লকডাউনের দিনলিপি

করোনা ক্রান্তি

নন্দিতা আচার্য্য   


মার্চের মাঝামাঝি পুরুলিয়ায় নিমন্ত্রণ; একটি পুরস্কার পাওয়ার কথা। পুরুলিয়া আমার প্রথম যাওয়া হবে; এসময় নাকি পলাশ ফুলে লাল হয়ে থাকে সে জায়গা। এদিকে বাড়ি থেকে বলা হচ্ছে, চিনের উৎপত্তি করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়েছে ইন্ডিয়াতে; এখন বাইরে বেরনো রিস্কি। কিন্তু অযোধ্যা পাহাড়, জঙ্গল, আর সাহিত্যের আড্ডা আমাকে নিশির ডাকের মতো হাতছানি দেয়। তখন দিল্লিতে ঢুকে গেছে করোনা। সাবান, স্যানিটাইজার পকেটে নিয়ে একটু দুরুদুরু বক্ষে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
সে সময় একেবারেই বুঝিনি, ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ এক জীবাণু এমন ভাবে সমস্ত কিছু ওলট পালট করে দিতে পারে। চিন থেকে আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রিটেন... খবর পাচ্ছিলাম তার কীর্তি কাহিনীর। ভীত ব্যাথিত হচ্ছিলাম সে সব দেশের নাগরিকদের জন্য; পরবাসে থাকা বন্ধু আত্মীয়দের জন্য। কিন্তু তা যখন আমারই শহরে গোত্তা মেরে ঢুকে পড়ল; অন্য সকলের মতো আমিও প্রবল ঝটকা খেলাম। দেখ না দেখ; লক ডাউন শুরু। জানলার পাশে গালে হাত দিয়ে বসে ভাবলাম, লক ডাউন? এর সারমর্ম কি!
পরদিন সকাল থেকে বন্ধ হয়ে গেল গৃহ পরিচারিকাদের আসা যাওয়া। আবাসনের বিরাট গেট দাঁতে দাঁত আটকে থাকার মতো ঝাঁপি ফেলল। সব্জি, মাছ, দুধ, খবরের কাগজ... সবই একটু খানি ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে নেওয়া। অনেকদিন বাদে রান্না করতে ঢুকলাম; খারাপ লাগল না। এর সঙ্গে বাড়ির যাবতীয় কাজ ; সারতে সারতে বেলা গড়িয়ে যায়। ক্রমশ লেখা-পড়ার নিজস্ব সময় কমতে থাকে। প্রায়শই ‘ভাল্লাগে না’ ভাব আসে। এসব কাটানোর জন্য নতুন নতুন রান্নায় মনোনিবেশ করি।
পাড়ার দুটো ভাতের হোটেল এবং একটি বিখ্যাত মাংসের দোকানের কল্যাণে লালু কালু সাদা... ইত্যাদি নেড়িদের চেহারা রীতিমত পালোয়ান সুলভ। কিন্তু এখন সেগুলো সব বন্ধ। আমার ‘রান্না খাওয়া বাসন মাজা’র ঘাম ঝরানো নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে আর একটি আবশ্যক কাজ এসে যুক্ত হল; বেওয়ারিশ ম্যাওপুসি এবং লালুদের জন্য রান্না করা। তারপর হাঁড়ি নিয়ে শুনশান রাস্তায় গিয়ে তাদের পরিবেশন করা। এসবই হত রাত্রে; সকালের লাঞ্চে দিতাম বিস্কুট। সেও বাড়ন্ত; এখান ওখান থেকে অতি কষ্টে জোগাড় করা। এরপরও আমার গ্লানি আসত; নিজের বাড়ির সবাইকে তো সারাদিন রেঁধে খাওয়াচ্ছি; ওদের বেলায় শুধু ডিনার কেন!



রাতে রাস্তায় পুলিশ টহলদারি আরও বেড়ে যায়। তারই মধ্যে মোড়ে মোড়ে পাড়ার ছেলেদের জটলা। চাপা গলায় কথাবার্তা। তারা হেল্প করার জন্য ডেকে ডেকে আমার বাছাদের নিয়ে আসতো। পুলিশের গাড়ি যদি দেখতে পেত, এসে ওদের ওপর প্রচণ্ড চোটপাট করত। আর আমাকে বলত, ম্যাডাম... মুখে মাস্ক পরুন। তবে পুলিশের সঙ্গে ওদের বেশ লুকোচুরি চলতো। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলেই বাঁশি বেজে ওঠে; কাছে দূরে যদ্দুর শোনা যায়, দুরদুরিয়ে প্রকাশ্য রাস্তা থেকে সবাই আড়ালে। পুলিশ মশাইরা সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আশপাশ দেখতে দেখতে ছানপোনা সহ আমাকে আবিস্কার করত; তারপর হতাশ হয়ে চলে যেত। প্রচণ্ড ব্যস্ত এই রাস্তাটির ঘুমন্ত রূপ রাতের বেলায় প্রতিদিনই আমাকে মুগ্ধ করত; এ যেন অন্য এক দেশ!
শুধু রাস্তাটিই নয়; মাথার ওপরের আকাশ, ক্যাম্পাসের বাগান, রাস্তা ...সব কিছু যেন বদলে গেছে; ভেতরের স্নিগ্ধ বিশুদ্ধ রূপটি উদ্ভাসিত হচ্ছে। ফুলের গন্ধ আরও তীব্র হয়ে নাকে লাগে। মাস্কের আড়ালে মুখগুলি চিনতে পারি না। সিঁড়িতে, লবিতে, লিফটে...  মুখোমুখি হলে ছিটকে সরে যাই আমরা সবাই। প্রকৃতি দিন দিন সুন্দরী হয়ে ওঠে; আর আমরা মানুষেরা ভয়ে চিন্তায় কুঁকড়ে যেতে যেতে ক্রমশ শামুকের মত খোলস বন্দি হই; এই রুপান্তর কি আমাদের কাম্য ছিল! আমি কি কোনদিন ভোরের বেলা, ঠিক এই সময়টাকে দুঃস্বপ্নে পেয়েছিলাম?
প্রথম দফা লক ডাউন উঠলো। মানুষ কাজেকম্মে রাস্তায় বেরোয়। আগের চেয়ে যানবাহন কম; গরীব মানুষের কষ্টের শেষ নেই। আমিও মাস্ক টুপি চশমা ইত্যাদি সহযোগে কাজে বেরলাম। দরদর করে ঘামতে ঘামতে অনুভব হল ; মানুষ বড় দুঃখী, একা হয়ে গেছে। বন্ধুর চেয়েও এক ঢোঁক জল চেয়ে খেতে পারে না।  ক্রন্দনরত বন্ধুর কাঁধে আলতো করেও আর হাতটি রাখতে পারে না।
একঘেয়েমি কাটতে চায় না; বন্ধুরা মিলে ফোনাফুনি..... কবিতা পড়ি, গল্প করি। বৈধ আর অবৈধ প্রেমিক প্রেমিকাদের বিপর্যয় নিয়ে হাসাহাসি করি। বৈধরা তবু মুখটুক ঢেকে দেখা করছে; কিন্তু গোঁয়ার অবৈধ প্রেম? একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে! এসবের উদাহরণ খুঁজে, তা বিশ্লেষণ করতে করতে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি।
এখন আমার বাড়ির পেছনে নতুন কন্সট্রাকশনে লেবাররা সকাল থেকে কাজে লেগে পড়ে; কারুর মুখে মাস্ক নেই। রাস্তায় ঠাসা ঠেসির অটো বাসে, মুখ ঢাকা মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি, করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
হারিয়ে যাওয়া বুলবুলি আর বউকথাকও’র ডাক, ফিঙে, চড়ুই, নাম না জানা আরও কত পাখি... তাদের উজ্জ্বল বর্ণ, অচেনা সুর, জুঁই বেলির তীব্র গন্ধ;  এসব কোনও কিছুই আর মনকে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি দেয় না। মনে মনে কামনা করি প্রিয়জনের সান্নিধ্য, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, নদী-পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্র; কবে ফিরে পাব আমার চেনা পৃথিবী!
একাকীত্ব বড় প্রিয় ছিল; কিন্তু এমন একাকীত্বও কি চেয়েছিলাম?

শিল্পী : প্রমিতা বারুই

Post a Comment

0 Comments