লকডাউনের দিনলিপি

সব কথা যেন ফুরিয়ে গেছে

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়


সে
ই কবে খড়গপুর ক্যাম্পাস ছেড়েছি। ছায়া ঘেরা কোয়ার্টার, সবুজ মাঠ, নির্জন এক-একটা দিন— সেই সব কথা এই লকডাউনে মনে পড়ছে ফের। স্বামী গবেষণার কাজে ল্যাবে, কুট্টু তখন খুব ছোট— কথা বলার সঙ্গী বলতে স্থানীয় এক দিদি পাপাম্মা। আমাকে সর্বক্ষণ ঘরের কাজে সাহায্য করত। আজ মনে পড়ছে তার কথা খুব। কেন যে মনে পড়ছে! যত বন্দি-জীবন দীর্ঘ হচ্ছে, মনে পড়ছে পুরনো দিনের কথা। কত মানুষের কথা। মনে মনে চিঠি লিখছি তাদের। আজ যেমন লিখছি পাপাম্মাকে। 
পাপাম্মা দিদি, কেমন আছ তুমি? এখনও মাথায় ফুলের মালা লাগাও? নিশ্চয় আরও খানিকটা সুন্দর হয়ে গেছ— এই ক’বছরে? আর, তোমার মেয়ে? বিয়ে হয়ে গেছে ওর? এখনও মনে পড়ে, তার চুড়ি কিনতে একশো-দুশো টাকা আবদার করতে আমার কাছে। আর সেই যে, খাওয়ার টেবিলে সব জলের বোতলগুলো সাজিয়ে রাখতে। ছোট থেকে বড় মাপ করে; ঠিক যেমনটি আমার পছন্দ। কথা বলতে অনর্গল।
জানো দিদি, আমি আজও তোমাদের ভুলতে পারিনি। তোমাদের সব্বাইকে মনে পড়ে খুব। আজও বিশ্বাস করি, ওই কোয়ার্টারটাই আমার বাড়ি, নিজের বাড়ি। কেন না, বিয়ের পরে প্রথম বোলপুর ছেড়ে অতদিন কোথাও থাকা আমার। বাড়িই তো।
এই লকডাউনে কেমন করে দিন পার করছ বলতো? কি করে চলছে তোমাদের সংসার? মাছ খেতে ভালবাসতে— কিনতে পারো এখন, মাঝেমাঝে? তোমার ছোট ছেলে আর মেয়েকে কখনও সখনও হলেও একটু পায়েস বানিয়ে দাও তো? সেবার আমার বানানো পায়েস থেযে ওদের খুব ভাল লেগেছিল। ওরা বলেছিল, এমন পায়েস নাকি ওরা আগে কখনও খায়নি! কথা হচ্ছিল আবার ক’দিনের জন্য ওখানে যাবার। কিন্তু, দেখো, হঠাৎ করে কিভাবে যেন সব বদলে গেল!
এই লকডাউনে তোমার কাজগুলো সব আছে তো? 
বেতন দিয়েছে, দিচ্ছে?
বেঁচে থাকাটাই এখন বড় কঠিন লড়াই হয়ে গেছে পাপাম্মা! কত দিন আমরা বাড়ির বাইরে যাইনি। কুট্টু বড় হয়ে গেছে। নিজে নিজে খাবার খায়। পড়া বলে। স্কুল যেতে পারেনি বলে কান্না-কাটি করে। কত নতুন কথা শিখেছে। একটু একটু করে ও বুঝছে করোনা একটা রাক্ষস— সাবধানে না থাকলে সবাইকে গিলে খাবে।
কমবেশি একই অবস্থা সবারই প্রায়। চারিদিকে শুধু ভয় আর মৃত্যু মিছিল। পৃথিবীর সব কথা যেন ফুরিয়ে গেছে! শুধু স্যানিটাইজার, সাবান, ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল আর মৃত্যুসংবাদ। শিউলিগাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ার মতো একটা একটা করে প্রাণ যেন ঝরে পরছে সব অকালে। অনেক দুরারোগ্য ব্যাধিই তো সেরে যায়, আমাদের পৃথিবী কি আর সুস্থ হবে না কোনও দিন? পাপাম্মা, এর শেষ যে কোথায়! 
আজ দুপুরবেলায় ভারি মনকেমন করছিল জানো। গান শুনছিলাম, ‘পুরানো সেই দিনের কথা...’। হঠাৎ করে তোমাদের সবাইকে যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। সেইসব আমার সুখস্মৃতি। এগুলো মনে পড়লে বুকের ভিতরটা হু হু করে। একটা চিনচিনে ব্যাথা, চোখ ছলছল। আর কত দিন!
শেষ বেড়িয়েছিলাম সেই মার্চ মাসে। তারপর থেকে সেই যে গৃহবন্দি হয়েছি, আজও তেমনি আছি। জানি না, আর কোনও দিনও তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে কি না! জানি না, এই রোগ বিদায় নেবার আগেই আমাদের...! সাবধানে থেকো। ভাল থেকো, অন্তত চেষ্টাটুকু করে যদি...!
 

Post a Comment

0 Comments