লকডাউনের দিনলিপি


 


অনন্ত উড়ানের অবাধ আয়োজন!

অমৃতা ভট্টাচার্য্য

 বছর কোপাই কেমন সুন্দর জলে ভরে গেছে! তার বুক ছাপিয়ে মাটি ধোয়া জল ভেসে চলেছে সেই কোন্‌ নিরুদ্দেশে। খেলেডাঙার মাঠে ধান রোয়া হয়েছে ক’দিন আগেই। সবুজ গালচে পেতে মাটি যেন স্থির হয়ে বসে আছে আকাশের অপেক্ষায়। কবে যে ফুরসৎ হবে, আলের ধারে বসে বসে মেঘ দেখার! শ্রাবণ দুপুরে এমন দিনে আমরা কোপাইয়ের জল দেখতে যেতাম, মেঘ দেখতে যেতাম। শ্যামবাটির ক্যানেল তখন আমাদের নায়গ্রা হয়ে খুব ব্যস্ত পথচলতি মানুষকেও স্থাণু করে দিতে পারতো সহজেই। আজকাল ঘরে বসে বসে এসব কথাই ঘুরে ফিরে মনে পড়ে। এখন আর হস্টেলে ফিরে সাইকেলের কাদা পরিষ্কারের বালাই নেই, লালমাটির ছাপলাগা শাড়ি জামা বারান্দার দড়িতে ঘেঁষাঘেষি করে শুকোবার দায় নেই। সেসব যেন পূর্বজন্মের কোন্‌ ফেলে আসা দিন! কোপাইকেই দেখি না কতদিন! কেবল তার ছবি দেখি। চলমান, জায়মান সেই গৈরিক নদী আমায় ডাকে। তবু, এই মারি, এই শৃঙ্খল পেরিয়ে আমার যাওয়া হয়ে ওঠে না। অমলের পিসিমার মতো তাই নিজেকেই আমার বলতে ইচ্ছে করে, এইসব রোগ ব্যাধি ভাল হয়ে গেলে, ওই কোপাইয়ের ধারে বসিয়ে তোমায় ছাতু খাইয়ে আনব।

স্বগতোক্তির পালা ফুরোলে দেখি, ওই জানালার বাইরে শহর কলকাতার দূষণমুক্ত আকাশ। অনেক দূর অবধি চোখ চলে যায় এখন। ইঁটভাটার ধোয়া, হাইটেনশন তারের পোস্ট দেখা যায় অবাধে। আর দেখি, গলিতে গলিতে মানুষের জীবিকা খুঁজে নেওয়ার লড়াই। জানলার ফাঁক দিয়ে মানুষের গড়ে তোলা এই শহরকে তখন মাধব দত্তের বাড়ির আঙিনা বলে ভুল হয়। এ এক আশ্চর্য ডাকঘর যেন। যেখানে চিঠি যায়ও না, আসেও না। মৃতের সংখ্যা গুনে গুনে যাঁরা পরিসংখ্যান তৈরি করেন, তাঁরা নিশ্চয় ভাবেন ডাকঘরের কথা! সেই যে, কিশোর কিশোরীর দল, যারা ডাকঘরের গল্প শুনেছিল, ভালবেসেছিল!  তাই তো তারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যেতে এতটুকু ভয় পায়নি। মৃত্যুকে তারা পর্বান্তর বলেই জেনেছিল সম্ভবত। আমার মনের মধ্যেও এমনই কত কত গল্প কেবলই জন্ম নেয় লকডাউনের দিনে রাতে। সেই গল্পের ভিতর বসে বসে গল্পের বই পড়ি, ছাত্র পড়াই, বর্ষার গন্ধ লাগা শাড়িদের রোদ খাওয়াই দুপুরভর। মেঘ রোদ্দুরের খেলা দেখতে দেখতে যখন হাঁপিয়ে উঠি, যখন মনে হয় আর পারা যাচ্ছে না মোটেও, তখন একজন আপাদমস্তক কেজো লোকের মতো দেরাজ গোছাই, পুরনো মেইল ঝেড়েবেছে আমার অঙ্কশায়ী ডাকঘরটি পরিষ্কার করতে বসি। কেজো অকেজো বৈদ্যুতিন চিঠিরা তখন ছেড়া কাগজের ঝুড়ি ভরিয়ে ফেলে সহজেই। ভারী যান্ত্রিক এই প্রক্রিয়া। ক্লান্ত হাত কেবলই চিঠিদের মুছে ফেলে প্রয়োজনের নিক্তিতে। কী অদ্ভুত, না? এসবের মধ্যেই কখনও এসে পড়ে পুরনো চিঠির তোড়া। আট বছর আগের। পারভেজদার লেখা। জীবনের ওপারে ও হারিয়ে গেছে কবেই। চিঠিগুলো রয়ে গেছে সময়ের ডাকবাক্সে। মৃত্যুর পরিসংখ্যানের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন না থাকা মানুষের চিঠি এমন আশ্চর্য করে জীবনকে ফিরিয়ে দেবে ভেবেছিলাম কখনও?

সেইসব চিঠিরা যেন ক্রৌঞ্চদ্বীপ থেকে উড়ে আসা পাখিদের মতো। কেবল আমার জন্য, কেবল অমলের জন্য তারা যেন একেকটা থমকে থাকা বিকেল। সেসব বিকেলে আমার জানলার বাইরে দেখি কোপাই, দেখি ধান জমি পেরিয়ে বল্লভপুরের রাস্তা। শহরের গলিপথ জুড়ে তখন হিমেনেথের কবিতার মতো সন্ধা নামে ঝুপ করে। জানলার ওপারে তাকালে কেবলই মনে হয়, একটা সময়হারা বিকেল যেন ক্রৌঞ্চদ্বীপে ফিরতে চাইছে, সেই যেখানে অনন্ত উড়ানের অবাধ আয়োজন!


ছবি : অঙ্কন রায়

Post a Comment

0 Comments