বইওয়ালার রবিবার/ ৬ । বই যেন শাড়ি


বই যেন শাড়ি

আবীর মুখোপাধ্যায়


তার মতো মতি। ঠিক তার শাড়ি কেনার মতো।
দোল, দুগ্গোৎসব, দশেরা— মায় চড়ক মেলাতেও সে শাড়ি কেনে। দর নিয়ে, রঙ নিয়ে, কল্কা নিয়ে, পাড় নিয়ে, জমি নিয়ে, আঁচল নিয়ে কত যে কথা! কেবল গৃহে নয়। টেলিফোনে টেলিফোনে সেই বার্তা রটে যায় সুদূর প্রবাসেও। উৎকর্ণ হয়ে শুনি, ওঁদের মেয়েলি আড্ডার শাড়ি-সংবাদ। চমকপ্রদ তথ্যটি হল, তাকে কখনও পাট ভাঙতে দেখিনি বহু শাড়ির!
সে কেনে, পড়ে না!
সত্যি কথা কী, এখন আম বাঙালির বই পড়ার অভ্যেস ঠিক ওই শাড়ি কেনার মতো।

করোনা কেটে গেলে, ২০২০-র আম বাঙালি ঠিক ফি হপ্তায় কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়া যাবে। শেষ দুপুরে অফিস কেটে, মিছিল করে মিলনমেলায় বই-পার্ব্বণে শামিল হবে। মনকেমনের শরৎ এলে পুজোর মাসে পুজাবার্ষিকী কিনবে। নন্দনে গিয়ে টেরি বাগিয়ে বাংলাদেশের বই মেলায় কমিশন খুঁজবে। টিফিন-জল নিয়ে হাজির হবে লিটিলম্যাগাজিন মেলাতেও!
অতপরঃ ‘বুক-বিজয়’ সেরে বাড়ি ফিরে দু’পাতা উল্টেই চিৎ!
ফেসবুকে সচিত্র স্টেটাস, ‘আজকের সংগ্রহ!’ কিংবা প্রি-বুকিংয়ের টোপে পড়ে কোন সই জাল, কোন সই পাকা— সেই নিয়ে গ্রুপ-গর্জাবে! সবই হবে, শুধু বইটি পড়া হবে না! খানিকটা সেই জীবনানন্দের ‘বিলাস’ গ‌ল্পের মতো।
‘‘...তুমি পড়েছ এ-সব বই?
আমি এঁদের আগের দু-এক পুরুষের বই কিছু-কিছু পড়েছি। এগুলো? না, এগুলো কিনে রেখেছি।
অ, কিনে রেখেছ? তারপর?
পড়ব।
কবে?
সময় পেলেই। পাচ্ছি না যে সময় মোটেই।...’’
কেবল ‘আম’ নয়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁঠাল, সরকারি দফতরের আঁশফল এবং লেখক-সংবাদপত্রের জগতের আপেলবাবু-বেদানাবিবিদেরও বই পড়ার অভ্যেসের গড় ছবিটি ইদানিং এক। অথচ, শিক্ষিত-রুচিশীল বাঙালির বই পড়ার চিরদিনের সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি কিন্তু এমন লঘু-রসে ছাপা ছিল না। বিদ্যা-চর্চার গৌরব দিনের সে ইতিহাস মস্ত। মাত্র কয়েক দশক আগেও এক একজন দিকপাল বাঙালির পড়াশোনার বহর দেখলে হতবাক হতে হয়! কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বলছেন, ‘মুদ্রিত সব বাংলা বই-ই পড়েছি, অমুদ্রিতও কিছু কিছু’, তো কেউ শিক্ষকের কোনও একটি বই-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে সারাদিন ধরে তাঁকে নানা কথা প্রসঙ্গে সেই বই থেকেই উদ্ধৃতি শোনাচ্ছেন! কেউ আবার ঘটা করে বন্ধুর বই-প্রকাশের দিনেই অনুষ্ঠান-মঞ্চে হাজির গোটা বই লাল দাগে দাগিয়ে!
এখন পার্কস্টিট্র, কফিহাউস, শপিংমলে ঘটা করে বইপ্রকাশ আছে, কোহল-সন্ধ্যায় লিটারেলি মিট আছে। সে দিনের সেই বিদগ্ধ বই-চর্চা উধাও!

আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক গদ্যের বইটিও লিখেছিলেন একজন বাঙালি। ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ রামরাম বসু।
উইলিয়ম কেরিকে রামরাম বাংলা শেখাতেন। ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে তিনি ৫০ টাকা বেতনে যোগ দেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে। ঠিক এক বছরের মাথায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রথম বাংলা গদ্যের বই ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’। লিখলেন ‘লিপিমালা’।
রামরামের সহকর্মী সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করলেন ‘বত্রিশ সিংহাসন’। একে একে লেখা হল, ‘হিতোপদেশ’, ‘রাজাবলি’, ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’।
আর এ সব বই ছাপা হল শ্রীরামপুরে।
আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, কেরির ছাপাখানায় ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে কেটে কেটে কাঠের বাংলা হরফ করেছিলেন একজন বাঙালি।
পঞ্চানন কর্মকার।
বাংলা বইয়ের বাজার বুঝে, সেই প্রেসেরই কম্পোজিটর গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য কলকাতায় এসে নিজের উদ্যোগে ছাপলেন প্রথম সচিত্র বাংলা বই, ‘অন্নদামঙ্গল’। লেখার সঙ্গে কাঠ খোদাই ছ’খানা ছবির ব্যবহারে বাংলা প্রকাশনা আর এক ধাপ এগিয়ে গেল।
উনিশ শতকে কলকাতার শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে নানা প্রতিষ্ঠান ও বিদ্বৎসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাভ করে। তবে বাঙালির পাঠ অভ্যেস তৈরিতে উইলিয়ম জোন্সের প্রেরণায় এশিয়াটিক সোসাইটির ভূমিকাও উল্লেখ্য। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার!—  বাঙালির বিদ্যাচর্চার পথে মাইলফলক নাম।
ডিরোজিওর প্রেরণায় ১৮২৮-এ প্রতিষ্ঠা হল অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল। যেন সু-পবন বইল।
ক্রমে বাঙালির বিদ্যাচর্চা ও সংস্কৃতি চর্চার মোড় বুঝি গেল ঘুরে।
বাঙালির পাঠ অভ্যেস নয়, বই নিয়েই রীতিমতো সোরগোলের, সে এক শহর ছিল কলকাতা!

শহর থেকে দূরে, কলকাতার বাইরেও বই-চর্চা ছিল।
মফস্সলেও একসময় বেশিরভাগ বাঙালি পরিবারে খুব ছোট হলেও নিজস্ব বইয়ের সংগ্রহ ছিল।
ছিল পারিবারিক গ্রন্থাগার আর তার বিচিত্র নাম। ন’কাকা, ছোটকাকি, রাঙা পিসি, মল্লিকপুরের ঠাকরুন, বড় দিদান, সেজো দাদুর নাম লেখা জীর্ণ পাতার উপহার সংগ্রহ। স্মৃতির মেহগনি দেরাজ খুলে ন্যাপথলিন গন্ধে ছিল আশ্চর্য এক মনকেমন। পাতা উল্টেই কখনও বা মিলত শুকনো নিমপাতা। কখনও হলদে খামে কবেকার গোপন চিঠি।
এসব নিয়েই ছিল বাঙালির বই পড়ার অভ্যেস!
প্রায় সব বাড়িতেই পঞ্জিকা যেমন মিলত, মিলত কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশিদাসী মহাভারত, গীতা। বিয়েতে উপহার পাওয়া শরৎ-সাহিত্য, বঙ্কিম, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, প্রফুল্ল রায় শোভা পেত কাঠের আলমারিতে। নিতান্ত গৃহকোণে শোভা নয়, হাত থেকে হাতে ঘুরতো সে বই। শহুরে পরিবারে অবশ্য এসব বইয়ের পাশে জায়গা করে নিত সাগরপারের হাওয়া। কমলকুমারের পাশে কাফকা। গোলাম মুরসিদের পাশে দিব্যি গেটে!
গীতবিতানের পাতা ফরফরিয়ে উড়ত শক্তি-সুনীলের পদ্যসমগ্রের পাশে!
পাড়ায় নতুন বই এলে পড়শি পাড়াতেও ঘুরত সে বই।
আর এখন?
ফেসবুকে ঘুরছে। লাইক। লাইক!




Post a Comment

0 Comments