ব্লগ : ওদের কথা/ ১০ । সুন্দরবনের লেবারের মেয়ে

সুন্দরবনের লেবারের মেয়ে

মঞ্জীরা সাহা


সুকুমারী ঘাটে পৌঁছিয়ে সামান্য টিমটিমে বাল্বের আলোর নীচে ভ্যান ঠিক করা হয়েছিল। সেই বাল্বের আলো যেটুকু ছড়িয়েছিল তারপর আবার সেই অন্ধকার। মিনিট পাঁচেক গিয়ে ভ্যান দাঁড়িয়ে পড়ল। মৃত বাবলুর সর্দারের বাড়ি অবধি আর ভ্যান যায়নি। বলল এবার মাঠ দিয়ে হাঁটতে হবে। মোবাইলের টর্চ ফেলতে ফেলতে ভালো করে তাকিয়ে যে জায়গায় পা দিয়ে দিয়ে হাঁটছিলাম। পায়ের জুতোর ফাঁক দিয়ে ঘাসগুলো সুড়সুড় করে লাগছিল। প্রতিবারেই মনে হচ্ছিল অন্য কিছু নয়তো! না। অন্য কিছুর কামড় খাইনি।
রাঙবেলিয়া টেগর সোসাইটির যিনি সাথে গেছিলেন তিনি আর সাথে ভ্যান চালক দেবু। ভটভটি ভ্যান চালক দেবুর সন্ধানেই এ পরিবারের খোঁজ পাই। ওরা একটা অন্ধকার ইটের দেওয়ালের জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওটা বাড়ির পিছন দিক। ইটের প্লাস্টার ছাড়া টিনের চালার এক খানাই ঘর। তার পিছনে বেশ কিছুটা আগাছা জঙ্গল লতা পাতা এদিক সেদিক দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির পিছনে গিয়ে টুম্পা টুম্পা করে দু তিন বার ডাকাতে ভেতর থেকে আওয়াজ এলো কে কে করে। এই উত্তরটা দিতে বেশ কিছুটা সময়ে নিয়েছিল। বাড়িটাতে কোনও প্রাচীর বেড়া নেই। দেওয়ালের পাশ দিয়ে এগয়ে চলে গেলাম সামনের দিকে। পিছনে মাঠ সামনেও মাঠ। মাঠের সামনেটা অল্প জায়গায় ঘাস কিছটা কম। ভাঙা চোরা টিন লোহার কিছু এদিক ওদেকে পড়ে আছে।
বাড়ির ভেতরের মানুষদের ‘কে’ আমি সে কথা বুঝতে আবার বেশ কিছুটা টাইম লাগলো। এ বাড়ির ভেতরের যা পরিস্থিতি তাতে আমার মতো হঠাৎ আগত অচেনা কোনও মানুষ কেন এসেছে একথা বুঝতে টাইম লাগারই কথা। ভটভটি ভ্যান চালক দেবু দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বেশ কিছুটা বলার পর দুজন বাইরে বেরিয়েছিল। একখানা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে আনলো ভেতর থেকে। রাখলো উঠোনের মাঝখানে। একটা চেয়ার ঘর থেকে এনে আমাকে বসতে দিল। ওরা বসল উঠোনেই ইট বা কিছু একটার উপর মাটিতে।  যা বলেছিল সবটা টুম্পাই বলেছিল।


টুম্পা বাবলু সর্দারের বড় মেয়ে। ছোটটি রূপা। কাচে জোড়া তাপটি মারা কম করে রাখা হ্যারিকেনের আলো প্রাচীর ছাড়া বাড়ির সামনে খোলা মাঠে ছড়িয়ে পড়ল। ওই হাল্কা সামান্য আলোয় টুম্পা রূপার মুখের এক্সপ্রেশন গুলো চোখে পড়েনি। দেখা হয়নি মৃত লেবারের মেয়ের বাবার মৃত্যুর বর্ণনা দিতে চোখ মুখ কেমন বদলাতে থাকে। শুধু কথাগুলো কানে আসছিল। টানা ঝিঁঝিঁর ডাকের মধ্যে চার পাশের ধূ ধূ মাঠের ভেতর বসে শোনা কথাগুলো আজোও মনে গেঁথে আছে। এ বাড়িতে কোনও একটা সময়ে অপেক্ষা চলেছিল বাবার লাশ ফেরার। আদৌ বাবলু সর্দার বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সে কথা জানতেও টুম্পা সর্দার আর ওর মা সোনালী সর্দারকে অনেক ছুটোছুটি করতে হয়েছিল। তবে গিয়ে জানতে পেরেছিল কিছুটা। ওদের বাবা তখন কেরালার হাসপাতালে। আদৌ হাসপাতালে না কন্সট্রাকশান সাইটে কাজ করছে সে কথা দিন দশেক ওদের জানা ছিল না স্পষ্ট। সন্দেহ হাসপাতালেই ছিল। পনেরো তলা বিল্ডিং এর কাজ করতে গিয়ে ওই উঁচু বিল্ডিঙের কোনও এক তলা থেকে পড়েছিল একেবারে লোহার মেশিনের উপর। একথা শুনেছিল অন্য এক লেবারের মুখে তাও বেশ কিছুদিন পরে। এ ঘটনার ডেট টাইম ওদের জানা নেই। কারণ দিন সাতেক ধরে যত বারই এখান থেকে ফোন গেছে টুম্পার বাবা ফোন ধরেনি!

বারবার বাবার ফোনে করে যাওয়ার পর কোনও একদিন অন্য কেউ ফোনটা ধরে বলেছিল, তোদের বাবা তো হাসপাতালে, এক্সিডেন্ট হয়েছেরে। ব্যাস এটুকুই। কিন্তু সে এক্সিডেন্ট যে কোন দিনে হয়েছিল কখন হয়েছিল সে কথার উত্তর ওরা আর দেয়নি। এভাবে আবার চলল বেশ কিছুদিন। হাসপাতালের ঘটনাগুলো শেষ হয়ে যখন ওর বাবার শরীর মর্গে তখনও ওরা এরকমই একটা অন্ধকারে। জানা গেছিল পরে। পাড়ার ঠিকাদার এসেছিল এ বাড়িতে খবর দিতে। সেই থেকে শুরু হয় অন্য একটা পর্ব। কোম্পানি লাশ ফিরিয়ে দেবে বলেছিল। আর এরা চেয়েছিল ক্ষতি পূরণ। সেই নিয়ে চলল দর কষাকষি। শেষে ওর মায়ের দেওয়া দর আর কোম্পানির দরের মাঝের কোনও একটা অঙ্কে থামল এসে কথা। তবে ওর মায়ের কথাগুলো গেছিল ঠিকাদারের মুখ থেকে। আর কোম্পানির মালিকের কথাগুলো শুনেছিল ঠিকাদারের গলায়। এদের হয়ে কথা বলে দিয়েছিল ঠিকাদার। এই ঠিকাদার কোথাকার জানতে চেয়েছিলাম আমি বড় মেয়েটির কাছে। সে বলল—
‘‘ওই ঠিকাদার তো আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। এই তো এইখানে! আমাদের কে যাবে বলেন কেরালা? মা অনেকবার সেই ঠিকাদারের বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করেছিল। আমি যেতাম কতবার করে। ঠিকাদার শেষে বলল, যাবো আমি কেরালা তোর বাবার বডি আনতে।’’
কথার মাঝেই খুব জোরে শেয়াল ডেকে উঠল। বড় মেয়েটি ক্লাস নাইনে উঠে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। ছোটটি পরে সিক্সে। আস্তে আস্তে অন্ধকারটা আমার চোখ সওয়া হয়ে আসছিল। অল্প অল্প করে দেখতে পাচ্ছিলাম একটু বেশি। টুম্পা একটা নাইটির উপর গামছা বুকে জড়িয়ে বসা। পাশেই ওর কাঁধে একখানা হাত রেখে ছোটবোন রূপা ফ্রক মতোন পরে দিদির গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। খুব রোগা এই ছোট মেয়েটি। কথা শুনছি, আর দেখছি।
‘‘বাবার বডি এসেছিল একখানা কালো প্লাস্টিকে মুড়ে। ট্রেনে করে এসেছিল হাওড়া অবধি। তারপর একখানা হাতি গাড়িতে এসেছিল গদখালি ঘাটে। সেখান থেকে ফেরি রিসার্ভ করে পাড়ার ছেলেরা আর ঠিকাদারে বডি নিয়ে এসেছিল এই বাড়ি অবধি। রাত হয়ে গেছিল বডি আনতে আনতে। মুখ কেমন ফুলে উঠেছিল। আমার বাবা ছিল রোগা মানুষ ফুলে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছিল। চিনতেই পারিনি আমরা!’’
বডি এসেছিল দু বছর আগে এরকমই জুন মাসে।
ঠিক আমি যে উঠোনে চেয়ারের উপর বসা এখানেই হয়তো শুয়েছিল কালো প্লাস্টিকে মোড়া বাবলু সর্দারের বডি। শেয়াল ডেকেই চলেছে এখনও। এই ঘন কালো মাঠের ভেতর আমার সামনে বসে থাকা দুটি মেয়ে দেখেছিল কালো প্লাস্টিকের মধ্যে শুয়ে থাকা একটা মৃত ফুলে ওঠা শরীরের চোখ নাক কান। তাদের চেনা সেই নিজের বাবার চেহারার সাথে মেলাতে চেষ্টা করছিল ওই বডির। যাকে আরও বছর দুই আগে শেষ দেখেছে তার চেহারার সাথে এই ফুলে ওঠা লাশের কোথায় মিল কোথায় অমিল খুঁজে বেড়াচ্ছিল এই সামনের কিশোরীদের দু জোড়া চোখ। কবে পড়ল ওই উঁচু বিল্ডিং থেকে, কবে মারা গেল, কতদিনই বা মর্গের ঠান্ডা ঘরে শুয়ে রইল— সে সব সন্দেহ নিয়ে খুঁজে বের করে চলেছিল ফুলে ওঠা বডি থেকে বাবার চেহারাটাকে। এই জঙ্গল ধুধু মাঠ আর ফেলে দেওয়া ভাঙাচোরার জিনিষের ভেতর ওদের বাবার বডি যখন শুয়েছিল এ বাড়ির এই ঘাস গজানো উঠোনে আশপাশের পাড়ার মানুষ জমা হয়েছিল। তখন এ উঠোনের চেহারাটা কেমন দেখাচ্ছিল ওই প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে বসে ওর কথা গুলো শুনতে শুনতে সেদিনের এ উঠোনের চেহারা আমার কল্পনায় ভেসে উঠছিল।
মেয়েটির কথাটা শেষ হওয়ার আগেই পাশ থেকে দেবু ভ্যান চালক কথা শুরু করল অত্যন্ত উৎসাহের সাথে— ‘‘আর ওই কথাটা বল, সেই টাকার কথাটা। বল বল…!’’
টুম্পা আবার শুরু করল। এবার গলার আওয়াজটা পালটে গেছে। একটু আগে আওয়াজটা যেমন মৃদু ছিল সেই আওয়াজে জোর বেড়ে গেছে। স্পিড বেড়েছে কথার।
‘‘জানেন তো ঠিকাদার আমাদের হাতে কিচ্ছু দেয়নি। সেই মা কত বার ছোটাছুটি করল। আগেও ছুটেছিল। আবার সেই পরেও— কতদিন গেছিল ওর বাড়ি। বলেকি কোম্পানি সব টাকা দেয় নাই রে। যা দিয়েছিল বডি আনতেই সব খরচা হয়ে গেল। মালিকের সাথে কথাই বলিয়েই দিল না মা কে একবারও। বলল ওই ভাষা বুঝবি নাকি তোরা ও কেরালার ভাষা কি বুঝবি ওই সব ভাষার? সব পলিটিকাল ব্যাপার জানেন দিদি সব পলিটিকাল ব্যাপার।’’
ঘন অন্ধকারের ভেতর শেয়াল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ধুধু মাঠ আর মাথার উপর এতোবড় একখানা আকাশ মধ্যে হঠাৎ কিরকম অবাক লাগলো ‘পলিটিকাল’ ব্যাপার শব্দটা শুনে!
একটু আগেই যখন জটিরাম পুর ঘাট ছাড়ছিল খেয়াটা আস্তে আস্তে অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে পড়ছিলাম। পাশে বসে থাকা মানুষটাকেও আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল মাথার উপর মেঘলা আকাশ আর নীচে বিশাল আয়তনের কালো জলই কেবল সাথে চলেছে। আসলে ওই ফেরির ডিজেল পোড়া গন্ধ ভটভট আওয়াজের সাথে যে সেই কোন কাল থেকেই অন্যকিছুও ঢুকে পড়েছে এই বন জঙ্গলের ভেতর সে কথা ভুলেই গেছিলাম। এখানকার ম্যানগ্রোভ বাঘ হরিণ নোনা জলের নদী অন্যরকমের সুন্দর প্রকৃতি দেখতে কোথা কোথা থেকে আমরা এসে ভিড় করি। এই অন্ধকার প্রকৃতির ভেতরও কোথায় কোথায় পলিটিক্সে এসে ঢুকে রয়েছে তা আমাদের বাঘ ভালুক ম্যানগ্রোভ দেখতে এসে ভাবার দরকার হয় না। এসবের ফটো তুলে পোস্ট করতেই ব্যস্ত হয়ে যাই। হোটেলে বসে কাঁকড়ার ডিশ অর্ডার করি। কাঁকড়া মেরে রান্না হওয়ার গল্পটা আমাদের কাজে আসে না!





Post a Comment

3 Comments

  1. খুবই জীবন্ত লেখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ শতানীক

      Delete
    2. অনেক ধন্যবাদ শতানীক

      Delete