ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ৬ । ভ্যাকসিন যেন ভগবান


ভ্যাকসিন যেন ভগবান

তড়িৎ রায় চৌধুরী


গবান সুলভ ভরসা এখন ভ্যাকসিনের উপর। তিনি আসবেন মুক্তির দূত হয়ে। অশরীরী শত্রুবাহিনীর ভয়ে এই যে গৃহ-দুর্গে দিন যাপন; সামান্য রসদ সংগ্রহেও বেরোতে হয় বর্ম আর অস্ত্র নিয়ে; এ দিন শেষ হবে। আসবে স্বাধীনতা। অগস্ট ভারতের স্বাধীনতার মাস। তাই হয়তো অগস্টেই ঘোষিত হবার কথা ছিল তার আগমন বার্তা। জাতিসত্তার উত্থান পতন বিকাশ কত কিছুই জড়িয়ে থাকে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে। সময় সে কথাই বলে। আসলে ভ্যাকসিন বিজ্ঞানের সন্তান হলেও তাকে নিয়ে অন্যদের টানাটানি অন্তহীন। 
মিথ বলে দাদা প্রমিথিউসের নিষেধ অমান্য করে ভাই এপিমিথিউস প্রেমে পড়লেন মোহিনী প্যান্ডোরার। এই প্যান্ডোরার বাক্স থেকেই কিলবিল করে ছড়িয়ে পড়ে নানা জীবাণু। অবশ্য জীবাণুর কিলবিলানো আমরা দেখবো অনেক পরে, লিউয়েনহকের সঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীতে। ক্রমেই দৃষ্টি শক্তির সম্প্রসারণ। এল উন্নততর অণুবীক্ষণ যন্ত্র।
এতদিন যে মৃত্যু ছিল কারণহীন অনিবার্য; কিছু না থাকার  সেই জগতে তখন অজস্র দৃশ্যমান জীব। কারণ জানলে তার উপায়ও জোটে। ১৭৯৬তে এডোয়ার্ড জেনার আবিষ্কার করবেন ভ্যাকসিন। গরুর বসন্ত জীবাণু থেকে তৈরি, তাই ল্যাটিন শব্দ ‘ভ্যাক্সা’ থেকে ভ্যাকসিন। আশ্বর্য! গবেষণা মানে ছিল গরু খোঁজা। ভ্যাক্সাও এল গরু থেকে! গরু মাতা না হোক ত্রাতা তো বটে। ভ্যাকসিন প্রয়োগ কালে সেকালে শরীরে একটা তিলক চিহ্ন তৈরি হত। হয়তো তাই বাংলা হল টিকা। টিকাকরণ। কপালে টিকা আমাদের ছিলই। কিন্তু টীকাগ্রন্থ! সে তৎসম শব্দ, তাই ঈ-কার। দুরুহ পাঠ-কে চিনতে শেখার কুলুপকাঠি। আচ্ছা, অচেনা জীবাণুকে চিনতে সাহায্য করাই তো ভ্যাকসিনের কাজ! চিনতে, বুঝতে সাহায্য করে যে সেই তাহলে টিকা? আর কে কাকে সাহায্য করে, না করে, তাতে আছে এক যুদ্ধং দেহি মনোভাব।
ইলিয়াড বলে ট্রয়ের যুদ্ধে সূর্যদেব অ্যাপোলো ট্রোজানদের জব্দ করতে পাঠালেন মহামারি। যেন সৈন্যবাহিনী। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে ১৯১৮এর ফ্লু ও ১৯৪১ এর প্লেগ এর যোগ কি নিছক কাকতালীয়? সাইপ্রিয়ান প্লেগ, প্লেগ অফ এথেন্স, জাস্টিনিয়ান প্লেগ, ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ— প্লেগই ফিরে ফিরে এসেছে। পরবর্তী সময়ে এসেছে নব নব রূপে। যুদ্ধ সে ভৌগোলিক বা বাণিজ্যিক, তার প্রভাবে প্রাকৃতিক স্বাভাবিক বাস্তুগত বৈচিত্র্য ও বিন্যাস নষ্ট হলেই হয়তো মহামারি এসে থাবা বসায়। ফলে যুদ্ধ জয়ের মতোই টিকা আবিষ্কার ও দেশীয় জনগনের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে সংহত, শক্তিশালী হয়ে ওঠে জাতিসত্তা। রাজটীকা কখন কার কপালে জুটবে তা যেন লেখা থাকে প্রতিষেধক টিকার গায়ে।উৎপাদন ক্ষমতা আর বন্টন দক্ষতা-ই তো রাষ্ট্র শক্তির যোগ্যতার পরিচায়ক। আদিকাল থেকে গোষ্ঠীপতির সম্মান তো আমরা তাকেই দিয়েছি যে বহিঃশত্রুর হাত থেকে সুনিশ্চিত করেছে আমাদের সুরক্ষা। সে শত্রু যে রকমই হোক। আদিবাসীদের হটিয়ে ইউরোপের আমেরিকা মহাদেশ দখলে মহামারির ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি স্পেনের ঔপনিবেশিক ক্ষমতা ছাপিয়ে রাষ্ট্র আমেরিকার উত্থানে হলুদ জ্বরের টিকার ব্যবহার। অন্য দেশের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের বৈধ ছাড়পত্র মেলে স্বাস্থ্য-সাহায্যের অছিলায়। এ প্রমাণ ইতিহাসে অজস্র। রাজনীতিতে ভ্যাকসিন তাই ভয়ংকর অস্ত্র।
শুধু তো আবিষ্কার নয়, তার গ্রহণযোগ্যতাও একটা ব্যাপার। যে কারণেই হোক টিকা— বিরোধী মনোভাব দুর্লভ নয়। সেকালের গান্ধীজী বা বার্নাড শ’ থেকে একালের জকোভিচ। ইউরোপ আমেরিকায় আন্দোলনও হয়েছে এ নিয়ে। জবরদস্তি গণটিকায় ব্যক্তির অধিকার বিঘ্নিত। এই সময়েও তৃতীয় বিশ্বের কেউ কেউ টিকার চেয়ে ভরসা করছেন হার্ড ইমিউনিটিকে। ভ্যাকসিন নির্ভরতাকে বিপদই ভাবছেন তারা। একথা বিস্ময়কর হলেও সত্যি প্রচলিত টিকা ব্যবস্থায় সবচেয়ে উদাসীন পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মানুষ। যে যত জানে তত কম মানে।
আবার চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? হেপাটাইটিস বি এর টিকা ১৯৮২ সালেই ধনী দেশগুলিতে চালু হয়। তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশে পৌঁছাতে তার ২০০০ সাল। কত কত টিকাই যে অর্থকৌলিণ্য নির্ভর তা নতুন বাবা মা-রা সকলেই জানেন। সন্তানের স্বাস্থ্য সুরক্ষার আবেগ কিভাবে মুনাফাকে মোটা করে তোলে সে অন্য গল্প। ভ্যাকসিন কি তবে অনেকটাই বিজ্ঞানের ব্যবসা? তাই বিল গেটসদের ‘গ্যাভি’ বা নরওয়ে, কিউবা-র অন্য নানা সংস্থা গলা তুলছেন করোনা-টিকা কে সর্বত্রগামী করতে? স্বয়ং হু(WHO)চেষ্টা করছে। ক্লোড ওয়ার সত্ত্বেও সোভিয়েত আর আমেরিকা তো হাত মিলিয়ে তাড়িয়ে ছিল গুটিবসন্তকে। আবার কি হবে না?
আর যদি না হয়। করোনা তো নিঃসঙ্গ হতে শিখিয়েছে। পিপিই পরিহিত চিকিৎসা কর্মীরা যেন গ্রহান্তরের জীব। ফল নিয়ে কেউ দেখতে আসে না অসুস্থকে। সবাই আছে, কিন্তু পাশে নেই কেউ। ভ্যাকসিনও ভগবানের মতো, আছে জানি; কিন্তু জীবনে পাই না!

Post a Comment

0 Comments