ব্লগ : দেশান্তর/ ৮ । বন্ধুত্ব কখনও আড়াল নিয়ে আসে


বন্ধুত্ব কখনও আড়াল নিয়ে আসে

মৌমন মিত্র

কবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা বলছি। তখন আমি কলেজে পড়ি। সেই সময় বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসে এক ধরণের ব্যান্ড পরানো হত। যার হাতে যত বেশি ব্যান্ড, তার ততজন বন্ধু। পরের দিকে অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়া নিজেই এই বন্ধুত্ব পাতানো, বন্ধুত্ব ভাঙা, ব্লক আনব্লক করা— ইত্যাদি নিজের হাতে দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আমরাও ধীরে ধীরে সেই স্রোতে ভেসে ভাবতে শুরু করি যে, ফেসলেস সম্পর্কও আসলে সম্পর্ক। আমরা সকলে মুখ গুঁজে বন্ধুত্ব খুঁজে বেড়াই। মোবাইলে উঁকি দিয়ে। তখনই হয়তো আপনাকে সাবেক পাড়ার চায়ের দোকানে খুঁজে ফেরত চলে গিয়েছে আপনার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুত্ব! 
বন্ধুত্ব এভাবেই হারায়। এক ক্লিকে। বন্ধু পাওয়ার বিভ্রমে। দীর্ঘ বিশ বছরের বন্ধুত্ব কখনও কখনও বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে আসে। ঠিক বিশ্বাসঘাতকতাও নয়, বলা যায় আড়াল নিয়ে আসে। ব্যক্তি জীবনের আড়াল। যার ভাল মন্দ হয় না বরং তখন মনে ভাবনা গড়ায় যে, খুব বিপদে আমি সত্যিই বন্ধুত্বের পাশে থাকব না সমাজের পাশে? এই সন্ধিক্ষণ মানব জীবনের সন্ধিক্ষণ। বহুস্তরীয় দীর্ঘ, অতিদীর্ঘ সন্ধিক্ষণ, যা এক কথায় অথবা কয়েকটা বয়ানে, প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।
সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুরা তো এই সে দিনের! তার কী যে ভিত! কী-বা দায়! কী- আর পাশে থাকা! 
সেদিন বিকেলে অভয়বাবু এসে হাজির। এর আগে আপনাদের সঙ্গে হয়তো শেয়ার করেছি, অভয়বাবু একরকম ঘরোয়া বাঙালি। তাই তিনি মাঝে মধ্যেই থলে ভরতি মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এই লকডাউনে তাঁর একটু মৎস্য বিলাসিতায় ভাঁটা পড়ে। এখন অবশ্য স্রোত, ঢেউ এর বিরুদ্ধাচারণ ক’রে , আমাদের সকলের জীবন নব্য স্বাভাবিকতন্ত্রে ফেরার পথে। তাই তিনি থলে হাতে বেরিয়ে পড়েছেন। নিউ ইয়র্কের মৎস্য বাজারে যাওয়ার রাস্তায় আমার বাড়িটি অবস্থিত। তাই অভয়বাবু সেদিন ফিরতি পথে আমাদের গৃহে একটু ঢুঁ দিতে এলেন।
মনে হল, বেশ খোশ মেজাজেই আছেন। আমাদের জন্য বন্ধুত্ব দিবসের একটি ফুলের তোড়াও নিয়ে এসেছেন। যত্ন সহকারে। মনে করে। আপাদমস্তক বোঝা গেল তাঁর মেজাজে যেন একটা খুশির আমেজ। আমি খানিকটা উৎসুক হয়েই জানতে চাইলাম, ‘কি অভয়বাবু, প্রেসিডেন্ট যে স্কুল-কলেজ এর মধ্যেই খুলে দেবেন বলছেন। সকাল সন্ধে চিন্তা করে করে যে কূল-কিনারা করে উঠতে  পারছি না। আপনি ভেবেছেন কিছু এই বিষয়ে? ছেলেদের স্কুল -কলেজে পাঠাবেন?’
অভয় বাবুর এক পুত্র অষ্টম শ্রেণিতে যাবে, আর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কলেজের প্রথম বছরে পা দেবে। স্বাভাবিক ভাবেই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশদ তথ্য তাঁর অজানা নয়। আচমকাই দেখি স্কুল, কলেজের প্রসঙ্গ এড়িয়ে তিনি অন্য এক আলটপকা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। সন্ধের হালকা চা-স্ন্যাক্স সহকারে।
কলকাতার এক প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক-কবিকে নাকি তিনি শাস্তি দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া তাঁর এই পদক্ষেপে উচ্ছ্বসিত! কি শাস্তি, কবির অপরাধ ঠিক কী—এসবের অবশ্য কিছুই  অভয়বাবু বিস্তারিত জানেন না। আমি বললাম, ‘দেখুন অভয় বাবু, বহু যুগ হল আমার প্রিয় শহর ছেড়ে চলে এসেছি। এখন কলকাতার মানুষ, শহরের অধিকাংশ ঘটনাবলি বড়ই ঘোলাটে লাগে। প্রাপ্ত বয়স্ক কেউ আইনত অপরাধ না করে থাকলে, আপনিই বা এত উঠে পড়ে লেগেছেন কেন? পৃথিবীর কোন্ সিস্টেম স্বচ্ছতায় একক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে বলতে পারেন?’
অভয়বাবু উদাহরণ স্বরূপ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার নাম বলতে পারেননি। সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হোক কিংবা হাসপাতাল, নার্সিং হোম হোক অথবা কোনও বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র। বলার কথাও নয়। আমেরিকায় স্বজনপোষণ যদি ধরে নিই নেই, তবু, এখানের স্কুল-কলেজে রয়েছে বর্ণ বৈষম্যের খেলা। বিপুল পরিমাণ অর্থের খেলা। স্বজনপোষণ বিষয়টি ‘ধরে নিই’ কেন লিখলাম তার বিস্তারিত আলোচনা করব অন্য কোনও ব্লগে। বিষয়ের প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র ধরে।
এখানে সেপ্টেম্বার মাসে প্রতি বছর নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। এ-বছর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুনঃনির্বাচন এবং দেশের আর্থিক উন্নতিকে কেন্দ্র করে, দেশ ব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দিয়েছেন ইন-পারসান লার্নিং এর ব্যবস্থা করতে। অর্থাৎ হোম স্কুলিং না-ক’রে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বয়ং স্কুল এবং কলেজে যেতে হবে। সন্তানরা স্কুল-কলেজে চলে গেলে, বাবা মায়েরা সহজে তাঁদের কর্ম স্থানে ফিরতে পারবেন। এইভাবে অর্থনীতির অগ্রসর সম্ভব। তাছাড়া কর্ম ক্ষেত্রে ফিরতে পারা এই বিপুল পরিমাণ অভিবাবক ভোট দেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। প্রেসিডেন্টের রিপাবলিকান দলকে। 
‘যতটা প্রতিবাদ করা যায় আমরা করব। বুঝলেন মিসেস মিত্র? আসলে ক্ষমতা থাকলে প্রতিবাদটা করা উচিত। এক চুল নড়বে না ভেবে প্রতিবাদ করব না?’
আমেরিকায় বিগত সাত দিনে ৬৫,০০০ মানুষ পুনরায় করোনায় সংক্রমিত। জুলাই মাসে ২০ লক্ষের বেশি সংখ্যক নতুন সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া এখন পাঁচ লক্ষের বেশি আক্রান্ত মানুষ নিয়ে সংক্রমণের শীর্ষে। ফ্লোরিডা, মিসিসিপ্পি, টেক্সাস চটজলদি তাদের অর্থনীতি শুরু করতে গিয়ে ইতিপূর্বেই এই রোগের ভয়াবহতার সম্মুখীন হয়েছে।
টেলিভিশন পর্দায় চোখ রেখে আমি হঠাৎই বলে ফেললাম, ‘অভয়বাবু, এই বৃহৎ জীবাণুর সঙ্গে লড়তে না পেরে আপনি যে পাড়ার দাদা-দিদিদের ব্যাক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়েছেন তা দেখে আমি আশ্চর্য হই না। আমরা সহজাত ভাবেই কেচ্ছার পাশে থাকি। আমাদের এই সহজাত-সংক্রমণের ভাগ্যিস কোনও ভয়াবহতা নেই।’
‘হা হা! মিসেস মিত্র একটা কথা বলি? ধরুন এই যে ইন্ডিয়ানার গ্রিনফিল্ড সেন্ট্রাল জুনিয়র হাই স্কুল খোলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছাত্র ছাত্রীদের কোয়ারান্টিনে পাঠাতে হল। এখানে আমার-আপনার কী করনীয় বলতে পারেন?’
‘কিছুই করার নেই। আজ বাদে কাল আমার-আপনার ছেলে মেয়ের স্কুলে যাওয়া মেনে নিতে হবে। ধরে নিতে হবে তারা সুরক্ষিত। সে হাইব্রিড-লার্নিং অর্থাৎ কয়েক ঘন্টার ক্লাসের সঙ্গে হোম স্কুলিং মিলিত একটা পদ্ধতি হোক, অথবা স্বয়ং তারা নিজে গিয়ে ক্লাস করুক। মেনে নেওয়াটা আমাদের ধর্ম হয়ে গেছে অভয়বাবু। বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন স্তরে মেনেই তো নিই আমরা। তাই না?’ এই বলেই এবার আমার কণ্ঠে কারণ অকারণের আবেগ জমতে শুরু করছে। সেসব আবেগের নিঃশ্বাস ওঠানামার শব্দ পাই আমি।
অ্যাটল্যানটার একটি স্লিপ-অ্যাওয়ে সামার ক্যাম্পের ৬০০ জন ক্যাম্পারস এবং কর্মী সদস্যর মধ্যে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক মানুষ করোনায় সংক্রমিত। ক্যাম্পটি অধিকাংশ সাবধানতা অবলম্বন করে থাকলেও, সেখানে কেউ মুখোশ পরেনি। এখানে সক্রমণ ছড়ায় গান এবং হর্ষধ্বনির মাধ্যমে।
ওদিকে ফ্লোরিডার একটি ট্রপিকাল ঝড় হ্যারিক্যানের আকার ধারণ করছে। প্রকৃতি, জীবাণু, বিজ্ঞান— কোনও কিছুর প্রতিবাদ হয় কী? জীবনের এই অসহনীয়, অনিশ্চিত সময়ে দাঁড়িয়ে অভয়বাবুর পাড়া-কেচ্ছার লড়াইয়ে এক প্রকার দলীয় দখলদারিতা দেখে আজ বড় বিস্ময়কর লাগে! বিশেষত যে কেচ্ছায় প্রাপ্ত বয়েস্করা জড়িত। যাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্ত এক সময় নিজেরাই নিয়েছেন।
এই অভয়বাবুই ক'দিন আগেও প্রতিবাদে কতটা অসহায় ছিলেন, যখন আমি আমার পাশের বাড়ির ছোট্ট এক কিশোরী মেয়ের নির্যাতনের সঠিক বিচার চেয়েছিলাম। তিনি এখনও সেই নির্যাতনকারীর সঙ্গে সৌজন্য সম্পর্ক রাখেন। আমি দেখেছি। মেনে নিয়েছি। মানিয়ে নিয়েছি।
কিছুক্ষণ বাদে, নিজের জীবনের নানা বন্ধু পর্বের স্মৃতিচারণ ক’রে, এবার তিনি রওনা দিলেন বাড়ির দিকে। পৃথিবীতে যতদিন কেচ্ছা থাকবে অভয়বাবুরা নিশ্চয় সরব হবেন সমাজ সংস্কারে। জীবাণুর ওষুধ হয় না, তার সঙ্গে লড়তে সঠিক পরিকাঠামো লাগে। কাঠামোগত সমস্যা হলে, অভয় দেন অভয় বাবুরা। প্রতিবাদের ঝংকারে, তাঁদের নিজস্ব ভঙ্গিমায়!
এই সপ্তাহে, পর পর নানা ধর্মের নানা পরব চলছে। ওঁর গাড়ির ঠিক ওপরে যে আকাশ, তাতে এক মস্ত গোলাকার চাঁদ উঠেছে। কালই পূর্ণিমা। যেন তারই আয়োজন। ভাগ্যিস চাঁদ,সূর্য অন্তরীক্ষ ধর্মহীন। তাই তারা পূর্ণতা পায়। বছরের খুব সংক্ষিপ্ত সময় ধরে পূর্ণিমা আসে, পূর্ণিমা যায়। 
অভয়বাবুর গাড়ির চাকা এই পাড়ার নিঃশব্দের রেশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। আমার বাড়ির সামনে যে লম্বা রাস্তা, তার একধার দিয়ে এই পাড়ার এক সিনিয়র দাদু হেঁটে আসছেন। ওয়াকার নিয়ে। হাতে বাজারের থলে। তার সঙ্গে একটা ওষুধের ব্যাগও ঝুলছে। বুঝলাম তিনি একাই নিজের সংসারের হাট, বাজার করে বাড়ি ফিরছেন। এই জাতীয় দৃশ্য অবশ্য আমেরিকায় খুব স্বাভাবিক। আমেরিকান সিনিয়র সিটিজেনরা অত্যন্ত স্বাবলম্বী হন এবং এঁরা প্রত্যাশাহীন। তাঁরা জীবনের নিঃসঙ্গতা মেনে নিয়েছেন। কোনও রকম প্রতিবাদ কিংবা দুঃখ প্রকাশ না করেই। 
তাঁরা জানেন তাঁদের এই নিঃসঙ্গ জীবনের ফাউন্ডেশান অর্থাৎ ভিত তাঁরাই এক সময় তৈরি করেছেন। যৌবনে, নিজের সন্তানদের খুব ছোট বয়েসে নিজেদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে। তাই শেষ জীবনের এই নিঃসঙ্গতা তাঁদের প্রাপ্য। অথবা এই একাকিত্ব তাঁরা স্বাধীন জীবন যাপনের অঙ্গ হিসেবে নিয়েছেন। হয়তো এভাবেই ভাবেন তাঁরা! জানি না।


ক্রমশ এগিয়ে আসা দাদু-কে দেখে মনে হয় যে, জীবনের বহু বর্ণীয় অসহায়তার বীজ নিজেরাই নিজেদের মাটি খুঁড়ে পুতে দিই! তাতে জল দিই, তাকে লালন করি। পরবর্তীকালে তার  ফল ভোগ করব বলে। এঁদের এই অনিশ্চিতি, একাকিত্বের জীবন কিছুটা পারিপার্শ্বিক সিস্টেমের ওপর-ও নির্ভরশীল। তাছাড়া, প্রাপ্ত বয়েসে দু'জন কিংবা একাধিক মানুষের সিদ্ধান্ত যখন মিউচুয়াল হয়, তার পরিণামও মেনে নিই। মেনে নিতে বাধ্য হই। সিস্টেমের অংশ হিসেবে। তখন সব ফুরায়ে, পড়ে থাকে এক থলে হাহাকার, হা-হুতাশ, আর আমার চোখে ঘনিয়ে আসা এই দাদুর এক মাত্র সম্বল, ওয়াকারটি!
মড়ক, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, এবং তার অব্যবস্থা , রাজনীতি, স্বজনপোষণ, মুখোশ, মুখশহীনতা— এই সবই দাদুর দৈনন্দিন গ্রসারির থলেতে পড়ে আছে। যা তিনি রাঁধবেন। খাবেন। একা একা। কেউ তাঁর এই অতি সূচিমুখ জীবনের জন্য দায়ী নয়, কেউ দায়ী হওয়ার জন্য প’ড়ে নেই, কেউ দায়ী হতে চাইবেও না... বাইরের অন্ধকার কেমন গুমোট হয়ে আসছে। রাত বাড়ছিল। সেই দাদু-ও বাড়ি পৌঁছে গেল। আমি এবার আমার দুয়ার বন্ধ করে দিই। সে রাতের জ্যোৎস্নাকে মেনে নিয়ে, তাকে স্বচিন্তায় হার মানিয়ে।

Post a Comment

0 Comments