ব্লগ : দেশান্তর/ ৭ । মৃত কবি মত্ত হয়

মৃত কবি মত্ত হয়

মৌমন মিত্র 


‘বিষণ্ণনিরাময়সূর্যাস্ত’— কয়েক পঙক্তি এমন সূর্যাস্তের কথা লিখেই গতকাল রাতে শুয়ে পড়েছি। এই সপ্তাহ জুড়ে মন ভার হয়ে আছে। কী যে লিখব, কেনই বা লিখছি, কিছুই মাথায় আসে না। মনে হয় চলাচল ধ্বস্ত হলে এক এক করে সমস্ত শূন্যতা জড়িয়ে মরিয়ে আমাদের গ্রাস করে। এই কী নব্য স্বাভাবিকতন্ত্র? না প্রাক সোশ্যাল মিডিয়া পৃথিবীতে এমনটা আগেও ছিল, আড়ালে?  
এই সময় শুড়িপথ বেয়ে নেমে আসে নিজের বয়ে চলা গ্লানি, ধামা চাপা দেওয়া সংক্রমণ, কিছু বোধ এবং হয়তো আমার বেসুরো তানের মুহূর্ত। তখন স্বগতোক্তি জরুরি হয়ে ওঠে। একটা নিরাময়ের ভোর দেখতে চায় আমার এক একটা অবলীলায়, অবহেলায় ফেলে রাখা মননশক্তি। ধাক্কা খেতে খেতে কেমন ভাবে গোটা বিশ্ব জড়িয়ে যায় এক একটি জীবন যন্ত্রণার কাতরতায়!
আমেরিকায় জীবনধারণ শুরু করার মুখে, ও আমায় এই দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছিল। এক, এই দেশে কোনও শর্ট-কাট নেই। অর্থাৎ বিনা পরিশ্রমে কিছু পাবে না। তাই এই দেশে হঠাৎ কেউ কিছু অর্জন করতে পারে না। সময় লাগে। অনেকটা সময়। দুই, এখানে গভীর বন্ধুত্ব এবং পরিবারের বাইরে প্রত্যেক মানুষের একটা চেম্বার থাকে যার নাম ‘আমি’। যেখানে ‘বাকিটা ব্যাক্তিগত’।
স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতা থেকে এসে এই দু-ধরণের বৈশিষ্ট্যকে মেনে ও মানিয়ে নিতে সময় লেগেছে। কারণ, আমার কলকাতায় আমরা ঠিক এর বিপরীত অঙ্গে জীবন বয়ে নিয়ে যাই। সেটা ঠিক না ভুল জানি না। তবে সেটাই সত্যি। 
পরিশ্রমের পথ ছেড়ে সহজ পথ অবলম্বন করতে করতে আমরা দিশাহারা হয়ে উঠি। এই সড়ক আমাদের কোথায় কীভাবে কোন চৌপথিতে নিয়ে দাঁড় করাবে আমরা তা নির্ধারণ না করেই ঝাঁপ দিই, মত্ত হই আগুনখেলায়। ক্ষমতা ও তার অপব্যাবহার আদিম নেশা। আমাদের সকলের মধ্যেই তা কম বেশি লুকিয়ে থাকে। কারণ, আমরা সিনেমার নায়ক/ নায়িকা নই। আমরা আসলে, নায়ক চলচ্চিত্রের সেই নায়ক চরিত্র। অরিন্দম। আমরা হলাম বাস্তবের জীব। যার খিদে আছে, তৃষ্ণা আছে, ভয় আছে, দুঃখ আছে, ঘৃণা, অভিমান আছে, সর্বোপরি যৌনতা আছে। আর যে কোনও অনুভূতি, ভুল কিংবা অন্যায় নয়। তা কেবল অনুভূতি যা আমাদের দৈনন্দিন জিইয়ে রাখছে।
এক দিকে মানুষের ক্ষমতা অপব্যাবহার করার ক্ষমতা রয়েছে, আবার অপরদিকের মানুষটি সেই অপব্যাবহারের ফাঁদে কতটা পা-দেবে, কতটা প্রশ্রয় দেবে সেটাও তার একান্ত ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত। তাঁর নিজস্ব মাইলফলক। যা মিউচুয়াল, তা আমাদের ন্যায় নীতির ঊর্ধ্বে। সেটা ক্রাইমের অন্তর্গত হয় না। তবে অবশ্যই তা দলীয় রাজনৈতিক ঘটনার বেড়াজালে ঢুকে পড়তে পারে।
সাম্প্রতিককালে আমাদের অভিমত আদালতে বেশ ঝড় বইছে। অভিমত আদালত বলতে আমি সোশ্যাল মিডিয়ার কথা বলছি। এই এক হয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই ধরে ধরে এই আদালতে বয়ান না-দিলে যেন রাতের ঘুম চলে যায় মানুষের চোখ থেকে। যে-কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেন অভিমত থাকতেই হবে, নয় পিছিয়ে পড়তে হবে। যেন প্রতিবাদ-ফ্রতিবাদে পৃথিবী— টৃথিবীকে জংলা ভূমি থেকে স্বর্গ রাজ্য করে তুলবেন সকলে! অভিমত আদালতের বাস্তব মূল্যায়ন ক’-আনা ? কেউ বলতে পারবে?
এই ন্যায়-নীতিবিধরা তাঁদের নিজস্ব আইনের আওতায় বাস করেন। কোনও বহুস্তরীয় আত্ম-বিশ্লেষণাত্বক ঘটনা এঁদের আদৌ কী ভাবায়? না এই সম্পূর্ণ ভাবনা প্রকাশ নিজস্ব আত্ম প্রচারের একটি অংশ?
সিয়াটেল, পোর্টল্যান্ড, লস এঞ্জেলেস, টেক্সাসের অস্টিন শহর— ব্ল্যাক লাইভস প্রতিবাদে আবার উত্তাল। শহরের পর শহর এই ফেলে-রাখা আন্দোলনের অগ্নিতে আবার জ্বলছে। কোথাও ভাঙচুর, কোথাও আগুন, কোথাও পেপার স্প্রে, কোথাও জলের বোতল ছুড়ে মেরে রাষ্ট্রবিরোধিতা চলছে লাগাতার। এই যে লড়াই— এর দ্বারাও কী এক চুল এদিক-ওদিক হবে? হয়েছে? বরং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীতা আরও গাঢ় হয়ে চলেছে। তীব্র হচ্ছে তাঁদের মতাদর্শন। আসলে সবার ওপরে ভোট সত্য! 
আমেরিকার খিদে বাড়ছে। অপরাধের খিদে, যুদ্ধের খিদে, স্বাজাতিকতার খিদে। খিদে বাড়ছে খিদেরও। পাল্লা দিয়ে। তাই বেকারত্বর সঙ্গে এবার গুটি পায়ে বেড়ে চলেছে এই দেশের দৈনন্দিন ক্রাইম অথবা অপরাধের তালিকা। যা সামাজিক স্তরে আইনভঙ্গের অপরাধ। যেমন ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা, চুরি, কিডন্যাপ ইত্যাদি।
এখন আবার উল্লেখ করতে হয় কোন তালিকার অপরাধ। সমাজে এখন দু-ধরণের অপরাধ চলে মনে হয়। এক যা আইন বিরোধী, দুই যা ওপিনিয়ন কোর্ট অর্থাৎ অভিমত আদালতে আইন বিরোধী। আইন বিরোধী না হলেও যদি কোনও অপরাধ সোশ্যাল মিডিয়ায় ধরা পড়ে, তবে সেই অপরাধীকে কে বা কারা কী জাতীয় শাস্তি দেবেন তা কিন্তু অজানা। তবু মানুষের মনে বাড়তি ভয় থাকছে। অভিমত আদালতের ভয়। তাতেও যদি অপরাধের সংখ্যা বিশ্বময় এক বিন্দু কমে, অন্তত আগামী প্রজন্ম বর্তে যায়!
সে যাই হোক, কথা হচ্ছিল আইনের অন্তর্ভুক্ত অপরাধ নিয়ে। এই সপ্তাহে নিউ জার্সির এক বিচারপতির গৃহে ঢুকে তাঁর সন্তানকে খুন করে নিজে অপঘাতী হন এক দুষ্কৃতি। বিভিন্ন কাউন্টিতে বাড়ছে গানফায়ারের সংখ্যা। সমাজ-সংসার প্রতি মুহূর্তে বিপন্ন মহামারির হাতে! নাকি এই গণতন্ত্র? নাকি পুঁজিবাদ বিশ্বে, এই হল ফিরে আসা সভ্যতা? 
পণ্য-সম্পর্ক জীবনের প্রত্যেক ধাপে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র এখন জবরদোস্তি, দখলদারিতে মশগুল। ক্রমে মানবতা স্বার্থের খপ্পরে প’ড়ে তাঁর কার্যক্রম সম্প্রদায় গোষ্ঠীর কেনাবেচার দালালিতে গিয়ে ঠেকছে। তৈরি হচ্ছে অবাধ প্রতিযোগিতা। সর্ব স্তরে। 
এই ধনতান্ত্রিক অর্থব্যাবস্থা ক্রমশ পৌঁছে যায় আমাদের শোবার ঘরে। কখন, কীভাবে, কোন পরিস্থিতে— আমরা নিজেও জানি না, জানতে পারি না, জানার চেষ্টাই করি না। তখন ফুরায় না; শুরু হয় সব লেনদেন।
অব্যক্ত প্রতিযোগিতা ঢুকে পড়ে প্রেম, প্রণয়, মূল্যবোধে। সেটাও যখন আমাদের মন-মাথা দখল করে নেয়, বসি গিয়ে সেই ইকো চেম্বারে। তখন ঠিক মধ্যরাত কিংবা ভোর রাতের গাঢ়তায় পড়ে থাক পাহাড়চূড়ার শেষ অস্তরাগ। ক্লান্ত, নেশা শিখে নেওয়া আমাদের দেহ-মন, পুড়ে যায় ব্যাধি নামক আগুনে। যার অ্যান্টিজেন নেই, অ্যান্টিবডি নেই, যার কোনও প্লাজমাথেরাপি নেই। তখন মানুষকে নিজের পথ নিজেই গানফায়ার করে। সে ঘুমতে যায় ক্লান্তির নেশায়। সকালে আবার বেরোতে হবে বলে।
তখন সব হয়, সব বয়ে যায়, সব আসে আবার চলে যায়, বিধি অনুযায়ী... কেবল কলমের ডগায় আর কাব্যের ঋতুস্রাব বয় না… এইভাবেই কালের মৃত কবি মত্ত হয় বিষাদ কান্নায়...!

Post a Comment

0 Comments