স্মৃতির সখ্য : কিছু কিছু ঢেউ

কিছু কিছু ঢেউ

সংঘমিত্রা ঘোষ


(এই নে কথা রাখলাম)
“যে সব প্রাপ্তির পাপড়ি ভাঙে না
ছুঁয়ে ফেললেও
উড়ে যায় ... ডানা অর্জন করে”।
(পাতাবাহার, সুপ্রভাত রায়)
আমার এক বন্ধুর সঙ্গে এক সময় রাতের পর রাত জাগা কথা হত। কয়েক বছর বয়স হল যখন বন্ধুত্বের, একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি তাঁর মৃত ভাইয়ের কথা বললেন। অসময়ে মৃত্যু, স্যুইসাইড, সে প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু না বলে চলে গেলেন অন্য কথায়। বুঝলাম তাঁর যন্ত্রণার ভার বড় বেশি। বড় বেশিই ব্যক্তিগত, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। প্রেম, বিচ্ছেদ, শোক... এ সব ভাবগুলি অত্যন্ত ব্যক্তিগত অনুভব। এ সব অনুভূতির প্রকাশ সম্ভব হয়না সব সময়। একান্ত কাছের মানুষের পরিসরেও বলা হয়ে ওঠে না। গভীর মৃত্যু শোকের মধ্যে দিয়ে গেলেও, দেখেছি একটি শব্দও বলে উঠতে পারেন না এমন মানুষদের।
মৃত্যু আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে স্পষ্ট সত্য। সেই সত্যের জন্য আমরা প্রস্তুত থাকলেও ঘটনা ঘটার পর, আমরা তাকে বহন করি, নিজের নিজের মতো করে। ব্যক্তি বিশেষে তার ভার ও মাত্রা পৃথক হয়ে যায়। আমিও এক স্বাভাবিক দিনে অনুভব করে ছিলাম মৃত্যুকে। যে মৃত্যু অস্বাভাবিক, অসময়ের মৃত্যু। আমরা যারা একই সঙ্গে, একই সময়ে, একই ব্যক্তিকে হারানোর শোকে আচ্ছন্ন ছিলাম, তখনও জানতাম না, এই আমাদের মধ্যে থেকে কয়েক বছর পর পিকা চলে যাবে আকস্মিক। এতদিনে আমরা যারা আছি তারা, তাঁদের অনুপস্থিতি মেনে নিয়েছি আর মনে মনে লালন করছি, অপেক্ষা করছি ওপারে গিয়ে হুল্লোড় করার জন্য। আসলে মৃত্যু হলে যত না বিচ্ছেদ হয়, বিচ্ছেদ হলে মৃত্যু হয় তার থেকে অনেক বেশি। শারীরিক মৃত্যু ঘটলে দৃশ্যত আমাদের বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু তার স্মৃতির সঙ্গে আর এক চলা শুরু হয় মৃত্যুর পর। সন্তান হারা মাকে দেখেছি এই চলায়, প্রেমিকাকে দেখেছি, কন্যাকে দেখেছি, শিষ্যকে দেখেছি, বন্ধুকে দেখেছি, মৃত্যু লালন করে, বহন করে তার সঙ্গে চলতে। লালন শব্দটা সচেতন ভাবেই বলছি। কারণ স্মৃতিকেও লালন করতে হয়। উল্টোটাও দেখেছি, শারীরিক মৃত্যু না ঘটলেও কীভাবে স্মৃতিদের মৃত্যু ঘটে যায় ধীরে ধীরে। আমাদের জীবনে, মৃত্যুর সত্যতা মেনে এমন করেই চলতে থাকে, স্মৃতির সঙ্গে ওঠাবসা।
পিকা, সুপ্রভাত রায়। বোলপুর ডাকবাংলো মাঠে বইমেলায় কবিতা পড়তে গিয়ে আলাপ। এক শহরের প্রতিবেশি, সময় লাগেনি হৈ হুল্লোড় করা বন্ধুত্ব যাপন করতে। ওর হাত ধরে আমার বন্ধু পরিবার বেড়ে গেল অনেকটা, ওরও বেড়ে গেল আমার হাত ধরে। সেই পরিবারে আমরা এখনও রয়ে গেলাম। সবুজদা আর পিকার বড় বেশি তাড়া ছিল, ওরা চলে গেল।
পিকা এমনিতে অসম্ভব অগোছালো মানুষ হলেও, ওর কবিতার খাতা ছিল ঝকঝকে করে গোছানো। আমি ওর কবিতার খাতা দেখে চমকে উঠেছিলাম। খাতার এক পাতায় ছিল কবিতা আর এক পাতায় ছিল নানা পত্রিকার ছবি কেটে কোলাজ। আমি বলতাম তোর কবিতার বই, তোর খাতাটাই হতে পারে। এত ভালো অলঙ্করণ! ওর প্রথম কবিতার বই ‘বায়োডাটা’ (ফেব্রুয়ারি, ২০১০), প্রচ্ছদ শিল্পী- চারকোল (ভুটু)। ভুটু পিকারই বন্ধু। বায়োডাটার ভাবনা ছিল- প্রথম বই তাই সেটা বায়োডাটা হতেই হবে। ছোটোবেলাকে উৎসর্গ করেছিল বইটি। বায়োডাটাতেই লিখেছিল-
“মৃত্যুটা হাতে দিও। তারপর
ভগবান তোমাকে একদিন দেখে নেব।”
কী জানি মৃত্যুকে হাতে নিতে চেয়েছিল কেন পিকা? বায়োডাটাতেই লিখেছিল “সব পরিণতিই বিচ্ছেদ/ শুধু মাঝখান জুড়ে নৌকা পারাপার”। জীবন সম্বন্ধে একটা পজেটিভ ভাবনা ছিল ওর, যা ওর লেখায় বারবার ঘুরে ঘুরে এসেছে। বায়োডাটার পর ‘টিপসই’। তারপর ‘গত জন্মের মেমরিকার্ড’ ওর প্রথম গদ্যের বই। প্রচ্ছদ করেছিল পার্থপ্রতিম দাশ, আমাদের বন্ধু। প্রথম কবিতার বইয়ের পরে, এই বই নিয়ে ওর উত্তেজনা ছিল সবচেয়ে বেশি। বই রেডি হয়ে গেল, গরম বই এসে পৌঁছালো আমাদের বাড়িতে। পিকা বলল “ফাটিয়ে কিছু লেখ তো বইটা নিয়ে।” আমি বললাম, লিখব। বন্ধুর বই, ভালো করে সময় নিয়ে লিখতে হবে তো! কিছুদিনের মধ্যেই ফেসবুক জুড়ে বের হতে থাকল ওর বইয়ের রিভিউ। আর ও আমাকে বারবার লেখার জন্য বলতেই থাকল।কিন্তু আমি আজ-কাল-পরশু করে লিখে উঠতে পারলাম না ওর বইয়ের কথা। নিজের প্রতি আর নিজের মতো হয়ে যাওয়া মানুষদের প্রতি অবহেলা আমার জন্মগত স্বভাব। তখনও বুঝিনি, অবহেলার ফল বড় বেশি ভারি হয়ে যাবে জীবনে। ‘গতজন্মের মেমরি কার্ড’ সারাজীবনের ক্ষত হয়ে বলবে, অবহেলারা মুখ ফিরিয়ে হেঁটে চলে যেতেই পারে, এমন রাস্তায়, যে রাস্তার ঠিকানা মানুষ খুঁজে পাবে না কোনো দিনও।
পিকা আর আমি প্রায় সমবয়সি। আমাদের বেড়ে ওঠার চিহ্নগুলোও একই। আমাদের সময় মোবাইল ছিল না। মেমরি কার্ডের মতো কোনও বাক্স ছিল না স্মৃতিদের জমা রাখার। আমাদের ছোটোবেলা আমরা বহন করছি আমাদের মনে। পিকার ‘গতজন্মের মেমরি কার্ড’ সেই স্মৃতিদের ডাইরি। আমাদের ছোটোবেলার চাবি সেই সময়ের উপর গড়াগড়ি দেবার খাজানা। আমাদের সময় আকাশে হেলিকপ্টর দেখলে আমরা হৈহৈ করে দলবেঁধে বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকাতাম। পৌষ মেলায় হেলিকপ্টার নাগরদোলায় চাপাই ছিল আমাদের আকাশে ওড়া। আমাদের ছিল সাইকেল, আমাদের ছিল এন্টেনা লাগানো সাদাকালো টিভি, পাড়ায় পাড়ায় বহুরূপী, আকাশে ওড়া ঘুড়ি, কাগজের নৌকা, প্রশ্নবিচিত্রা, জলমালাই আইসক্রিম, ডিডি ওয়ান চ্যানেল, আমাদের খেলা ছিল ছোঁয়াছুঁয়ি, ডে-নাটট ক্রিকেট আরও হরেকরকম। সুপ্রভাত তার নিজস্ব স্টাইলে, ভাষায় লিখে গেছে সেই সময়ের দলিল। আমাদের পাওয়া ছিল অল্প, তাই কল্পনার আকাশ ছিল অনেক বড়। সেই সময় আমাদের ভয়, ভালোবাসা, প্রেমের মধ্যেও যত না বাস্তবতা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল কল্পনা। সুপ্রভাত আমাদের সেই সাদাকালো সময়কে তুলে রেখে গেল ‘গতজন্মের মেমরি কার্ডে’। যখনই আমার মন খারাপ হয় আমি ডুব দিতে পারি এই বইটাতে। আমি কথা বলতে পারি আমার ছোটোবেলার সঙ্গে। সুপ্রভাত লিখেছে- “আইইইসক্রিম-আইইইস্ক্রিম-আইইইসক্রিম, এর থেকে টানের নিশি ডাক আমি শুনিনি জীবনে। ... বড়রা বলত জলমালাই আইসক্রিম বড় বড় ড্রেনের জল দিয়ে তৈরি হয়, ওটা খেতে নেই। চারআনা দাম ছিল সেই স্বর্গীয় সুখের। জলমালাই আইসক্রিমের। তাই পকেটে একটা চারআনা থাকলেই হাঁটাচলা বদলে যেত পায়ের। চারআনা পয়সাটা হয়ত সেই বড়বড় ড্রেন দিয়ে ছোটো ছোটো মানুষের গল্প নিয়ে বয়ে যেতে যেতে হারিয়ে গেল।”
সুপ্রভাত লিখেছে, “ আর মেডেল শব্দের সঙ্গে পরিচয় আমায় প্রথম ‘ঘুঁটের মেডেল’ কথাটাই করায়। কিন্তু মা যে কী যত্নে কেনা ঘুঁটেগুলোকে সামলে রাখত, যাতে বর্ষাকালে ভিজে গিয়তে তার ভিতরের উৎসাহের আগুন ফুরিয়ে না যায়- সেই জন্য ঘুঁটে কে আমার কোনোদিন অতটাও ফেলনা মনে হয়নি। বরং অবসরে প্রিয় খেলনা হয়ে উঠত সে। জোগাড় করে আনা কাঠের যখন ভিজে জ্বর চলে আসে আর জ্বলতে পারে না- তখন মুখ নিচু ঘুঁটে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে, ভাতের হাঁড়ির কাঁধে হাত রাখে- ভাতের জল ফোটে। অনেকটা সেই বন্ধুটার মতো, যে আড্ডায় থাকলে মনেই থাকে না তার প্রেজেন্স, অথচ না থাকলেই কী প্রকট হয়ে ওঠে তার অনুপস্থিতি।”
এ সব ছোট ছোট অবজারবেশন তার লেখার ছবিকে করে তুলত মায়াবি। পিকা প্রায়ই আমাকে বলত, -‘আমরাই সেই শেষ জেনারেশন , যারা বিশ্বায়নের আগের ও পরের যুগকে স্পষ্ট করে দেখেছি।’ আমাদের মতো করে, দুটো সময়ের ভিতর এরপর আর নতুনরা কেউ হাঁটবে না। ওর স্বভাবসিদ্ধ ফ্যাকফেকে হাসিটা দিয়ে বলত, ‘আমরা মরে গেলে শালা সব প্রতিভা শেষ হয়ে যাবে, আমাদের লিখে যেতে হবে বুঝলি।’ প্রতিভা ছিল ওর, ও লিখে যেতে পেরেছে সময়ের চিহ্ন, সেই সময়ের অনুভবের ইতিহাস।
ওই যে বলেছিলাম, মৃত্যুর পরও একটা যাপন শুরু হয় তার স্মৃতির সঙ্গে। আসলে তো তারা থেকে যায়, বয়ে যায় জীবনভর। লিখলাম পিকা, আমি জানি তুই যেখানেই আছিস, পড়ে নিচ্ছিস শব্দগুলো। ক্ষমা করে দিচ্ছিস দেরি করে লেখার জন্য। ভালো থাকিস, আমরা লাইনেই আছি, তোরা ওখানে ঠেক রেডি রাখিস। তোর কবিতা দিয়েই বলি—
“যতদূর নিয়ে যাবে জন্মযন্ত্রণা/ আমি আছি ততদূর পর্যন্ত—/ আদিম ভয় পাওয়া রাত্রি শেষে/ তুমি সকালের আলো হাতে/ ঘুম থেকে তুলে দিও/ দেখি আমার সব অপরাধবোধ/ তোমার কোলে ভেসে যাচ্ছে... (মা, বায়োডাটা)।

সুপ্রভাত রায়ের বইয়ের তালিকা
১. বায়োডাটা, অভিযান, ২০১০।
২. টিপসই, পৌষ ১৪১৯।
৩. গতজন্মের মেমরিকার্ড, অভিযান, জানুয়ারি ২০১৫।
৪. বিষাদের ম্যাপ পয়েন্টিং, অভিযান, জানুয়ারি ২০১৮।
৫. যেমন খুশি তেমন সাজো,অভিযান, জানুয়ারি ২০১৮।
৬. বেশ তবে তাই হোক,অভিযান, জানুয়ারি ২০১৯।

সুপ্রভাতকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা
১. এখন শান্তিনিকেতন, জানুয়ারি, ২০২০

Post a Comment

0 Comments