ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ৭ । পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর

পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর

তড়িৎ রায় চৌধুরী

কে একে নিভিছে দেউটি। করোনা এবার হাত বাড়িয়েছে অসাধারণদের দিকে। রোজই রাজা উজির মারছে দু চারটে করে। ফলত স্তব, শুভকামনার সঙ্গেই আসছে বিদ্বেষ বাক্য বাণ। কেউ ক্ষুব্ধ, কেউ উদাসীন। এই দ্বন্দ্বময় আবহে এসে পড়ল ২২শে শ্রাবণ। গুটিকয় যে বাংলা তারিখ মনে থাকে তার একটা। কবিগুরুর প্রয়াণ দিবস। কবিগুরু! অন্য সব বাদ দিলাম, কবিতার জগতেও অবিমিশ্র পূজার আসন কি পেয়েছেন তিনি? ১৮৮৬ তে প্রকাশিত হয় ‘কড়ি ও কোমল’। নতুন গন্ধের তীব্রতায় বিরক্ত নবজীবন পত্রিকার সম্পাদক লিখলেন, “তোমাদের গুরুভক্তি ধন্য—তোমাদের মহাগুরুর আদর্শ— ন কাব্য, ন কবিতা। কেবল কাব্যি। কেবল শেলির দোহাই দিয়া কি এই কৃত্তিবাস, কাশীদাস, কবিকঙ্কন পরিপুষ্ট অপূর্ব সাহিত্য সম্পত্তি নষ্ট করিবে?”

কাব্যবিশারদ তো আরো এক কদম এগিয়ে বই-ই লিখে ফেললেন ‘মিঠেকড়া’। “উড়িস নে পায়রা কবি/ খোপের ভিতর থাক ঢাকা/ তোর বকবকম আর ফোঁস ফোঁসানি/ তাও কবিত্বের ভাব মাখা।/”

শুধু তো এরা নন সূর্যগ্রহণের আগ্রহে বহু রাহু কেতুই তখন মঞ্চে সমাসীন। ‘মদন ভস্মের পরে’-র অনুকরণে এলো ‘বদন ভস্মের পরে’।

“কবীন্দ্রেরে লুব্ধ করে করেছ এ কি দেশবাসী/ মাস্টারিতে দিয়েছ তারে চড়ায়ে।/ হায় গো কবি, ঠাট্টা যারে করিতে আগে উল্লাসি/ গর্তে তারি আপনি এলে গড়ায়ে।/” 

বলা বাহুল্য রাহু-কেতুগণ চিরকাল-ই সমর্থ শরীরহীন। গ্রাস করার প্রয়াস থাকে কিন্তু পরিপাক করার ক্ষমতা থাকে না। সৌভাগ্য এই; রবীন্দ্রনাথ এসবে মেজাজ হারিয়েছেন কম। তিনিও প্রথম পর্বে তত পচ্ছন্দ করেননি মধুকবিকে। আবার বোঝার আগ্রহে বৈষ্ণব সাধক কবি কে প্রশ্ন করেছেন “এত প্রেমকথা—/ রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা/ চুরি করি লইয়াছ কার মুখ,কার আঁখি হতে!/” আসলে অপচ্ছন্দে বিষোদ্গার  আর অতিক্রমণ আগ্রহে ভেঙে চুরে দেখা এক জিনিস নয়। আর তাই এইসব রাহু কেতুদের সঙ্গে মেলানো যাবে না কল্লোল যুগের কবিদের। আসলে সমকালীন সংঘাত যেমন অনিবার্য, তেমনি থাকে প্রজন্মগত পার্থক্য। 

“পশ্চাতে শত্রুরা শর হানুক ধারালো/ সম্মুখে থাকুন বসে পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর, আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষ আলো/ যুগ-সূর্য ম্লান তার কাছে। মোর পথ আরো দূর!/”— নিছক ছেঁদো ঈর্ষা নয় এ এক আত্ম আবিষ্কার। আত্মপ্রতিষ্ঠার তাগিদ তাড়িত করে। ১৯২৩ এ আত্মপ্রকাশ করে কল্লোল। সাংস্কৃতিক সিগন্যালই তখন পাল্টে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বলশেভিক বিপ্লব, ফ্রয়েডের অবচেতন ও যৌনতা তত্ত্ব, সাহিত্যে  ন্যাচারালিজম, বন্ধ্যা সময়ে ‘দ্য ওয়েষ্ট ল্যান্ড’, আবার দেশের রাজধানী সরে গেছে দিল্লীতে এক দশক, জনসংখ্যার চাপে বেড়েছে শিক্ষিত বেকার, নারীপুরুষের মেলামেশার ধরন বদলেছে। নিরাবেগ বুদ্ধিধর্মে বেড়েছে আস্থা। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে নতুন করে তো নিতেই হবে কবিতার পাঠ। যেমন এক যুগের ভক্তি নির্ভর পদাবলী ভিন্ন সময়ে ভালোবাসার ভাষা হয়ে যায়। পূজা মিশে যায় প্রেমে। 

বুদ্ধদেব যেভাবে দেখেন “যাকে কল্লোল যুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই বিদ্রোহ, আর সে বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অভাববোধ জেগে উঠল—সুখস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার প্রয়াস, রবীন্দ্রনাথ কে সহ্য করার, প্রতিরোধ করার পরিশ্রম। প্রয়োজন ছিল এই বিদ্রোহের—বাংলা কবিতার মুক্তির জন্য নিশ্চয়ই, রবীন্দ্রনাথকেও সত্য করে পাবার জন্য।” সত্য করে পাবার, অতিক্রম করে যাবার ঘটা একদিন হয়েছিল বলেই আরো পরের কবিরা “রবীন্দ্রনাথ কে অস্বীকার ও পুনরাবিষ্কার” নামে বই লিখতে পারবেন। বলতে পারবেন “যারা মনে করে বিদ্রোহ মানে অপরের নিন্দা ও কুৎসা, তারা বিদ্রোহীও নয়, কবিও নয়।” ওই চর্চার শ্রমটা না থাকলে ভোগান্তির শেষ নেই। এখন তো রবীন্দ্রনাথই বিদেশ। চিনিই না তাঁকে। বন্দি সময়ে বেড়াতে গেলে বেশ হয়। ‘ছিন্নপত্র’ দিয়েই না হয় শুরু হোক ‘টেগোরল্যান্ড’ পরিভ্রমণ। সস্তা গাইডের সহজ পাচ্য রমণীয় আস্বাদ নয়। নিজে ঘুরে দেখা। হয়তো হঠাৎ কোনও বাতাস এসে লাগবে হৃদিপটে। বদল আসবে যাপনের ছন্দে। স্রোতে ভেসে স্তব আর বিদ্বেষ-র বাইরে কোনও দেশে পৌঁছাব। বুঝব কারও অসুস্থতা বা বিপদ নিয়েও খিল্লি-উল্লাস নিজেরই অসুস্থতা প্রমাণ করে। কুৎসা কখনও দীর্ঘসময় বাঁচে না। 

Post a Comment

0 Comments