আনন্দপাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

সেদিন আনন্দ পাঠশালার পাশের রাস্তা দিয়ে স্কুটি চালিয়ে যেতে যেতে একবার দেহলি বাড়িটার দিকে তাকালাম। একা নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে সে। ওকে দেখে আর এগোতে পারলাম না। দাঁড়িয়ে গেলাম। দোতলার ছোট্ট খোলা ছাদের কার্নিশে অল্প অল্প শ্যাওলার আস্তরণ। কয়েকদিনের ক্রমাগত বৃষ্টির ফল। সামনে ছোটদের খেলার মাঠটায় বড় বড় ঘাস জন্মে প্রায় জঙ্গুলে ঝোঁপের আকার নিয়েছে। সবদিক নিস্তব্ধ। এ এক আশ্চর্য নীরবতার কাল। অপার শান্তি বিরাজ করছে আজ চার মাস ধরে আশ্রম প্রাঙ্গণে। এ কাল বড় বিভীষিকার। অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে আর কতদিন এই শান্তি বিরাজ করবে আশ্রমে, এই আনন্দ পাঠশালায়, জানি না। ছোটদের কলকাকলিতে মুখর শান্তিনিকেতন তো এমন শান্তি কখনও চায়নি৷... 
তোমাদের প্রিয় ‘আনন্দ পাঠশালা’য় ‘ইস্কুল নেই’ বিভাগে আজ তোমাদেরই বন্ধু ষষ্ঠ শ্রেণির প্রকৃতি লিখেছে এমনই এক মনকেমনের কথা। লেখক কবি গৌর গোপাল পালের কলমেও সেই মনকেমনের সুর গ্রামের বাড়িতে যেতে না পারা ছোট্ট রিম্পির ভাবনায়। আর কয়েকটি সুন্দর ছবি পাঠিয়েছে তোমাদের বিভাগটিকে রঙিন করে সাজিয়ে তোলার জন্য তোমাদেরই কয়েকজন ছোট্ট বন্ধু। 
আপাতত এভাবেই চলছে তোমাদের সঙ্গলাভ আমাদের ই-সংস্করণের পাতায়। ভাল থাকো সবাই। সৃষ্টিশীল থাকো। কে কি করলে, নতুন কি লিখলে, ছবি আঁকলে, আমাদের জানালে খুব খুশি হব। তোমাদের বন্ধুদাদা—
অঙ্কন রায়

অঙ্কন :  রুদ্র চট্টোপাধ্যায়, কেজি ২, লিটিল জর্জিয়ান


ইস্কুল নেই/ ৩

স্কুলের সেই দিনগুলো

প্রকৃতি শী


অঙ্কন : অদ্বিতীয়া দত্ত, ষষ্ঠ শ্রেণি, সেন্ট টেরেসা'স স্কুল, বোলপুর

বহুদিন হল লকডাউন চলছে, যার কারণে স্কুলও বন্ধ। আর এটিই হল আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা। স্কুল যেতে চাইলেও আমি যেতে পারছি না। পারছি না আমি সেই গাছের তলায় ক্লাস করতে। পারছি না বন্ধুদের ছাড়া একা একা থাকতে। মানছি বাবা-মা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু যা বাবা-মায়ের সঙ্গে শেয়ার করা যায় তা বন্ধুদের বললে মন হালকা হয় না, আবার ঠিক তেমনই বন্ধুদের যা বলা যায় তা আবার বাবা-মাকে বলা যায় না। 
লকডাউনের কারণে স্কুল বন্ধ হওয়ায় আমাদের স্কুল থেকেও ‘অন-লাইন-ক্লাসে’র ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন-লাইন-ক্লাসে যতই পড়ানো হোক না কেন গাছের তলায় বসে পড়াশোনা করার মজাই আলাদা। গাছের তলায় ক্লাস করার কথা শুনে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে আমি কোন স্কুলের ছাত্রী। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো। আমি পাঠভবনের ছাত্রী। আমি সর্বক্ষণ অপেক্ষা করে আছি কবে পাঠভবন খুলবে আর আগের মত সর্বদা ছাত্র-ছাত্রীদের কোলাহল শোনা যাবে! আর আমি নিজেও বন্ধুদের সঙ্গে বক বক করতে পারবো।


অঙ্কন : অয়ন মন্ডল, প্রথম শ্রেণি, সন্তোষ পাঠশালা

নাহ। আর পারছি না এই ভাবে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে। আশ্রম মাঠও বন্ধ। সেখানেও এখন যাওয়া যাবে না। আর মা তো সর্বদা বলেই চলেন ‘এখন বাইরে বেরোনোটা আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়।’
মনে হচ্ছে আমাকে যেন কেউ অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছে। মনটা অস্থির ভাবে ছুটে চলেছে প্রতিটা মুহুর্ত স্কুলের দিকে। খুব মিস্ করছি বন্ধুদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা, পাঠভবন ভ্রমণ, ‘বোর্ড মিন্টন’ খেলা... আরও কত কি। 
ও হ্যাঁ! এই বোর্ড মিন্টনের কথা বলতে মনে পড়ে গেল এর আবিস্কার কি ভাবে হয়েছিল। তবে শোনো বলি— একদিন স্কুলে প্রায় সমস্ত ছাত্রদের ইচ্ছে হল তারা স্কুলে টিফিন টাইমে বা অন্য ফাঁকা সময়ে ক্রিকেট খেলবে। এই শুনে আমরা কিছু মেয়েরা মিলে ঠিক করলাম আমরাও ব্যাটমিন্টন খেলবো। কিছুদিন পেরিয়ে যাবার পর দেখলাম কিছু দাদারা মিলে ক্রিকেট বল নিয়ে মাঠে নেমেছে। ব্যাট আনার অনুমতি নেই বলে তারা গাছের গুঁড়ি বা নিজেদের বোর্ডগুলোকে নিয়ে ব্যাট হিসেবে খেলছে, আর ব্যাগগুলোকে উইকেট করেছে। সেই দেখে আমরা মেয়েরা মিলে ঠিক করলাম আমরাও কক্ এনে নিজেদের বোর্ডগুলোকে নিয়ে র‍্যাকেট হিসেবে খেলবো। সেই থেকে এই খেলাটি ‘বোর্ড মিন্টন’ নামে প্রচলিত। 
সেই দিনগুলো মনে পড়লে খুব মন খারাপ করে। কবে যে স্কুল খুলবে কে জানে।
(ষষ্ঠ শ্রেণি, পাঠভবন, বিশ্বভারতী)

ছোটগল্প

মা 

গৌরগোপাল পাল 

শ্রাবণের গুমোট গরম। আজ কিছুতেই পড়াতে মন বসছে না রিম্পির। পাতার পর পাতা আঁকিবুকি কেটে খাতা নষ্ট করেই চলেছে। একটাও ছবি আঁকা হচ্ছে না তার। লকডাউনে স্কুল ক্লাস না থাকায় ক’দিন আগে ভরা বর্ষায় বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ঠাম্মার কাছে কাটিয়ে আসার পর থেকেই তার মনের এই অবস্থা। কিন্তু কাকে বোঝায় সে এ কথা! দেশের বাড়িতে খুড়তুতো ভাই-বোনদের সঙ্গে ক’দিন বেশ হইহুল্লোড়ে ভালোই কাটছিল তার। ওদের আর বড়কাকুর সঙ্গে একদিন মাঠেও গিয়েছিল সে। মাঠে খেলতে নেমে সারা গা কাদাতে সেদিন একসার হয়ে গেছিল। কাকিমা কত যত্ন করে সাবান দিয়ে গা ধুইয়ে দিয়েছিল। তারপর ঠাম্মি তেল মাখিয়ে গা মুছিয়ে আদর করে শুতে নিয়েছিল তার কাছে। সারা গা কাদা মাখা দেখে বাবা বলেছিলো চল্ এবারে সব তোর মাম্মিকে বলে দেবো আমি!
সেই সব নানা কথা আজ তার মাথায় ভিড় করছে। বাবা গাঁয়ের মানুষ। চাকরির সুবাদে শহরে বাস। মা অবশ্য নিপাট শহুরে মেয়ে। বাবার একমাত্র আদরের দুলালি। তাই মেয়েকেও সে সেভাবেই মানুষ করতে চায়। বাবার দশটা পাঁচটা আপিস। মা গৃহবধূ হলেও একটা এনজিও চালায়। সেই সুবাদে তাদের বাড়িতে অনেকেরই আনাগোনা। মেয়ের পড়াশুনো ছাড়া তার কিছুই ভাল লাগে না। কিন্তু রিম্পির মন পড়ে থাকে ছবি আঁকায়! তার শুধুই মনে হয় বন-বাদাড়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াই, ছবি আঁকি, গান শুনি আর গান গাই! কিন্তু মা যে তা শুনতে চায় না। কেবল পড়া পড়া আর পড়া ছাড়া কিছুই ভালবাসে না মা। হঠাৎ কি একটা শব্দে হুঁশ ফিরে আসে রিম্পির। তাকিয়ে দেখে মা কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠে রিম্পির। 
এবার মা তাকে খুব বকাবকি করবে! মায়ের দেওয়া পড়া তো সে করেই নি, উল্টে ছবি আঁকতে গিয়ে খাতাগুলোয় কাটাকুটি করে সব নষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু কই না তো আজ তার মা তো তাকে বকছে না! উল্টে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটু অবাকই হয় রিম্পি! মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর কি হয়েছে রে মা? দেশের বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে? ঠাম্মি, ভাই বোনদের জন্য মন কাঁদছে?’
রিম্পি কোনও উত্তর না দিয়ে মায়ের আঁচলে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

অঙ্কন : শুক্তিমা চক্রবর্তী, তৃতীয় শ্রেণি, নব নালন্দা স্কুল এবং রঞ্জনা পাল, প্রথম শ্রেণি, টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ পাবলিক স্কুল, বোলপুর

Post a Comment

0 Comments