বইপাড়া : বিপন্নতা ও তার চারটি স্তম্ভ


বিপন্নতা ও তার চারটি স্তম্ভ   

দীপ শেখর চক্রবর্তী 


‘যদি আসার কোনো প্রস্তাব থাকে
আসা থাকে
যাওয়ার নিয়ম থেকে চলে যাওয়া থাকে
একটিই রাস্তা,একটিই অপেক্ষা
সেখানেও থেকে যায়…।’
স্বর্ণেন্দুকে আমার কখনও জানানো হবে না যে কেমন বিপন্নতায় আমি ওর এই বোধের কাছে আশ্রয় নিয়েছি। চার ফর্মার একটি কাগজিয়া মলাটের বই যা একদিন আমাকে খুঁজে নিয়েছিল। তারপর সেই বইয়ের কবিতাগুলোর মধ্যে আমি খুঁজেছি সন্ধেবেলার হারিয়ে যাওয়া একটা গান। মফঃস্বলের সন্ধেবেলাগুলোতে যেমন শঙ্খ বাজে, ধুনোর গন্ধ যেমন ভেতরে গিয়ে আমার অস্তিত্বকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে এই বইয়ের কবিতাগুলো আমাকে সেই সুর এবং গন্ধের কাছে নিয়ে যায়। সুচিতেই দেখা যাবে বইটির চারটি স্তম্ভ। এই চারটি স্তম্ভ দিয়ে একটা স্তব্ধতার বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এই চারটি স্তম্ভ কী হতে পারে? রূপ, রস, বর্ণ এবং গন্ধ।
স্বর্ণেন্দুর কবিতার বইটিতে এই চারটি রয়েছে। ফলে আবরণের চমকের কাছে বিস্মিত হয়েই পাঠককে ফিরে যেতে হয় না। যে কোনও উৎকৃষ্ট শিল্পের মতো তা প্রবেশ করে গভীর নির্জন গুহায়। এমন গুহা যা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বোধের ভেতরে রক্ষা করে এসেছি।
তাই এই কবিতাগুলো ফুরোতে চায় না। মনে আসে কৈশোরের সমাপ্তির দিনগুলোতে এমন অভিজ্ঞতার ভেতর আমাদের নিয়ে যেতে পারতেন জীবনানন্দ। আমাদের সুখ এবং অসুখ মধ্যবর্তী অদৃশ্য দড়ি দিয়ে এমন ভাবে টেনে নিয়ে যেতেন মনে হত এই জীবনের গভীর থেকে গভীরতর নির্বাসনের ভেতরেই প্রকৃত বোধ লুকিয়ে থাকে। সেই নির্জন দিনগুলো আর নেই। স্বর্ণেন্দুর মতো কিছু কিছু মানুষের কবিতায় এখনও যে বেঁচে আছে সেই আমাদের অনেক প্রাপ্তি।
এমন কবিতা লেখার জন্য ধ্যান ও মগ্নতার প্রয়োজন হয়। এটি প্রশংসা নয়, একটি পথ। কবি যখন আগুনহ্রদ পার করে গিয়ে জীবনের প্রকৃত আলোর কাছে দাঁড়ান তখন তার প্রতিটি চিন্তা একটি দর্শন। এই দর্শন কবিতায় প্রয়োগ এক কঠিন প্রক্রিয়া। আমি স্বর্ণেন্দুকে কখনও বোঝাতে পারবো না যে ওর কবিতাগুলো আমার বহুদিনের একা একা হেঁটে যাওয়া। যখন পাশাপাশি কেউ থাকে না, একা একা কথা বলে যায় মানুষ নিজের বিপন্নতার সঙ্গে।
তখুনি পথে দেখতে পাই স্বর্ণেন্দুর এই স্তব্ধতার বাড়ি। ভেতর থেকে একমনে তানপুরা বাজিয়ে চলছে কেউ এবং সেই সুরে সন্ধে নেমে আসছে। তার কাব্যভাষা এবং কবিতা নির্মাণ পদ্ধতি আমাকে মুগ্ধ করে না, আমাকে বিপন্ন করে। এই শ্রেষ্ঠ।
আসলে সেই কবিতা আমার যেখানে শব্ধের থেকেও প্রখর হয়ে ওঠে নৈঃশব্দ্য। তাকে কিছুতেই চাপা দেওয়া যায় না। পাঠক যারা কবিতার মাধ্যমে প্রকৃত নিঃশব্দকে ছুঁতে চান তাদের কাছে এই বই অমৃত। যারা চান কবিতায় উপরি মনোরঞ্জন তাদের কাছে এই বই বিষ।
স্বর্ণেন্দু নিজেও জানে না ও নীলকন্ঠের মতো এই বই লিখেছিল।

পিতার জন্ম হয় । স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত । মনফকিরা

Post a Comment

0 Comments