বইপাড়া : কবির জীবন

কবির জীবন : সৌম্য চক্রবর্তী

দীপ শেখর চক্রবর্তী

  

‘‘স্থির হয়ে ওঠে মন,

ঝড় আসে যত।

ওদিকে দেহের মাটি ক্ষতবিক্ষত।’’ (ধ্যান)

আমি জানি সৌম্য চক্রবর্তীকে আর কেউ খোঁজে না। কেন খোঁজে না? সৌম্য চক্রবর্তী কেন হারিয়ে গেল?

শ্রাবণের বইপাড়ায় বন্ধু বই প্রকাশকের কাছে শুনি সৌম্য খুব কম বয়সে নিজেকে হারিয়ে দিয়েছে। কীভাবে হারিয়ে দিয়েছে তার কোনও খোঁজ পাই না। সৌম্যর অন্য বইগুলোর খোঁজ করতে করতে চষে ফেলি গোটা বইপাড়া। সৌম্যকে পাওয়া যায় না। আবার দীর্ঘ সময় কেটে যায়। একদিন এক বান্ধবীর মুখে শুনি সৌম্যর কথা।

তাই? তুমি সৌম্যকে চিনতে?

হ্যাঁ। কফি হাউসে বসে জীবনের কত কথা বলে যেত সৌম্যদা।

জীবনের কথা? বুকের ভেতর একটা ধাক্কা এসে লাগে। জীবনের কথা বলতো সৌম্য? তবে কেন এত কম বয়সে নিজেকে হারিয়ে দিল?

গভীর রাতে একেকদিন সৌম্যকে খুঁজতে যাই রাতের আকাশের ভেতর। কথাবার্তা বলতে যাই। সৌম্য, আমি বুঝি জীবনের অতল থেকে কীভাবে লেখা উঠে আসতো তোমার। কোন অলংকার দিয়ে সাজানো নয়, ভাবনার অহেতুক জটিলতা নয়, অহেতুক জ্ঞান ফলানো নয়, তোমার কবিতা শীতের দিনে রোদে রাখা জলের মতো।

কবির জীবন বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে সৌম্য হল সেই বিরল প্রতিভাবান কবিদের মধ্যে অন্যতম যারা খুব সহজেই জীবনের কাছে পৌঁছতে পেরেছে। খুব সহজে কথাটা ভুল হল হয়ত। এর জন্য প্রয়োজন গভীর মগ্নতা। কতটা মগ্ন হলে কবি এমন একটি কবিতা লিখতে পারেন—

‘‘শস্যের মতো করে আগলে রাখি সহ্যের ক্ষমতা।

অসহ্য সময় এসে গোলাঘর লুটে নিয়ে যায়।

আমাদের শূন্য দাওয়ায়, পড়ে থাকে ক্লান্ত ধুলো বালি ।

বউ এসে ঝাঁট দিয়ে তাদের তাড়ায়।

অসময়ে দুম করে বোকা বনে যায় ।

জীবনের অছিলায়

অভাবের দিনলিপি

        সহ্যের ক্ষমতা বাড়ায়।’’ (দুঃসময়)

কত সহজে বলা হয়ে গেলো জীবনের এক অতল বোধের কথা। কী অনায়াসে। কোথাও এতটুকু বানিয়ে তোলার কোনও জায়গা নেই। শুধু জলের মতো এক প্রবাহ।

তিন ফর্মার বইটির প্রতিটি কবিতাই এই ভাষায় কথা বলে। কিছু নির্দিষ্ট বৃত্তের মানুষের মধ্যে যখন বাংলা কবিতা আরও আরও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে সেখানে এমন লেখা আমার মধ্যে আলো জ্বেলে দেয়। লোভে পরে একেকদিন নকল করার চেষ্টা করি অথচ অসম্ভব। এই কবিতাটির ভেতরে রয়েছে স্বয়ং সৌম্য।

জানি না এই বইয়ের লেখক সেই সৌম্য কিনা যিনি নিজেকে হারিয়ে দিয়েছে অল্প বয়সে। একদিন গভীর রাতে এই কবিতাগুলোর আরও গভীরে গিয়ে খুঁজি ওঁকে। স্তব্ধ হয়ে যাই, অসহায় লাগে। বুঝি, ধীরে ধীরে অলংকার ঝরে পড়েছে যে কবির, যে কবিতার চটকদার আবরণ নিয়ে আর বিন্দুমাত্র ব্যস্ত নয়, যে নিজের চারিদিকে ক্রমাগত জটিল হয়ে ওঠা জীবনটা থেকে নিষ্কৃতি পেতে কবিতার প্রকৃত সহজতার কাছে আসে সে কতটা বিপন্ন। আমি বুঝি এই বানিয়ে তোলা কবি ও সাহিত্য সমাজের মধ্যে সে কতটা একা।

কারণ সে ছলনা জানে না। কবিতা তার কাছে একটা শখ নয়। কবিতা তার কাছে স্নানের জল যা তার শরীর থেকে সমস্ত ময়লা ধুয়ে দেয়। প্রথমেই যে কবিতাটি উল্লেখ করলাম তার নাম ধ্যান।

কবি এই ধ্যানের মধ্যে নিঃসঙ্গ। একা।

খুব কম মানুষকেই দেখেছি এই ধ্যানের কাছে পৌঁছতে। কবিতা যতটা পরিমিতিবোধ তার থেকে অনেক বেশি অপরিমিত। একজন কবি সমস্ত পোশাক, এমনকি নিজের শরীর খুলে নিয়ে দেখাচ্ছেন নিজের আত্মা। সেটি দেখার মতো যথেষ্ট নৈঃশব্দ্য আমরা অর্জন করতে পেরেছি তো? আমি জানি না এই সৌম্য সেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা সৌম্য কিনা তবে আমার সৌম্যদের জন্য চিন্তা হয়। আমি বুঝি কবিসমাজ কি নির্মম হতে পারে তাদের প্রতি, এমনকি কবিতায় অঙ্গভঙ্গি খোঁজা পাঠকও।

তবে যারা এই পথে যায় সবার কাছে পথ হিসেবে থাকুক সৌম্য চক্রবর্তীর স্বল্পমূল্য একটি কবিতার বই— ‘কবির জীবন’। স্বল্পমূল্য কিন্তু জীবনের থেকেও খাঁটি।


প্রকাশক : দূরত্ব



Post a Comment

0 Comments