পান্থ/ ৬ । সুন্দরী গ্রাম লেপচাখার পথে

সুন্দরী গ্রাম লেপচাখার পথে

হোমাগ্নি ঘোষ

ক্সা টাইগার রিজার্ভের মূল ফটকটা পেরোতেই শুরু হল ঘন শাল বনের সারি, তার সঙ্গে শুকনো পাতার ঝরে পড়ার নিঃশ্বাস, হটাৎ করে কানে এলো এক কর্কশ শব্দ, অটোর সামনের কাচ দিয়ে দেখলাম বাহারি পেখম তুলে উড়ে গেল একটা ময়ুর কিন্তু ওর কর্কশ শব্দটা মিশে গেল বনের মাধুর্যতার সঙ্গে। আমাদের গন্তব্য আলিপুরদুয়ার থেকে সান্তালাবারি দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার, রাস্তা মাঝে ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে জয়ন্তীর পথে, আর আমরা তাকে পাশে রেখে লোয়ার বক্সা টাইগার রিজার্ভের সীমা বরাবর এগোতে লাগলাম পথে পড়তে লাগল রেস্ট হাউস, ছোট ছোট কাঠের বাড়ি তার মাঝে কাঠ চেরাই করছে কিছু আদিবাসী যুবক, বাতাসে কেমন যেন মহুয়া শাল ইউক্যারিপটাস মিশানো মাদকতার গন্ধ, পাশে বয়ে চলেছে শুকনো জয়ন্তী নদীর ভগ্নপ্রায় রুপ যা বর্ষাকালে মাতাল আকার ধারন করে।

বক্সা অথবা জয়ন্তী যেতে হলে বক্সা টাইগার কনজারভেশন ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট-এর পারমিট করাতে হবে, জনপ্রতি ৬০ টাকা এবং গাড়ির জন্যে ২৫০ টাকা, গাড়ির ভাড়া ফিক্স নয় বড় গাড়ি করলে আরও ভাড়া পরবে। অটো কিছুক্ষণের মধ্যেই সান্তালাবারি থামল। এখান থেকে শুরু হবে আমাদের পথ চলা, পাহাড়ি গ্রাম লেপচাখা। মোট ৫ কিলোমিটার রাস্তা, ঠিক করলাম ট্রেক করে যাব, এক্ষেত্রে গাড়ি যায় একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত, স্থানীয় মানুষ বলে থাকে জিরো পয়েন্ট।

চলা শুরু করতেই দেখলাম পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে আসছে রঙ বেরঙ্গের এর ড্রেস পরা কচিকাঁচার দল, আমাদের গাইড (গাইড নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ, গাইড সান্তালাবারি থেকেই পাওয়া যায়, লেপচাখা নিয়ে যেতে নেবে ৩০০ টাকার কাছাকাছি) -এর নাম প্রেম, প্রেমকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এরা ভূটান সীমান্তের জয়গাও গ্রামের সেন্ট পলস এর সমস্ত ছাত্রছাত্রী। চড়াই ভাঙতে ভাঙতে আমরা চলে এলাম সদরগ্রাম, ছোট গ্রামে গুটি কয়েক জনপদ, দূরে সবুজ কুয়াশায় মাখানো জয়ন্তী নদীর শুখনো প্রতিছবি, তার ডানপাশ ধরে বয়ে গেছে বালা নদী আর বিপরীতে বক্সা নদীর কাচের মত টলটলে জল, পথে পড়ল আর একটা ছোট নদী, নাম জানতে পারলাম মাশানি নদী, দুরে পাহাড়ের বুকে দেখা যাচ্ছে চুনিয়া ভাটি গ্রাম, সদরগ্রামের পর আর একটা গ্রাম এলো নাম তার খাম্নিনি গ্রাম তার থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দুরেই লেপচাখা গ্রাম, সদরগ্রাম পেরোতেই নজরে এলো বক্সার প্রাচীন দুর্গ, যেটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও বিরাজমান, ভুটানের রাজা বিখ্যাত রেশম পথ যেটি তিব্বতকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেছিল তাকে বাঁচাতে এই দুর্গকে ব্যবহার করত। প্রায় ২৮৪৪ ফিট উচ্চতার এই দুর্গ সন্ধ্যার মায়াজালে তৈরি করছিল অদ্ভুত এক আবেশ আর তাতে আমরা ডুব দিচ্ছিলাম।

সূর্যাস্ত হচ্ছে পাহাড়ের বুকে, বাইবেলের কোনও এক ছত্রে আছে পাহাড়ের বুকে সূর্যাস্ত দেখা মানে ঈশ্বর দর্শন করা, পাহাড়ের প্রতিটা ঢালে ঘন জঙ্গলের প্রতিটা গাছের পাতায় গোধূলির আলো মাখিয়ে দিচ্ছে ঈশ্বর, স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রকৃতি যেন বলছে এসো আমার হৃদয়ে এসো, আমি প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করি তোমার উপস্থিতি।

লেপচাখা পৌছাতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেছিল কিন্তু সেই ৫ কিলোমিটার ট্রেকের অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ, সেখানে আছে অনেকগুলো হোম স্টে। এখানকার গরীব মানুষগুলো তাদের বাড়ির একটা ঘর ছেড়ে দেয় অতিথিদের জন্যে আর তাদের রান্না করা খাবারই খায় অতিথিরা, অদ্ভুত আক হৃদ্যতা গড়ে ওঠে ভালবাসার, বিশ্বাসের, বন্ধুত্যের। আমরা ছিলাম দিদির হোম-স্টেতে। রাতের বেলা সোনম দিদি নিজের হাতে গরম গরম রুটি আর সব্জি বানিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সোলার আলোর নিভু নিভু আলোয় তিব্বতীয় মন্ত্রোচ্চারণ এক অদ্ভুত রহস্যময় স্নিগ্ধ পরিবেশের জন্ম দিয়েছিল।

Post a Comment

0 Comments