ব্লগ : দেশান্তর/ ১০ । উড়ানে স্ব-অধীন চেতনা

উড়ানে স্ব-অধীন চেতনা 

মৌমন মিত্র 

মেরিকায় খুব সুস্বাদু একটি মিষ্টি পাওয়া যায়। যার নাম ডো-নাট। অধিকাংশ আমেরিকান সকালে প্রাতরাশ করে এই ডো- নাট দিয়ে। সঙ্গে এক কাপ কফি, গাড়িতে পডকাস্ট শুনতে শুনতে অফিস পৌঁছে যাওয়া। এ হল এই দেশের প্রাতঃকালের একটা খুব চেনা চিত্র। হ্যাঁ, করোনার আগে সেই নানা রঙে দিনগুলিতে। এখন কোনও চিত্রই পরিচিত না। এখন নব্য স্বাভাবিকতন্ত্র নব্য চেতনার যুগ।

এই ডো-নাটের একটি বিখ্যাত বিক্রেতা চেন হচ্ছে ডানকিন। ডানকিন কোম্পানি আমেরিকার একটি বহুজাতিক কফি এবং ডো-নাট কোম্পানি। টেলিভিশান পর্দায় এই কোম্পানির একটি অতি-বিখ্যাত বিজ্ঞাপন চলে। ‘America runs on dunkin’ অর্থাৎ আমেরিকা দৌড়বে ডানকিনের ওপর!

গোড়ার দিকে এই বিজ্ঞাপনটি বেশ মজার লাগলেও যখন খুব ধীরে ধীরে আমেরিকার মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করলাম, বুঝলাম যে, আসলে আমেরিকা দৌড়চ্ছে ওয়াল স্ট্রিটের ওপর। America runs on Wall Street!

বেশ কয়েকদিন আগে, তখন এই মার্কিন মুলুক তুমুল স্বাস্থ্য সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে এই দেশের বুকিরা কোটি কোটি ডলার বাজি ধরেছে কমলা হ্যারিসের পক্ষে। অবশেষে এই সপ্তাহের শুরুতে কমলা হ্যারিস, জো বাইডেনের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেন। আমেরিকার ৪০ শতাংশ মানুষ রাষ্ট্রপতি অথবা উপরাষ্ট্রপতি পদে কোনও নারীকে চায় না।এখনো নারীশক্তি আমেরিকার একটি ভ্রান্ত ধারণা। এই দেশের যে কোনো মলে পোশাক, খেলনা, লেখাপড়ার জিনিসপত্র কিনতে গেলে, এই ধারণার প্রতিফলন দেখা যায়। এখানে পোশাক রং অনুপাতে ভাগ করা থাকে। মেয়েদের আইলে মিষ্টি রঙের পোশাক। ছেলেদের শেডস আলাদা। যেমন, নীল, ছাই রং, সাদা ইত্যাদি। গোলাপি কিংবা তার শেডস হল মেয়েদের রং। খেলনাপাতির ক্ষেত্রেও এক। কিচেন সেট, ডল, ছোট বাড়ি, বার-বি-কিউ সেট, ইত্যাদি মেয়েদের জন্য। বন্দুক, গাড়ি, ব্যাট, বল, ডাইনোসার, ইত্যাদি নিয়ে ছেলেরা খেলবে। এমনকী এই দেশে ব্যান্ড এইড-ও বিক্রি হয় জেন্ডার অনুসারে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কিছুটা ভেদাভেদ রয়ে গেছে। থাকবে কতদিন তা অজানা। অনিশ্চিত। আসলে জীবাণু তো!

খুব ছোটবেলায় নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খেলনা, বই ইত্যাদি সামগ্রীর দ্বারাই একজন মানুষের মস্তিষ্কের গঠন হয়। তাদের বাড়ন্ত সময়, এই ধরণের অপশানের সাহায্যে শিশু মনের মস্তিষ্কের একটা নিটোল আকার তৈরি করে ফেলা যায়। ফলে এই দেশ কতটা প্রগতিশীল ভাবনায় মেয়েদের প্রতি সদয়, সেটাই ভাবার! বাইডেন-কমলা জুটির আড়ালে প্রকৃত শক্তি ভিন্ন। দেশ এবং দশ নয়। কয়েক মাস আগেই এই ওয়াল স্ট্রিট, কর্পোরেট আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা বার্নি স্যান্ডারসকে সমর্থন করবেন না।

কমলা হ্যারিস বর্ণবৈষম্যের হিস্প্যানিক বিরোধিতার দীর্ঘ ইতিহাসে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাই আশা রাখা যায় যে, রাজনৈতিক স্তরে তাঁর নাম মার্কিন মুলুকের কর্পোরেট জগতে ভারতীয়দের বহু স্তরে মার্কেট দখল করতে সাহায্য করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখা ভাল বাইডেন-কমলা জুটি জিতলে তবেই এত জল্পনাকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আমেরিকার ইতিহাসে দুই পর্বে, অর্থাৎ ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত রনাল্ড রেগান রাষ্ট্রপতি পদে থাকেন। তিনিও আজকের রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিশ্বাস করতেন পরিবেশ সচেতনতা একটি অপ্রয়োজনীয় ভাবনা। রেগান নিজে কামিউনিজিম ঘৃণা করতেন। 

সুতরাং স্বাস্থ্যের এই মহা সঙ্কটেও, ফিরে আসতেই পারে পুরোনো এই ভয়াবহ ট্রাম্প শাসন। শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমিস্টরাই পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারে ফ্যাসিস্ট, বেপরোয়া, বর্ণবাদী এই সরকারকে। 

আমেরিকায় মহামারির কবলে দারিদ্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। দৈনন্দিন ঘটনার প্রাচুর্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন। বাড়ছে খাদ্য সঙ্কট। মেল-ইন ব্যালটের জন্য পোস্টাল ফান্ডিং দিতে নারাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আমরা জানি রিপাবলিকান দল বিজ্ঞান অস্বীকার করে। আমরা এটাও মানি যে, শিক্ষার সঙ্গে গণতন্ত্রের একতটা গুরুতর যোগাযোগ থাকে। আমেরিকার অর্থ, স্বাস্থ্য সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েও কী দেশবাসী আগামী নভেম্বর মাসে একটা সুস্থ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে পারবে? এই মুহূর্তে, এই দেশের পরিবর্তনশীল হাওয়ার গতি-প্রকৃতি আগামী দিনে দিন বদল ঘটাতে পারে? 

ভোট সংক্রান্ত দুর্নীতি এখানেও আছে। পুরোদস্তুর। ভারতবর্ষের মতো উলঙ্গ রাজনীতির প্রাণহানি না-থাকলেও, এখানে সংঘর্ষ, ভীতিপ্রদর্শন, ব্যালট কারচুপি এত হয় যে, নতুন করে যোগ করার আর কিছু নেই। ভোট জালিয়াতির আশ্রয় এই দেশের নির্বাচনেও রয়েছে। তবে অনেকেরই ক্ষোভ সরিয়ে রেখে অবশেষে একটা সরকার গঠন হবে। দেখা যাক, বিশের মার্কিন রাজনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। 

কমলা হ্যারিস এই দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয় প্রতিনিধি। একজন নারী শক্তির আস্থা হয়ে আমি সর্বক্ষণ পাশে আছি। থাকব। তবে ভাববার বিষয় এই যে, একজন দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয় কী সত্যিই আমার দেশের বায়ু, মাটি, জল নিয়ে আবেগ জারিত হবেন? চোখের সামনে এত এত ভারতীয় শিশুদের এই দেশে বেড়ে উঠতে দেখেই মনে এই প্রশ্ন আসে। 

ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্প, উপন্যাসের প্রত্যেক চরিত্র নিজের পরিচয় সঙ্কট নিয়ে ভুগেছেন। কিন্তু স্বদেশের প্রতি টান তাঁর লেখায় তেমন ভাবে ফুটে ওঠেনি। কারণ এই টান বুকে ধারণ করার জন্য একটা যোগ লাগে। নাড়ির যোগ। সেই যোগ আমরা ভারতগামী উড়ানের চাকা দমদম বিমানবন্দরের মাটির ঘর্ষণে অনুভব করি। এই বোধকে আমাদের বুকের ভিতর এক অজানা সাধনে স্ব-ইচ্ছায় আদরে লালন করি। 

এই ‘ব্যথার তুফান’ বহন করা যায়। অর্জন করা যায় না।  


Post a Comment

0 Comments