লকডাউনের দিনলিপি


সবাই ফেরার অপেক্ষা করছে

পামেলা ভট্টাচার্য


ব ঠিকঠাকই চলছিল। স্বাভাবিক যাপনচিত্র, অফিস, বাড়ি, সপ্তাহশেষে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি। ব্যস্ত এবং নিয়মিত জীবন। কাজের সূত্রে আমি থাকি গুরগাঁওতে। মার্চের শেষে বাড়ি যাওয়ার কথা। টিকিট কাটা আছে। সেই মতো গোছগাছও চলছিল। আচমকাই সেই ব্যস্ততায় একদিন পূর্ণচ্ছেদ। ভারতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। অফিস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। বাড়ি থেকে কাজ করতে হবে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, দেশে ২১ দিনের লকডাউন। ফ্লাইট ক্যানসেল। বাড়ি যাওয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। জীবনের দৈনন্দিন আহ্নিকগতি একলহমায় স্তব্ধ।
নতুন নিয়মে যাপন শুরু। সকালে উঠে অফিসে যাওয়ার তাড়ার বদলে লগ-ইনের তাড়া। অনলাইন মিটিং, ফোনে কাজের কথা আলোচনা, তারমাঝে চায়ের ব্যবস্থা করা। স্তব্ধতা ও ব্যস্ততার মাঝে এক অদ্ভূত মিশ্র সময়ের খেলা। অফিসের কোলাহল নেই, সহকর্মীদের সাথে হাসি আড্ডা নেই। অফিসের পর চায়ের ঠেক নেই। করোনার বিরুদ্ধে টিকে থাকার খেলায় আমার জীবন কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসল। সোম থেকে শুক্র তাও একরকম কেটে যায়, শনি রবি যেন কি এক অদ্ভূত বিষণ্ণতায় ঢেকে থাকে। খবরে ক্রমশ করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলা। কলকাতায় আমার বাড়ি হাই অ্য়ালার্ট জোনে চলে আসা। বাড়িতে সবাই মোটামুটি সিনিয়র সিটিজেনের দোরগোড়ায়। চিন্তা, বাড়ির লোকের পাশে থাকতে না পারার অসহায়তা, একাকীত্ব। বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তায় লোক নেই। সব মিলিয়ে এ যেন এক বিচিত্র অচলায়তন। জানি নেটফ্লিক্স আছে, অ্যামাজন আছে, বই আছে কিন্তু জীবনের বিকল্প বোধহয় কিছুই হয় না। লকডাউনের প্রাথমিক পর্বটা তাই ডিপ্রেশনেই কেটেছে বলা যেতে পারে।
তবু সবকিছুই একসময় জীবনে মিশে যায়, মনখারাপটাও। এক্ষেত্রেও তাই হল, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সাথে যাপনও বদলে গেল। সকাল সকাল উঠে অফিসের কাজ নিয়ে বসা, মাঝে একফাঁকে টুক করে চা, জলখাবার তৈরি। দুপুরবেলা ছোট্ট বিরতি নিয়ে স্নান খাওয়া সারা। বিকেলে কাজ শেষে চা খেতে খেতে গান শোনা, বই পড়া। বাড়িতে ভিডিও কল, বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে লুডো খেলা। আরও বেশি বেঁধে বেঁধে থাকার চেষ্টা। দূরে থেকেও কাছাকাছি থাকার মতো করে বেঁচে থাকা। ক্রমশ এই জীবনটাও আমার অংশ হতে শুরু করল।
লকডাউনে সবথেকে বেশি আমায় আহত করেছে ফাঁকা রাস্তাগুলো। জনপ্রাণীশূণ্য রাস্তায় ধূলো উড়ছে, শুকনো পাতা খসে পড়ছে, সেই শূণ্যতা কোথাও যেন বড়বেশি রিক্ত ঠেকত আমার চোখে। কোলাহলমুখর দুপুরগুলো যখন একনিমেষে মনকেমন করা স্তব্ধতায় আক্রান্ত হল, তখন বারবার মনে হত, “একলা থাকার খুব দুপুরে /একটি ঘুঘু ডাকুক।’’ বুঝেছিলাম, স্তব্ধতাও কান সহ্য করতে পারে না।


স্বেচ্ছায় নিজের সাথে একা থাকা আর বাধ্য হয়ে নিজের সাথে একা থাকার কতটা পার্থক্য তা এই লকডাউনের সময় আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। করোনার সঙ্গে যুদ্ধের থেকেও অনেক বেশি আমায় লড়তে হয়েছে নিজের মনের সাথে।


ধীরে ধীরে আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে মন। ক্রমশ যেন নিজেকে বোঝাতে শুরু করেছে এই যাপনটাই হচ্ছে নিউ নর্মাল। আবার মনের চোরাপথে কোথাও যেন এই বিশ্বাসটাও আছে যে জীবন আবার জীবনে ফিরে আসবে। হয়ত আশাটা আছে বলেই এখনও জীবন বেঁচে থাকার পর্যায়ে আছে। টিকে থাকায় পর্যবসিত হয়নি। সেই দিনটার দিকেই তাকিয়ে অফিসের কাজ সারি, গান শুনি, সিনেমা দেখি, বই পড়ি। ভাবার চেষ্টা করি যে, পুরোটাই হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন, দীর্ঘ একটা দুঃস্বপ্ন। এই অ্যালার্ম বাজলো বলে, ঘুম ভেঙে যাবে। উঠে দেখবো, জীবন ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। আমার অফিস যাওয়ার তাড়া আছে, বাড়ি যাওয়ার জন্য গুছিয়ে রাখা ব্যাগ আছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আছে। চায়ের ঠেক আছে। সবকিছুই আগের মতো আছে। সবাই শুধু আমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছে। জীবনে ফেরার অপেক্ষা করছে।

Post a Comment

0 Comments