ব্লগ : হ্যালো হান্ড্রেড/ ৩ । অপারেশন থান্ডারবল


অপারেশন থান্ডারবল

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য


মোসাদ ইসরায়েলের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা। এর কাজের রিপোর্ট ও গোয়েন্দা তথ্য সরাসরি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়। যদিও মোসাদ সামরিক সার্ভিস নয় এর অধিকাংশ কর্মকর্তাই ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে। গোপনে। সবার অগোচরে।
১৯৭২-এর ৮ মে ৯৪ জন যাত্রী নিয়ে ওড়া একটি বোয়িং ৭০৭ বিমান বেলজিয়ামের ব্রুসেলস থেকে ইসরায়েলের লদ্‌ বিমানবন্দরে নিয়ে যায় চারজন হাইজ্যাকার। একজন বিমানযাত্রী ও দুজন হাইজ্যাকার সেবার মারা যায়।
এরপর ১৯৭৬ সালে উগান্ডার এন্টেবি বিমানবন্দর। ছবিটা এইরকম— জুলাই ৩। এয়ার ফ্রান্স ফাইট ১৩৯ বিমানটি দাঁড়িয়ে আছে টারম্যাকে। আফ্রিকার গরমে বাষ্প উঠছে টারম্যাক থেকে। দূর থেকে সেই বাষ্পের ভেতর দিয়ে বিমানটার অবয়ব কাঁপছে। এয়ার ট্রাফিক টাওয়ারে গম্ভীর মুখে পদচারণা বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের আধিকারিকদের। বাইনোকুলারে চোখ গোয়েন্দাদের।
ঘটনার সূত্রপাত ২৭ জুন। তেল আবিব থেকে প্যারিস যাচ্ছিল এয়ার ফ্রান্সের বিমানটি। মাঝে গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে থামা। ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার ওঠা নামার ফাঁকে একটু অসতর্কতায় প্লেনে উঠে পড়ল পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের সাতজন জঙ্গি। এই সংগঠনটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ। ১৯৬৭-তে জর্জ হাবাসের হাতে এর প্রতিষ্ঠা। 
জঙ্গিরা প্লেনটি হাইজ্যাক করে দুদিন পরে উড়ে গেল মরোক্কোর কাসাব্লাঙ্কায়। সেখানে একরাত কাটিয়ে পাড়ি দিল সুদানের রাজধানী খারটুম। সেখানে নামার অনুমতি না পেয়ে প্লেন নামে উগান্ডার এন্টেবিতে। হাইজ্যাককারীদের সাতজনের দলটিতে কিছু আরব ও জার্মান সদস্য ছিল। তাঁরা দাবি সনদ পেশ করল ফোনে। ইসরায়েলের বিভিন্ন জেলে বন্দি চল্লিশ জন প্যালেস্তিনীয়র মুক্তি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জেলে থাকা কয়েকজনেরও। কয়েক মাস আগে ট্মাস রয়টার আর ব্রিগিট শুলজ্‌ নামে দুজন গ্রেফতার হয়েছিল কেনিয়ায়। তাঁরা নাইরোবি মিমানবন্দরে স্যাম-৭ রকেট দিয়ে একটি ‘এল আল’ জেট প্লেন উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাঁরা বন্দি কেনিয়ার জেলে। জঙ্গিরা এই দুজনেরও মুক্তি চায়। বন্দিদের মুক্ত করে ৩০ জুনের মধ্যে উগান্ডায় না পৌঁছে দিলে বিমানটি উড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেয়।
জরুরি ক্যাবিনেট মিটিং ডাকেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইটজ্যাক্‌ রাবিন। মন্ত্রীরা হাইজ্যাকারদের দাবি মেনে নেওয়ার স্বপক্ষে মত দেন। দেশের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ‘শিন-বেট’কে রাবিন বলেন যে এরকম বন্দি মুক্তির পুরনো নজির বা তথ্য পেশ করতে। ৩০ জুনের ডেডলাইন এগিয়ে আসছিল। ইসরায়েলি সামরিক প্রধান, মর্দেচাই ‘মোটা’ গুর বললেন বিমানবন্দরটিতে অ্যাকশন করার উপায় ক্ষীণ, কারণ সেখানকার যথেষ্ট তথ্য নেই।
এরপর বন্দি মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হল। সেই বার্তা হাইজ্যাকারদের কাছেও গেল। তাঁরা ধরে নিল, যে তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। তাই তাঁরা তাদের ডেডলাইন পিছিয়ে ৩ জুলাই করে দিল। এবং ইহুদি বাদে অন্য ১৪৮ জন যাত্রীকে ছেড়ে দিল। এতে হাতে কিছু সময় পাওয়া গেল।
এরমধ্যে হাইজ্যাকাররা পণবন্দিদের বিমানবন্দরের একটি টার্মিনালে স্থানান্তরিত করে। মোট ৯৪ জন ইসরায়েলি নাগরিক ও ১২ জন এয়ার ফ্রান্সের কর্মী। এদের মধ্যে ডোরা ব্লক নামের ৭৩ বছরের বৃদ্ধাকে উগান্ডার কাম্পালায় ভর্তি করা হয় শারীরিক অসুস্থতার কারণে।


মোসাদের বাঘা বাঘা অফিসাররা কাজে নেমে পরে। উগান্ডার রাষ্ট্রপতি ইদি আমিনের সময়কালে ১৯৭২ অবধি যেসব ইসরায়েলি অফিসার ও পাইলটরা উগান্ডায় ট্রেনিং দিত, তাদের ডাকা হল। এন্টেবি বিমানবন্দরটাও দেখা গেল বানিয়েছিল এক ইসরায়েলি সংস্থা, হিস্তাদ্রুট কোম্পানি। কম্পানির ইঞ্জিনিয়ারদের ডাকা হল। ইদি আমিনের বিভিন্ন ভিডিও ফিল্ম দেখা হল। ইদি আমিনের সঙ্গেও ফোনে যোগাযোগ করা হল কিন্তু বোঝা গেল ওনার সহানুভুতি আছে হাইজ্যাকারদের প্রতি। তবে এরই মধ্যে মোসাদ একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করে ফেলল। এর মধ্যে ছিল বিমানবন্দরের প্ল্যান ও বহু ফটো। এই ফটো অবশ্য একদিন আগেই তুলে ফেলেছে গোয়েন্দারা। যেসব অ-ইহুদি বিমানযাত্রীদের ছেড়ে দেওয়া হয়, তাদের প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে বিশেষ বিমানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন মোসাদ গোয়েন্দারা। এদের মধ্যে এক ফরাসী ইহুদি, মিচেল কোজোট পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিয়ে দেয় হাইজ্যাকারদের বর্ণনা এবং যে টার্মিনালে বাকিরা রয়েছে, সেখানকার বর্ণনা। জঙ্গিরা সেই টারমিনালের কোথায় কোথায় বিস্ফোরক লাগিয়ে রেখেছে, সেগুলিও বলে দেয় কোজোট।


ওদিকে ফরাসিদের মাধ্যমে জঙ্গিদের সাথে কথাবার্তা চালাতে থাকে প্রধানমন্ত্রী রাবিনের জঙ্গি বিষয়ক মুখ্য উপদেষ্টা মেজর জেনারেল জে’ভি। জঙ্গিরা ঘুনাক্ষরেও টের পায় না আসল উদ্দেশ্য।
উদ্ধারের অপারেশনের নাম দেওয়া হয় ‘থান্ডারবল’। একটিই খুঁত রয়ে গেছিল। ইসরায়েলের মিলিটারি গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘আমান’এর প্রধান শ্লোমো গাজিত বললেন যে উদ্ধারকার্যের পর যখন সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে, তখন ইদি আমিনের আদেশে উগান্ডার মিগ বিমানগুলি সেগুলি উড়িয়ে দিতে পারে। এটাই কাঁটা রয়ে গেল। অনিশ্চয়তা।
যাইহোক, প্রধানমন্ত্রী গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া মাত্রই কাজে লেগে গেল মোসাদ ও ইসরায়েলি বাহিনীর ১০০ জন সদস্য। ছটা প্লেন তেল আবিব ছাড়ল ৩ জুলাই গভীর রাতে। প্রথমে উড়ল হারকিউলিস বিমানটি। এটি বিশালাকার হলেও খুব কম আওয়াজ করে। ছটি প্লেন লোহিত সাগরের ওপর দিয়ে খুব কম উচ্চতায় উড়ে গেল যাতে কোনও দেশের রাডার তাদের ট্র্যাক করতে না পারে। প্লেনগুলি খুব সাধারণভাবে এন্টেবি এয়ারপোর্টে নামল যাতে কোনও সন্দেহ না থেকে। অন্যান্য দেশের বিমান ওঠানামার মাঝে।
ইসরায়েলি বাহিনীর বাছা বাছা স্নাইপাররা নিজেদের জায়গা নিয়ে নিল ‘ভ্যান্টেজ লোকেশনে’। যেখান থেকে জঙ্গিদের টার্মিনাল ভালোভাবে দেখা যায়। ডজনখানেক জঙ্গি টারমিনালের কাঁচের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে দৃশ্যগোচর হতে সময় লাগল। ততক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত রেখেছিল ব্রিগেডিয়ার ড্যান শম্‌রন। তাঁর ওপরেই অপারেশন সাফল্য আনার জন্য তাকিয়ে আছে ইসরায়েলি ক্যাবিনেট। অপেক্ষার ফল মিলল। হাতেনাতে। জঙ্গিরা কোনও সন্দেহ না করায় অনেকটাই সহজ হয়ে গেছিল। একএক করে শব্দ ভেদী বুলেট কাঁচের জানালা ভেদ করে ধরাশায়ী করতে থাকল তাদের।
৭০-এর দশকে ইসরায়েলের সেরা অস্ত্র ছিল গ্যালিল এসল্ট রাইফেল। সেই রাইফেলের টেলিস্কোপিক লেন্সে তখন নজরবন্দি জঙ্গিরা। দিশেহারাও। কোথা থেকে উড়ে আসছে গুলি? কয়েকজন হতভম্ব হয়ে বেরিয়ে এল। এবং গুলিগুলো তাদের চিনে নিল। এরমধ্যেই ইসরায়েলি কমান্ডোরা পৌঁছে গেছে টার্মিনালের চারপাশে। হঠাৎ করে গ্যাস বোমা নিক্ষেপ করে তাঁরা ঢুকে গেল চোখের নিমেষে। সাতজন হাইজ্যাকারকেই মেরে ফেলা হল।
ইসরায়েলের তরফে মারা যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল য়োনাতান নেতানহু। আরেক জন সৈনিক প্যারালাইসড্‌ হয়ে যান। জঙ্গিরা তিনজন বন্দিকে মেরে ফেলেছিলেন আর ইদি আমিনের নির্দেশে কাম্পালার হাসপাতালে ভর্তি বৃদ্ধাকে মেরে ফেলা হয়।
মোট নব্বই মিনিটের অপারেশনে ১০৬ জনের মধ্যে ১০২ জনকে উদ্ধার করে ইসরায়েলি বাহিনী। কিন্তু তাদের নিয়ে উড়ে যাওয়ার আগে বাদ সাথে উগান্ডার সেনারা। ৪৫ জন উগান্ডার সেনাকে খতম করে উদ্ধার করা যাত্রীদের নিয়ে বিমানগুলিতে চাপে ইসরায়েলি বাহিনী। আকাশে ওড়ার আগে বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা উগান্ডার বিমানবাহিনীর গোটা ৩০ মিফ-১৭ ও মিগ-২১ বিমানকে ধ্বংস করে যায় ইসরায়েলিরা। দেশে ফিরে যেতে যেতে নিচে জ্বলতে থাকা বিমানগুলির দিকে চেয়ে মৃদু হাসেন ব্রিগেডিয়ার শম্‌রন।
সেই ইস্তক, আজ অবধি ইসরায়েল থেকে বা সেদেশের উদ্দেশ্যে ওড়া একটিও বিমান হাইজ্যাক হয়নি!


লেখক রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত আইপিএস অফিসার 



Post a Comment

0 Comments