রাতের দৃশ্য মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। 


Post a Comment

0 Comments