ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ১০ । প্রাচীর মহাকাব্যিক সংঘাতের উপাদান


প্রাচীর মহাকাব্যিক সংঘাতের উপাদান

তড়িৎ রায়চৌধুরী

সা

ধারণ ইংরাজিতে বলি ওয়াল। কিন্তু প্রাচীর আর দেওয়াল কি এক আমার কানের কাছে? ‘আরণ্যক’-এ ছিল নিশানদিহি খাম্বা—শুনলেই কেমন লাগে। প্রাচীরও কি তেমন কিছু? তুলনায় দেয়াল একটু নরম। “ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর/ খেয়াল মতো দেয়াল তুলি গড়ে।’’ আরও নরম শব্দ বোধহয় বেড়া। বেড়া মানে কি ব্যারিকেড? কমরেড গড়ে তোল ব্যারিকেড। সে ব্যারিকেড মানে কি মানব প্রাচীর? মহাভারতের চক্রব্যূহ কি এই রকমই কিছু? মানব প্রাচীর তো জীবন্ত? যেমন জীবন্ত প্রাচীর দেখেছি গুল্ম বা বীরুতের। টগর, নিশিন্দা, জবা, ঢোল কলমি এমন কত কিছু ঘিরে রাখত সব্জি বা ফুলের বাগান সমেত বাড়িকে। গাছেরা গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু প্রাণ থাকলেই আনচান থাকে। নিয়মিত পরিচর্যা, পরিশ্রম। তাই পরম নিশ্চিন্তি নিয়ে এলো ধাতুর বেড়া জাল। একবার লাগালে আর ঝক্কি নেই। মরা জিনিস ততো যত্ন চায় না। 

নেটের দেওয়াল! কি অদ্ভুত শব্দ! ফেসবুকে যেমন থাকে। আমার দেয়াল তোমার দেয়াল। ব্যক্তিগত পরিসর। বিপ্লব থেকে বিনোদন, রক্ত-উন্মাদনা থেকে রুচির কুশ্রীতা একই সঙ্গে কত কিচ্ছু ধারণ করে থাকে শান্ত স্থিতধী দেয়াল। আবার কোথাও স্টিক নো বিলস। কত দিনের কত কিছু গচ্ছিত আছে ওই দেয়ালে। স্মৃতির সমৃদ্ধ ভান্ডার। সহজে হারায় না। খুব টেঁকসই। যেমন জি আই তার। প্রথম প্রথম একটু মন খারাপ করত, হাতে ধরা বই-এর জন্য যেমন করে ডিজিট্যাল ওয়ার্ল্ডে। তাই লোহার গায়ে দিলাম সবুজ রং। গাছ, মাটি, আকাশ ছাপিয়ে উঠল উজ্জল সবুজ রং— বেড়ার শরীর। ড্রোন ক্যামেরার যেন নিখুঁত আলপনা। আল্পনার অনুষঙ্গে মনে পড়ল খড়ির কথা; আর খড়ির থেকে খড়ির গন্ডী। সেই রামায়ণ থেকে জীবনস্মৃতি। নারী আর শিশু কে আটকে রাখার জবরদস্ত পাঁচিল। এ পাঁচিল রেখার মতো ম্রিয়মান—প্রস্থ নেই, বেধ নেই। তবু মনের মধ্যে উঁচু করে রাখে ভয়ের বার্তা—বাইরে গেলেই বিপদ। 

আসলে বিপদ প্রতিরোধে দীর্ঘতাই দস্তুর। হয় উঁচু করে প্রাচীর গড়ো নয় গভীর করে গর্ত। ডলবি এফেক্ট হল দুর্গপ্রাচীরের বাইরে পরিখা। আসলে সুরক্ষার সুবিধা লোভ। সভ্যতার প্রথম শহর উরুক বেষ্টনী দিয়েছিলেন গিলগামেশ। তারপর ব্যাবিলন, জিম্বাবুয়ে, ক্রোয়েশিয়া, স্কটল্যান্ড কত রূপে কত বার। যাযাবর দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে ২২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীর গড়ে তোলেন চীন সম্রাটরা। তা আজ পৃথিবীর সম্পদ বলে গণ্য। দেশ, সম্প্রদায়, বাড়ি বা অভিজাত, সমমনস্ক, বহিরাগত নানা ভাবে নানা ক্ষেত্রে আটকা পড়ি আমরা। জোড়াসাঁকো বা অচলায়তন; শিশু রবি বা বৃদ্ধ আচার্য সকলেই বন্দি। না না পঞ্চক কে ধরছি না। সে তো প্রাচীর টপকে চলে যায় শোনপাংশুদের মাঠে। আচার্যও জানেন। তাঁরও ইচ্ছা আছে কিন্তু ক্ষমতা নেই। ইচ্ছা আছে বলেই প্রশ্রয় আছে। তাই পঞ্চক কে মরতে হয়নি আউশভিৎসের দেয়ালে মাথা কুটে। যেমন দুশো জন মরেছেন বার্লিন প্রাচীর পেরোতে গিয়ে। 

বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৬১তে শহরের মাঝে পাঁচিল দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হল জার্মান কে; দেশ কে, জাতি কে, শক্তি কে। যেমন তার কাঁটার উঁচু প্রাচীর ভাগ করেছে দুই বাংলাকে। দুশো বছর জ্বালাতনের শোধ তুলেছে ইংরেজরা। নইলে পাঞ্জাব আর বাংলাই ভাগ হল! চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে রইল শরনার্থী অনুপ্রবেশ। অনুপ্রবেশের অভিযোগে প্রাচীর উঠছে আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে। গোটা বিশ্বই যেন শরনার্থী শিবির। করোনা জীবানুর অনুপ্রবেশের ভয়ে কত ব্যবস্থা! মাস্কও কি এক রকম প্রতিরোধী প্রাচীর? 

আসলে কে যে শরণার্থী আর কে আক্রমণকারী, সময়ের সঙ্গে কত কিছুর মানে পাল্টে যায়। প্রাচীন ট্রয়ের প্রাচীর ছিল মহাকাব্যিক সংঘাতের উপাদান। এখন সে বিশ্ব পর্যটন ক্ষেত্র। একটা মস্ত কাঠের ঘোড়াও তৈরি হয়েছে; নিছক বিনোদনের স্বার্থে। জেরুজালেমের ওয়েলিং ওয়াল, সত্যিই কি সে দেয়ালের কান আছে? লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু কাঁদতে যায় তার কাছে। প্রবীণতম ধর্মস্থান স্পর্শ করে স্মৃতির পথে। এভাবেই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে নিথর প্রাচীর। যুগে যুগে গ্রাফিত্তির গান জাগে। ভিত্তি চিত্রে ভরে ওঠে। মানুষই পারে, আবশ্যক দেওয়ালকেও আনন্দের উৎসভূমি করে তুলতে। অজন্তা ইলোরা সিস্টিন চ্যাপেল মতো তার সাক্ষীর অভাব নেই।

Post a Comment

0 Comments