বইপাড়া : আকাশ না কি গাঙিনী

আকাশ না কি গাঙিনী 

দীপ শেখর চক্রবর্তী

 
‘তোমাকে কল্পনা করি–
তোমার প্রতিমা গড়ি ছায়া ও কন্ঠের প্রতিধ্বনি দিয়ে,
বুকের ওপর হাত এনে
বসাই মনের মতো মন
সবুজ স্তনের তলে, দুধের ধারার মধ্যে, ধুক-ধুক শব্দের গভীরে।… ’ (অপরাজিতা)

কিছু কিছু বইয়ের ভেতরে একটা প্রাণ থাকে। যেমন দুপুরবেলা ছাদে মেলে দেওয়া শাড়ি বাতাসে ওড়ে, যেমন ভোরবেলা মাঠের ভেতর গেলে দুটি পা ভিজিয়ে দেয় সোনালি শিশির তেমনই কিছু কিছু বই প্রাণের হয়ে ওঠে। তবে প্রশ্নটা হল, কীভাবে?
সেলিম মল্লিকের ‘আকাশ না কি গাঙিনী’ পড়তে পড়তে সেইসব উত্তর দিতে পারি আমি। এক ফর্মার একটি সূক্ষ্ম শরীরের বই। এমন বইকে অনেকে বলে থাকেন চটিবই, যা খুব একটা শ্রুতিমধুর নয়। ঘাসের গায়ের রঙের মতো তার কাগজ-মলাট। প্রথম থেকে শেষ অবধি একটা যত্নের ছাপ। বইটি দেখেই মনে হবে গ্রামের কোনও কিশোরের মুখ। মায়াময়।
কবিতায় কি সে মায়া কম? তবে কবিতার বিষয় কিশোরের হৃদয় নয়। একজনের ভালোবাসার উচ্চারণে যতটা সততা এবং যত্ন থাকে এই বইয়ের প্রতিটি কবিতা তা ধারণ করে। বিশেষত বাংলা কবিতার সেই চিরন্তন গীতিপ্রবণতা যা বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত। শুধু গান নয়, মনে হয় এই কবিতার ভেতরে রয়েছে প্রেমকীর্তন। সেই কীর্তনের ভেতর কোনও চমক নেই, ধীরে ধীরে পাঠকের মর্মস্থলে কীভাবে ঢুকে যায় কবিতাগুলো। পড়ুন, ‘কান্না’ নামের কবিতাটির কিছু অংশ—
‘এত সুখ তোমার আমার মধ্যে চাপা পড়ে ছিল!
চুপিচুপি বূকের তলায় ঠোঁট এনে
দুধের ধারায়
অনুভব করি ঋতুবতী গাছে জন্ম
ফুলের নিকষ কালো গর্ভের আসক্ত ঘ্রাণ, তাকে
রক্তে রক্তে স্নায়ুতে সত্তায় পেয়ে বুঝি—
এও এক দুঃখের অমল রূপ, অনিবার কান্না…।’
কি আশ্চর্য ভাবে দুজনের প্রেমের ভেতর এল শরীরি ভাষা অথচ তা নির্ভার। শব্দের অনায়াস চলন নিশ্চয়ই পাঠক এতক্ষণে লক্ষ্য করেছেন। বুঝতে পেরেছেন এমন কবিতা বানিয়ে তোলা যায় না। দীর্ঘদিন জীবন ও অভিজ্ঞতার সাধনার পর এমন উচ্চারণ কলমে আপনাআপনি এসে বসে।
১২টি কবিতার কোনওটিই দীর্ঘ নয় এবং প্রতিটি শেষ হওয়ার পর মনে হয় শব্দ থেমেছে অথচ থামেনি তার না বলা কথা। ফলে ষোলো পাতার বই আমার কাছে অনন্ত হয়েছে।দৃশ্য ফুটে ওঠে, যেখানে কবি তার অর্জিত সুন্দরের মধ্যে দিয়ে বর্ণনা করছেন জীবন। এই বর্ণনার মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রবলের অশান্তি মুছে যায়, চেতনার ভেতর সামান্য সুখ ফুটে ওঠে পদ্মের মতো।
এতক্ষণে এই শব্দের কাছে পৌঁছতে পারলাম—‘সুখ’। সেলিম মল্লিক তার এক ফর্মার একটি কবিতার বইয়ে আমাকে দিলেন অনন্তের সুখ। সহজের সুখ। ভালবাসার সুখ। সুখ কত সহজ শব্দ অথচ তা কবিতায় ধারণ যে কত কঠিন।
আকাশ অথবা গাঙিনী তা পারে। সেলিম মল্লিক তা পেরেছেন এই বই নামের তৃণে।

সেলিম মল্লিক। অহিরা প্রকাশনী। জানুয়ারি ২০১৭

Post a Comment

0 Comments