আনন্দপাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

গত পরশু ছিল বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরুর চলে যাওয়ার দিন। কিন্তু শান্তিনিকেতনে সেই দিনটিতে নতুন প্রাণের আহ্বান জানাতে রোপণ করা হয় নতুন বৃক্ষের চারা। সেই অনুষ্ঠান ঘিরে যে উৎসব, যে নান্দনিকতা, তা বিশ্বের কাছে একটি দৃষ্টান্ত। আমরা প্রতি বছর হৈ হৈ করে এই ‘বৃক্ষরোপণ’ উৎসব পালন করে এসেছি। এই অভিনব উৎসবের আয়োজনকে অনুসরণ করে বিশ্বভারতী ছাড়াও আরও বহু শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণের উৎসব পালিত হয়। 

এ বছর আমরা দুঃসময়ের মাঝে বাস করছি। এই আতঙ্ক আর ভয়ের আবহে বৃক্ষরোপণ উৎসব কোথাও তাই সে ভাবে পালন করা যায়নি। কোথাও নিয়মরক্ষায় কয়েকজন মানুষ সামান্য আয়োজনে কবিকে স্মরণ করে বৃক্ষচারা পুঁতেছেন, কোথাও বা ‘অনলাইন’ করেই সারা হয়েছে কবিপ্রণাম।

কবি লিখেছিলেন, ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জনম দাও হে...’।  

আমরা, এই নিরুপায় এবং অসহায় মানবজাতি কবির সেই প্রার্থনার সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে, নিজের আত্মশক্তিকে অধিক বলশালী করে তুলতে ভয়কে অতিক্রম করে অভয়ের মাঝে নতুন জন্ম ভিক্ষা করছি প্রকৃতি মায়ের কাছে। 

আজ তোমাদের প্রিয় বিভাগ ‘আনন্দ পাঠশালা’ সেজেছে এক ছোট্ট বন্ধুর ইস্কুল যেতে না পারার কষ্ট নিয়ে লেখায়, একটি ভৌতিক ছোটগল্পে আর একটি কবিতায়। প’ড়ে মতামত জানিও। 

সাবধানে থেকো বন্ধুরা। ভালো থেকো। আমাদের জন্য লেখা/ছবি পাঠিও।

তোমাদের শুভকামনায়—

অঙ্কন রায়

ছবি : দ্বৈপায়ন বর্মন (পাবলো), আহমদপুর


ইস্কুল নেই/ ৪

স্কুলবন্ধের দিনগুলোতে

শরণময়ী বৈরাগ্য

আমি শিক্ষাসত্র স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। হঠাৎ করেই ১৩ মার্চ সন্ধেবেলায় জানতে পারলাম যে ১৪ মার্চ থেকে আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যাচ্ছে। কবে খুলবে জানতে পারিনি তবে আশা ছিল অজানা অসুখ ছড়ানো থেকে বেঁচে তাড়তাড়িই আবার সব খুলে যাবে। হল না। আজ ৬ আগস্ট। এত মাস হয়ে গেল স্কুল যেতে পারিনি। এ বছর আমাদের সাহিত্য সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদিকা ও দেওয়াল পত্রিকা সম্পাদক, দেওয়াল পত্রিকা সম্পাদিকা হওয়ার কথা ছিল। আমরা সেটা থেকে বঞ্চিত হলাম। আমার খুব উৎসাহ ছিল এটাতে। কিন্তু আমরা কিছুই হওয়ার সুযোগ পেলাম না। তার জন্য আমার খুব মন খারাপ। আমাদের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাসের দিকে একটা বিরাট বটগাছ আছে। তার নীচে সাহিত্যসভা হত। তার ঝুরিতে ঝুলে ঝুলে আমরা খেলতাম। যখন বড় দাদা দিদিদের পরীক্ষার জন্য আমাদের অন্য চালায় ক্লাস হত, সেটা বেশিরভাগই হত দ্বাদশ শ্রেণির চালায়। সেখানে এমন একটা গাছের ডাল ছিল, যেখানে আমরা দোল খেতে খুব মজা পেতাম। স্কুল থেকে বেরিয়ে লুকিয়ে বকুলতলায় গিয়ে সোনাকাকুর হাতের মুড়ি মাখা আর আইসক্রিম নিয়ে এসে খেতাম। স্কুল ছুটি হওয়ার পর সন্তোষ পাঠশালায় খেলতে যেতাম। 

আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল লাইব্রেরি। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম, বই লুকিয়ে রাখতাম। আরও অনেকভাবে নিজেকে খুশি করতাম। সেই জায়গাগুলোতে যেতে পারছি না বলে খুবই কষ্ট পাচ্ছি। কতদিন হয়ে গেল বন্ধুদের দেখতে পাচ্ছি না। তাদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি, কুমিরডাঙা, কাবাডি, ক্রিকেট, ফুটবল কিছুই খেলতে পারছি না। খোলা হাওয়ায় চালার নীচে বসে ক্লাস করতে পারছি না। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা দাদা দিদিদের ভালবাসা আর বকুনি থেকেও দূরে পড়ে আছি। এখন হোয়াটসঅ্যাপে যে অনলাইন ক্লাস হয়, সেখানে কারও মুখ দেখা যায় না৷ এই জন্য এই ক্লাসগুলো করতে আমার খুব বিরক্ত লাগে কারণ স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা ও বন্ধুদের বিভিন্ন জনের আলাদা আলাদা কথা বলার ধরন আমাদের ক্লাস করার একঘেয়েমি কাটিয়ে দিত। কাউকে দেখতে না পেয়ে ক্লাস করতে গিয়ে খুবই বোর হই। 

স্কুল বন্ধ হয়ে আমরা প্রতিদিনকার হাসি মজা, গান গল্প, খেলা, ছড়া বলা...  এসব থেকে আলাদা হয়ে গেছি। এখন শুধু বসে বসে দিন গুনছি কবে আমার পুরোনো স্কুলজীবন ফিরে পাব।

চতুর্থ শ্রেণি, শিক্ষাসত্র স্কুল, বিশ্বভারতী।


ছোটগল্প

লিফট 

অতনু রায়

বালিজুড়ি আর গোগলা গ্রামের মাঝে টুমুনি নদী। একসময় যখন ব্রিজ ছিল না, তখন গোগলা গ্রামের মানুষদের দুর্গাপুর যাওয়ার জন্য পাণ্ডবেশ্বর হয়ে ঘুরে যেতে হতো। এখন অবশ্য পাকা ব্রিজ পেরিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে দুর্গাপুর যাওয়া যায়। অরবিন্দ এইসব শুনে ছিল পলাশের কাছে। পলাশ এই এলাকার মানুষ। অরবিন্দর সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। এখন কাজের সূত্রে থাকে আমেদাবাদে।

অরবিন্দ গোগলা গ্রাম পঞ্চায়েতের সেক্রেটারি পদের চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখেই পলাশকে ফোন করেছিল। সব তথ্যই মোটামুটি ঠিক ঠিক দিয়েছে, শুধু এই বাস যোগাযোগের যে এত দূরাবস্থা সেটা বলেনি। আর সেজন্যই অরবিন্দ এখন মাঝ রাস্তায়, নবঘনপুর নামাঙ্কিত একটা অর্ধভগ্ন বাসযাত্রী প্রতিক্ষালয়ে খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় মুখ চুন করে বসে আছে। এত দূর অবধি আসাটাও কম ঝকমারির ছিল না। একেই তো ও নতুন লোক, তারপর জায়গার নাম জানে না। মোটর সাইকেল আরোহীদের কাছ থেকে লিফট চাইতেও সমস্যা হচ্ছিল। এখন তো আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। এই ভাঙা ঘর থেকে যতটুকু দেখা যায় তাতে মোটরসাইকেল তো দূরের কথা, সাইকেল নিয়েও কাউকে দেখতে পায়নি অরবিন্দ।

দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে খুব তাড়াতাড়ি। মেঘ করে আছে বলে আরও বেশি অন্ধকার। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজছে। যে লোকটি অরবিন্দকে এই অবধি ছেড়ে দিয়ে গেছে, তার কথা ঠিক হলে আর আধঘণ্টার মধ্যেই শেষ বাস আসার কথা। অগত্যা অপেক্ষা করতে থাকে অরবিন্দ। আর বার বার ঘড়ি দেখতে থাকে। সময় এগিয়ে চলে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। চারপাশে ব্যাঙের একটানা আওয়াজ আর থেকে থেকেই মেঘের গুড়গুড়, এছাড়া আর বাকি পৃথিবী যেন ঘুমিয়ে আছে। অরবিন্দর ঘড়িতে ছ’টা পেরিয়ে সাড়ে সাতটা বেজে যায়, বাসের কোনও দেখা নেই। অরবিন্দ বুঝতে পারে আজ রাত্রিটা ওকে এই খানেই কাটাতে হবে। বৃষ্টি থামারও কোনও লক্ষণ নেই। এমন সময় একটা মোটরসাইকেল ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরবিন্দ একটু ভরসা পেলো। গাড়ির চালক ভেতরে ঢুকে এসে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসে নিজের মনেই বলল, “একদম ভিজে গেলাম!” তারপর অরবিন্দকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কতক্ষণ আটকে আছেন?” অরবিন্দ উত্তর দিলো, “আমি সেই চারটে থেকে এখানে শেষ বাসের অপেক্ষায় আছি। বাস তো এল না। আর আসবে বলেও তো মনে হয় না।’’

লোকটা হা হা হা করে হেসে উঠে বলল, “এই লাইনের শেষ বাস একটু হাওয়া দিলেই বন্ধ থাকে। আর এই বৃষ্টিতে তো আসার সম্ভাবনা নেই। তা কোথায় যাবেন?”

“আমি দুর্গাপুর যাব। এ তো মহা বিপদে পড়লাম। এখন এই মশার কামড়ে রাত কাটাতে হবে দেখছি।” অরবিন্দ উত্তর দেয়।

আগন্তুক বলে, “আরে বাহ্! আমি তো হেতেডোবা মোড় অবধি যাব। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। ওখান থেকে একটু হেঁটে চলে যাবেন।” অরবিন্দ হাতে স্বর্গ পেলো। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে, “আপনি আমাকে বাঁচালেন। ওফ, এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় সারা রাত থাকতে হলে...”

অরবিন্দকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আগন্তুক বলে উঠলো, “বাঁচা মরা কী আমাদের হাতে আছে মশাই। চলুন চলুন বৃষ্টি ধরেছে বেরিয়ে পড়ি।” অরবিন্দ দেখল বৃষ্টি কমে এসেছে। বৃষ্টির শব্দ কমে যাওয়ার জন্য ব্যাঙের ডাক আরও তীব্র হয়ে কানে ভোঁ ভোঁ ধরিয়ে দিচ্ছে। অরবিন্দ ওর সাইড ব্যাগটা নিয়ে আগন্তুকের মোটরসাইকেলে উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু গিয়ে বেশ জঙ্গল মতো একটা জায়গায় হেড লাইটের ম্রিয়মাণ আলোতে অরবিন্দ দেখলো রাস্তার মাঝে একজন দাঁড়িয়ে আছে। এতো রাতে এই দুর্যোগের মধ্যে কে ও! ভাবতে ভাবতেই মোটর সাইকেল মানুষটির কাছে পৌঁছে গেল। আগন্তুক গাড়ি থামিয়ে রাস্তার মানুষকে জিজ্ঞেস করল, “কীঁ রেঁ মাঁধব, তুঁই আঁজ মাঁছ ধঁরতে যাঁস নাঁই?” আগন্তুকের গলার স্বর অস্বাভাবিক রকমের খনা-খনা মনে হল অরবিন্দর। অথচ একটু আগে তো ঠিকঠাক কথা বলছিল। এই ভাবনার মধ্যেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মাধব বলল, “আঁজ্ঞে নাঁ বঁটু দাঁ। আঁজ শঁরীরটা ভাঁলো লাঁগছে নাঁ। তাঁ তুঁমি এঁতো রাঁতে কোঁথায়?” আগন্তুকের উত্তর, “এঁই বাঁবু আঁটকে ছিঁল। এঁনাকে ছেঁড়ে দিঁয়ে আঁসি।” 

মাধব নামের ব্যক্তি হি হি হি করে হেসে বলল, “তুঁমার মঁরার পঁড়েও স্বঁভাব গেঁলো নাঁই। বেঁশ দিঁইয়ে এঁসো।” 

বলেই মানুষটি ভ্যানিশ হয়ে গেল। অরবিন্দর বুঝতে আর কিছু বাকি থাকে না। গলা দিয়ে আওয়াজটুকু বের করার সাহস পায় না। সে চুপ করে বসে থাকে। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। কোথায় যাচ্ছে অরবিন্দ দেখে না। সে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের নাম জপ করতে থাকে। হঠাৎ ধপ করে একটা শব্দ হলে অরবিন্দ চোখ খোলে। দেখে হেতেডোবার ফ্যাক্টরির পাশের জলকাদার মধ্যে সে পড়ে আছে। কোথায় মোটরসাইকেল, কোথায় আগন্তুক! কেউ নেই! অরবিন্দ কোনও রকমে কাদা থেকে উঠে দৌড় শুরু করে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়। প্রায় কুড়ি মিনিট পর ওদের পাড়ার মুখে এসে থামে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে ঈশ্বরকে প্রণাম করে। আজ ভূতের দৌলতেই সে বাড়িতে ফিরে আসতে পেরেছে। তবু ভূতের মোটরসাইকেলে চাপার আতঙ্ক ওর পিছু ছাড়ে না। কোনওক্রমে টলতে টলতে ঘরের সামনে এসে ধপ করে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

ছবি : অমল মাল


কবিতা

হাওয়া

শঙ্কর কুমার চক্রবর্ত্তী


হাওয়া উড়ে যায় বাঁশবাগানে

ঝরিয়ে দিল পাতা,

জানলায় এল দমকা হাওয়া

ওল্টালো বই খাতা।


হাওয়া নেচে চলে এদিক সেদিক

পিছনে বাঁশীর সুর,

উড়ে যাচ্ছে হাওয়ার টানে

মেঘগুলো খুব দূর৷


হাওয়া খেলছে জলের উপর

স্রোতের নাচানাচি,

হাওয়ার টানে উড়ে যাচ্ছে

ঝাঁক বেঁধে মৌমাছি।


হালকা হাওয়া লজ্জাবতী

ফুলকে দেয় চুম,

হাওয়ার রকম সকম দেখে

আকাশের এল ঘুম!


Post a Comment

2 Comments

  1. অতনুর গল্প আমার প্রত্যেক দিনের গল্প। আমি থাকি দূর্গাপুর এ আর পাঁচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সত্যি রকেটের যুগে এই পরিবহন ব্যবস্থা ভাবা যায়। অতনুকে ধন্যবাদ আমাদের কথা ভাবার জন্য। রাজীব চট্টোপাধ্যায় ।

    ReplyDelete
  2. অতনুর লেখাটা বেশ ভালো।

    ReplyDelete