করোনার কুমোরটুলিতে শূন্য কাঠামো



করোনার কুমোরটুলিতে শূন্য কাঠামো 

শুচিস্মিতা দাস

দু

র্গাপুজোর আর বাকি মাসদুয়েক। কুমোরটুলিতে ঢুকলেই এসময় চোখে পড়ে একটা চেনা ব্যস্ততা। প্রতিমার রঙ-ছাঁচ-সাজ, ব্যস্ত কারিগররাও। ভিড় থাকে প্রতিমার সাজের দোকানগুলিতেও। তবে এ বছর যেন ছবিটা একটু ফিকে। বনমালী সরকার স্ট্রিট দিয়ে ঢুকেই প্রথমেই চোখে পড়ে যে সাজের দোকানগুলি, খোলা নেই সবকটি।   

উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি এলাকায় বসবাস কমবেশি ৩৫০টি কুমোর পরিবারের। সম্বৎসর কাজ চললেও সকলেই জানে কুমোরটুলির প্রত্যেকেই তাকিয়ে থাকেন আশ্বিনমাসে দুর্গাপুজোর দিকে। অন্যান্যবার পয়লা বৈশাখের দিন থেকেই তারা পেতে শুরু করেন ‘সুখবর’। পুজোয় কলকাতার কোন ক্লাবের কী বাজেট থাকছে, কতজন কাজ পেতে পারে তাই নিয়েও শুরু হয় একটা জল্পনা-কল্পনা! এবারে কোভিড মারিতে ক্ষতিগ্রস্থ কলকাতা-সহ আন্তর্জাতিক বাজার। আমরা ঘুরে দেখলাম কুমোরটুলি।

গলির দু’ধারের দোকানগুলিতে সার বেঁধে রাখা পুরোনো লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি। ‘এগুলো পয়লা বৈশাখের’- বললেন কুমোরটুলির এক কারিগর। এবছর বাংলা নববর্ষের দিন বহু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টেলিফোনে তাদের জানিয়ে দেয়— এবছর তারা গণেশ পুজো করছেন না। বিক্রি হয়নি অন্নপূর্ণা প্রতিমাও। কুমোরটুলির শিল্পীরা তাই অপেক্ষা করছিলেন ‘রথযাত্রার শুভ-দিনের’! প্রথা অনুযায়ী রথ, উল্টোরথ বা জন্মাষ্টমী তিথিতেই পুজো হয় দুর্গা-কাঠামোর। কাজ শুরু হয় পুরোদমে। এবার...?

বিদেশ থেকেও বাতিল হয়েছে প্রতিমার অর্ডার। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য নির্মিত হয় প্রায় ৩০০-৩৫০টি ফাইবারের মূর্তি। আরেক কারিগরের সঙ্গে কথায় জানা গেল- বিদেশি সংস্থাগুলি তাদের সঙ্গে ভিডিও কলে দরদাম করতে থাকে প্রতিমা পরিবহন খরচের। শেষ মুহূর্তে ওজন কমাতে হয়েছে বেশ কিছু দুর্গামূর্তির। চোখে পড়ল, অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে কিছু প্রতিমার কাঠামো। ‘দেখুন, শুমুমাত্র অর্ডারের ভিত্তিতেই তো মূর্তি গড়তে আমরা পারি না। কোন ক্লাব কত আগাম দিতে চাইছে তার ওপরেও খানিকটা নির্ভর করে।’ বেশ বিরক্তির সুরেই বলেন মূর্তির ছাঁচের সামনে বসে থাকা এক প্রবীণ। 

লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক পরপরই ছিল বাসন্তীপুজো। তখন থেকেই শুরু হয় কুমোরটুলির ‘খারাপ সময়’। শুধু তো বিদেশে নয়, কুমোরটুলির প্রতিমা প্রতিবছর পাড়ি দেয় পুণে, চেন্নাই, মহারাষ্ট্রতেও। এবছর পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেছে সুন্দরবন-কাকদ্বীপ এলাকার অর্ডার। চিন্তার ভাঁজ ‘কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সংস্কৃতি সমিতি’-র শিল্পীদের কপালেও। কথা বলে জানা গেল, সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩-৪ লক্ষ টাকার জিনিস ও সাজের। দীর্ঘ অনিশ্চয়তায় নিজেদের গ্রামে চলে গেছে কুমোরটুলির বহু ঠিকে কাজের শ্রমিক। লকডাউনের মধ্যেই ‘উম্পুন’ ঝড়ের তান্ডবে নষ্ট হয়েছে প্রতিমা তৈরির অস্থায়ী ঘরগুলি। বিশ্বকর্মা, আগেকার লক্ষ্মী-গণেশ-অন্নপূর্ণা মিলিয়ে প্রায় শ’খানেক মূর্তি জমে থাকায়, নিয়মিত ধুলো পরিষ্কার করাও এখন শিল্পীদের রুটিনের একটা অংশ। 


কলকাতার দুর্গাপুজো একটা বড় বাজেটের শিল্প অনেকবছর আগে থেকেই। পশ্চিমবাংলায় দুর্গাপুজোর কাজের সঙ্গে স্থায়ী বা অস্থায়ী ভিত্তিতে জড়িত থাকে প্রায় ১০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ। প্রতিবছর তৈরি হয় কমবেশি ১২,০০০ মূর্তি। এবছর কোভিড-এ বিপর্যস্ত সাধারণ জনজীবন। তাই কতটাকা চাঁদা উঠতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। তবে লকডাউন চলাকালীনই কুমোরটুলিতে এসেছে বেশ কয়েকটি অর্ডার। ভরসা জুগিয়েছেন বারোয়ারি ও বনেদি বাড়ি মিলিয়ে পুরোনো খদ্দেররা। হোক ছোট করে, তবু মা আসছেন তো! 

কুমোরটুলির অনেক শিল্পীকেই এখন দেখা যাচ্ছে দিব্য মাস্ক পরেই কাজে নেমে পড়েছেন তাঁরা। এমনকি তৈরি হচ্ছে ‘করোনা’ থিম-ও। ২০২০ তো ভাল যাচ্ছে না কোনওরকম ব্যবসার জন্যই। লকডাউনে পুজো কমিটি থেকে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন একাধিবার। তবে, ক্লাব কর্তাদের মুখেও ফিরছে একইরকম কথা। বাজেটের জন্য কমাতে হয়েছে প্রতিমার উচ্চতা। এমনকি এবারে তাঁরা হয়তো নামছেন না সো-কলড থিমের লড়াইয়েও। বাজেটে কাটছাঁট— তাই ছিমছাম ভাবেই মিটবে মা’এর উপাসনা। শোনা যাচ্ছে, মণ্ডপে থাকবে সব রকম সতর্কতা ও স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা। অতএব, মা’কে সুরক্ষিত ও ‘ইমিউন’ রাখাই কুমোরটুলি পরিবারের এখন প্রধান দায়িত্ব!   

Post a Comment

0 Comments