আনন্দপাঠশালা

 


বন্ধুদাদার চিঠি

করোনাকালে এখনও তোমরা অবরুদ্ধ। এখনও তোমাদের ইস্কুল নেই। আছে শুধু নেটনির্ভর জীবনযাপন। একটা কথা ভাবলে তোমাদের একটু মজা পাওয়ার কথা। ভেবে দেখো, এই তো কয়েকমাস আগেই তোমার মায়ের বা বাবার অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা হাতে নিয়ে একটু বেশি সময় ধরে নাড়াচাড়া করলেই সবাই রে রে করে বকে উঠে বলতেন, ‘এই ফোনটাই যত নষ্টের গোড়া। পড়াশোনা সব লাটে উঠে যাচ্ছে। তোমাদের হাতে এসব দেওয়াই ভুল।’

আর এখন সেই অ্যান্ড্রয়েড, সেই ইন্টারনেট, সেই মায়ের বা বাবার ফোনটাই তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা বলছেন, ‘নাও ক্লাস করো। স্কুলের নোটস, হোমটাস্কগুলো টুকে নাও।’ অনলাইনে ক্লাস করছো তোমরা ল্যাপটপ বা ফোনের স্ক্রিনের সামনে চোখ রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা... আর তোমাদের মন চলে যাচ্ছে সেই ইস্কুলের মাঠের পাশে একলা দাঁড়িয়ে থাকা জারুল গাছটার নীচে... দেখতে পাচ্ছো দেবদারু গাছের সারির ফাঁক দিয়ে ওই পিছনের টগর গাছের কোটরে বাসা বাঁধা কাঠবিড়ালির সংসার... স্কুল ক্যান্টিনের লুচি আর ধোঁয়া ওঠা ঘুগনির প্লেট... আর ওই তো, ঘন্টা দেওয়া হরিকাকুর পিছনে পাঁউরুটির লোভে ঘুরঘুর করা কালুয়া নামের কুকুরটা...। আহা, যেন কোন সুদূর অতীতের স্মৃতি এসব। এখন বেশি বেশি করে পেয়ে নিশ্চয়ই তোমাদের আর অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সময় কাটাতে ভাল লাগছে না। সেখানে তো মুক্ত বাতাস নেই। মাঠ নেই। বন্ধুদের ছুঁতে পারা নেই।

অঙ্কন রায়

(ছবি : সৌম্য চট্টোপাধ্যায়)


ইস্কুল নেই/ ৬

কতদিন যাই না যে স্কুলে

সৃজনী মুখোপাধ্যায় 

স্কুল— এই শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে শিহরণ লাগে। স্কুল মানেই তো হুটোপাটি, টিফিন কেড়ে খেয়ে নেওয়া, লেগপুল করা, ক্লাসের ফাঁকে গল্প করা, খেলাধুলো, পরীক্ষার সময় বন্ধুদের উত্তর বলে দেওয়া এমনকি মাঝে মাঝে মারপিটও। এসব পড়ে বড়দের নিশ্চয়ই হঠাৎ স্কুলজীবনের দুষ্টু মিষ্টি স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমাদের মতো স্কুলপড়ুয়াদেরও এমন অনেক পুরোনো স্মৃতি মনের মধ্যে ভীড় করে আসছে। এ মা! অবাক কান্ড! স্কুলপড়ুয়াদের আবার স্কুলের স্মৃতি পুরোনো হতে যাবে কেন? 

কারণটা আমাদের সকলের জানা। কারণটা হল সেই বিভীষিকা— ‘করোনা ভাইরাস’— যার ভয়ে গোটা বিশ্বের মানুষ সিঁটিয়ে আছে, আর সেই দানবটার জন্য সারা দেশ জুড়ে লকডাউন, আর তার জেরেই আমাদের স্কুলও বন্ধ। আজ তেইশে আগস্ট, লকডাউন শুরু হয়েছিল চোদ্দই মার্চ। প্রায় ছ’মাস ধরে আমরা সবাই ঘরে বসে আছি। প্রথম লকডাউনটা শুরু হয়েছিল ঠিক সেই সপ্তাহের আগে যে সপ্তাহে আমাকে সব স্কুলের প্রজেক্ট শেষ করে জমা দিতে হত। এদিকে সেই সময় আমার শেষ হয়েছিল মাত্র একটা। করতে হবে সাতটা। হাতে মাত্র এক সপ্তাহ আছে শুনে আমার জ্ঞান হারানোর জোগাড়। এমন সময় তেরোই মার্চ বাবা এসে জানালেন এই সপ্তাহ থেকে গোটা দেশ জুড়ে লকডাউন। আমি তখন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার নিজেকে তখন প্রচন্ড ভাগ্যবান মনে হল, আর মনে হল ঠাকুর স্বয়ং আমাকে বাঁচানোর জন্য এই লকডাউন শুরু করিয়েছেন। তখন মনে হয় আমার থেকে বেশি এই লকডাউন হওয়া নিয়ে কেউ খুশি ছিল না। কিন্তু এখন আপনারা বিশ্বাস করুন, যদি আমায় দশটা প্রজেক্ট করতে হত আমি তাও করতাম। অন্তত এই যন্ত্রণা থেকে তো মুক্তি পেতাম। কতদিন হল বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না। ওদের খুউব মিস করি। একসঙ্গে আড্ডা মারা, গল্প করা, টিফিন খাওয়া, এমনকি লেগপুলিংটাও খুউব মিস করছি। আর শুধু ওদের নয়, স্কুলটাকেও খুউব মিস করছি। আমাদের ক্লাসরুম, ডাস্টার, চক, চকের গন্ধ... সব... সবকিছু মিস করছি। এমনকি টিচারদের সঙ্গে খুনসুঁটিটাও খুউব মিস করছি। বসন্ত উৎসব, স্পোর্টস...  আরও কত স্মরণীয় স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। জানি না আর কতদিন এভাবে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে। আর ভাল লাগছে না। আমার ঠাকুরের কাছে একটাই প্রার্থনা, তিনি যেন এই দুষ্টু করোনা ভাইরাসকে একদম ভ্যানিশ করে দেন, মানুষদের সুস্থ করে দেন, আর আমাদের স্কুলটাও যেন খুলিয়ে দেন। আর আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা সবাই দয়া করে করোনা ভাইরাসের সুরক্ষা বিধি মেনে চলুন যাতে আমরা সবাই মিলে ওই নিষ্ঠুর না দেখা দানবটাকে বধ করতে পারি। 

(নবম শ্রেণি, নব নালন্দা স্কুল, শান্তিনিকেতন)


ছোটগল্প

ছায়ামূর্তি

প্রকাশ কর্মকার 

যাত্রাপালা শুনে সুরেশ ও জগন্নাথ বিশালাক্ষীর মাঠ দিয়ে বাড়ি ফিরতে লাগলো। পূর্ণিমার রাত। বিস্তীর্ণ মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ধু ধু করছে। গ্রাম এখনও চার মাইল পথ বাকি। দু’জনে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। এমন সময় জগন্নাথ অনুভব করলো কেউ যেন তাদের পেছনে পেছনে তাদের সাথে হেঁটে চলেছে। জগন্নাথ সুরেশকে কিছু না বলে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সুরেশও ওই একই জিনিস অনুভব করলো। সুরেশ  জগন্নাথকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের পেছন পেছন কেউ আসছে মনে হয়।’ জগন্নাথ বলে ‘হ্যাঁ আমিও তাই অনুভব করছি অনেকক্ষণ ধরে।’ দু’জনেই পিছন ফিরে তাকাতে তারা কিছুই দেখতে পেলো না। সামনের দিকে তাকাতেই তারা অবাক... ‘একি আমরা তো দুজন, কিন্তু ছায়া পড়েছে তিন জনের!’

আবার তারা পিছন ফিরে তাকালে কাউকে দেখতে না পেয়ে খুব ভয় পেয়ে যায়। তারা দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। যত দ্রুত হাঁটতে থাকে ছায়াটাও তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকে। জগন্নাথ এবং সুরেশ এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে তারা কোন পথে হাঁটছিল খেয়াল ছিল না। যখন হুঁশ ফিরল দেখলো তারা গ্রামের পথে না এসে ভূষণদাগার মাঠে জঙ্গলের পথে এসে পৌঁছেছে। ‘একি আমরা তো অন্য পথে চলে এসেছি।’ সুরেশ দেখে ছায়ামূর্তিটি তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। জগন্নাথ ও সুরেশ একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। ভয়ে তারা কাঁপতে থাকে। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে একটি বিরাট আকার মানুষের অবয়বে প্রকট হল। মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু গম্ভীর গলায় মূর্তিটি বলে উঠলো... ‘ভয় নেই তোমাদের,  তোমাদের আমি কোনো ক্ষতি করব না, আমার একটা কাজ তোমাদের করে দিতে হবে, আমি জানি তোমরাই একমাত্র এই কাজ করতে পারবে, তাই আমি তোমাদের পিছু নিয়েছিলাম।’ সুরেশ সাহস পেয়ে বলে... ‘কে আপনি, আর কি করতে হবে আমাদের?’  



‘বলছি বলছি আগে তোমরা আমার পিছু পিছু এসো।’ এই বলে মূর্তিটি গভীর জঙ্গলের দিকে এগোতে থাকে, সুরেশ ও জগন্নাথও মূর্তিটির পিছু পিছু যেতে থাকে। এ রকম করে প্রায় আধঘন্টার পথ পেরিয়ে জঙ্গলের মাঝে এক ফাঁকা জায়গায় এসে মূর্তিটি দাঁড়ায়। 

সুরেশ ও জগন্নাথ দেখে একটা বড়ো পাথরের সামনে ছায়ামূর্তি দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর পাথরটি আপনা আপনি সরে যেতে থাকলো। পাথর সরে যেতেই একটা প্রকাণ্ড গর্তের মুখ বেরিয়ে এলো। ছায়ামূর্তি সুরেশ ও জগন্নাথকে তার পিছু অনুসরণ করতে বললো। সুরেশ ও জগন্নাথ গর্তের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখলো একটা সরু সুড়ঙ্গ কিছু দূর এগিয়ে গেছে। অন্ধকার ছিল তাই ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু একটু এগিয়ে যেতেই তারা যা দেখলো নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। সামনে বিরাট রাজপ্রসাদ। ছায়ামূর্তি  বললো... ‘এই দেখো এটা আমার গুপ্ত রাজপ্রসাদ, আর আমি হলাম এই প্রাসাদের মালিক জমিদার কুমুদ কিংকর মজুমদার। আমি এই বিপুল সম্পদ রেখেছি আমার প্রজাদের দুঃসময়ে সাহায্যের জন্য। কিন্তু আমার সেই আশা ওরা পূর্ণ হতে দিল না।’ সুরেশ জিজ্ঞেস করে..‘কে করলো আপনার এই অবস্থা? বলুন আমরা জানতে আগ্রহী।’

ছায়ামূর্তি বলে...‘সামনের সুন্দরগড় ছিল আমার জমিদারি এস্টেট, যে গ্রামে এখন বেশির ভাগ গরিব মানুষের বাস, সেখানে একসময় রাম রাজত্ব ছিল, কোনও মানুষের কোনও অভাব ছিল না। আমি ছিলাম সেখানকার জমিদার। আমার পাঁচ মেয়ে ছিল, অনেক কবিরাজ, ডাক্তার দেখিয়ে, মন্দিরে মন্দিরে মানত করেও একটাও পুত্রসন্তান হয় নি। এত বড়ো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে হবে এই ভেবে ভেবে আমার স্ত্রীর মাথা গেলো খারাপ হয়ে। আমার পাঁচ কন্যা দেখতে যেমন ছিল রূপসী ঠিক তেমনি বুদ্ধিমতি। ওদের নিয়ে আমার কোনও চিন্তা ছিল না। পুত্র সন্তান ছিল না বলে আমার কোনো আক্ষেপও ছিল না। কিন্তু আমার স্ত্রীর পাগলামি দিন দিন বাড়তে লাগলো। ওর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা পয়সা খরচ করলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। নায়েব মশাই একদিন একটা প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে হাজির হল। তার ছেলে নিশিকান্তকে আমার স্ত্রীর কাছে রাখার পরামর্শ দিলে আমিও রাজী হয়ে গেলাম। কয়েকদিন খুব ভালোই চলছিল, আমার স্ত্রীর মাথা ঠিক হতে লাগলো। একে একে পাঁচ কন্যার বিবাহ দিলাম। আমার সময় আবার ভাল হতে লাগলো। একদিন আমি একা বসে আছি হঠাৎ নায়েব মশাই আমায় এসে বললো... ‘জমিদার মশাই আপনার বয়স তো বাড়ছে, আপনার পরবর্তীতে যে আপনার জমিদারির দেখভাল করবে তাকে সমস্ত বুঝিয়ে দিলে ভাল হয়।’ আমি বলি ‘আমিও তাই ভেবেছিলাম।’ নায়েবমশাইকে মেয়েদের আসতে খবর পাঠাতে বললাম। শুনে নায়েব মশাই একটু ঢোক গিলে বললেন ‘এত বড় জমিদারি কি মেয়েরা সামলাতে পারবে? আমার একটা প্রস্তাব ছিল জমিদার বাবু, আমি বলছিলাম কি আমার পুত্র নিশিকান্ত তো জমিদারি পাঠ ভালোই বুঝে গেছে, ও এখন না হয় কাজ করুক আপনার তত্ত্বাবধানে, পরে কি হয় দেখা যাবে।’ আমি বললাম ঠিক আছে নায়েব মশাই। এমনি ভাবে সব ঠিক চলছিল কিন্তু একদিন নিশিকান্ত একটা কাগজ এনে আমায় তাড়াতাড়ি সই করার জন্য বললো, আমি কিছু না পড়ে সই করে দিলাম। এইভাবে প্রায়ই নিশিকান্ত একটা করে কাগজ এনে সই করিয়ে নিত। একদিন কাগজে কি লেখা আছে পড়তেই আমার তো চোখ কপালে উঠে গেল। একি! জমি বিক্রির দলিল! নিশিকান্তকে জিজ্ঞেস করলে ও বলে ‘খরচা বেড়েছে, তার উপর খাজনা আদায় কম হয়, জমিদারি চালাতে টাকার অভাব দেখা দিচ্ছে, তাই কিছু জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনার বয়স বেড়েছে তাই এইসব বলে আপনাকে আঘাত দিতে চাইনি।’ এই কথা শুনে আমি খুব রেগে যাই। আমি নিশিকান্তকে বলি ‘দেখো বয়স বাড়লেও আমার মতামত নেবার প্রয়োজন ছিল। ভবিষ্যতে কিছু করার আগে আমাকে জানিয়ে করবে।’ সে দিন আমি বুঝিনি এই কথা নিশিকান্তর ভালো লাগেনি। কিছু দিন পর জানতে পারি জমিদারির অর্ধেক সম্পত্তি নিশিকান্ত নিজের নামে করে নিয়েছিল। নিশিকান্তর মনোভাব ভাল বুঝছিলাম না তাই আমি আমার বাকি জমি সম্পত্তি আমার স্ত্রী ও পাঁচ মেয়ের নামে উইল করে দিই। এই যে গুপ্ত কুঠুরিতে আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি এর সুড়ঙ্গ পথ জমিদার বাড়ির শিব মন্দিরের পেছনে ভোগ গৃহে শেষ হয়েছে। এই গুপ্ত কুঠুরিতে সেই উইল লুকানো আছে। আমার সাথে এসো দেখাচ্ছি।’ (ক্রমশ)


কবিতা

আনন্দপাঠশালা

মিমি সিদ্দিকী

কোথায় কোথায় একটি পাখি

      গাইছে যেমন তেমন—

তাই-না দেখে দুষ্টু বেড়াল

      ডিগবাজি খায় কেমন?


কোথায় জানো পাতার কোলে

     ফুল শিশুরা হাসে?

টুম্পা বুবুন কেউ ছেঁড়ে না,

      বরং গন্ধে ভাসে...


কোথায় কোথায় অঙ্ক ভুলে

      কানমলা নেই কোনো?

কেবল মেঘের গল্প শোনা

      কোথায় তুমি জানো?


মেঘদুপুরের ইচ্ছেঘুড়ি

     ভোকাট্টার খেলায়—

কোথায় আবার খেয়ালখুশির

      আনন্দপাঠশালায়...

Post a Comment

0 Comments