আনন্দপাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

প্রিয় বন্ধুরা,

গতকাল আমাদের প্রাণপ্রিয় সাহিত্যিক শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন গেল। তাঁর কথা ভাবতে বসলেই মনের ক্যানভাস জুড়ে ভেসে ওঠে নিশ্চিন্দিপুর, ভেসে ওঠে অপু দুর্গার মুখ, ভেসে ওঠে কাশবনের ফাঁকে ধোঁয়া ওঠা রেলইঞ্জিনের ছবি। এই সব দৃশ্য যতটা বিভূতিভূষণের, ঠিক ততটাই যেন সত্যজিত রায়ের। পথের পাঁচালী পড়েছিলাম প্রথমবার ক্লাস সিক্সে। তখনই দুর্গাদিদির চলে যাওয়া মানতে পারিনি। অঝোরে কেঁদেছিলাম। পরে চলচ্চিত্রে সেই বই দেখতে গিয়ে যে কতবার চোখ ঝাপসা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। 

জানো, কাল বহুবার পড়া সেই পথের পাঁচালীরই কিশোর সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু বইটা আবার একবার পড়লাম পুরোটা। অপু দুর্গার সঙ্গেই কাটালাম প্রিয় সাহিত্যিকের জন্মদিন। আহা। কি চমৎকার কাটলো দিনটা নিশ্চিন্দিপুরের পথে পথে। আবারও একবার ভাবলাম এই সমস্ত কালজয়ী সাহিত্য যতবার পড়া যায়, ততবার যেন তার পরতে পরতে নতুন ভাবে নিজেকে আবিস্কার করা যায়।

তোমাদের এই কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হল তোমরাও অনেক অনেক কালজয়ী সাহিত্য পড়ো আর সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে ওঠো মননে, কাজে। সত্যি গো, এই দুঃসময়, এই করোনাকাল আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছে বইমুখি হয়ে ওঠা আমাদের কতখানি প্রয়োজন। 

আজকের আনন্দপাঠশালায় তোমাদের জন্য সুন্দর সুন্দর গল্প কবিতা নিয়ে এলাম। পড়ো আর মতামত জানাবে। কেমন?

তোমাদের বন্ধুদাদা

অঙ্কন রায়


ছোটগল্প/ ১

শব্দ জব্দ

তড়িৎ রায়চৌধুরী 


-- আচ্ছা বাবা, musk এর বাংলা কি হবে?

-- মুখাবরণী।

-- ওরে বাপরে। কি কঠিন শব্দ। এইজন্য বলে বাংলা খুব কঠিন ভাষা।

-- সহজ বাংলা একটা আছে। কিন্তু সেটা এ সময়ে ঠিক.... 

-- কি শব্দ? ঘোমটা?

-- এ শব্দটা তুই কোথায় শিখলি?

-- ওই যে বস্তি দাদু বলছিল ‘এ যুগে যত ধিঙ্গিপনা। ঘোমটা কি জিনিস সে তো মেয়েরা ভুলেই গেছে’— তাই...

-- তো ওই ঘোমটা মানে musk কে বললো?

-- তা বলেনি। বাট মা বলল আগে শাড়ি পরা মেয়েরা মাথার উপর দিয়ে কাপড় টেনে মুখ ঢাকত। তাকেই বলতো ঘোমটা। কি ফানি না?

-- ফানি কেন?

-- বারে, ওই ভাবে মুখ ঢাকা থাকলে দেখবে কি করে? হোঁচট খেয়ে মরবে তো!

-- না ঠিক অতটাও থাকত না। হ্যাঁ, মানে অনেক আগে থাকত। ক্রমে কমে এসেছিল।

-- সিনেমার মতো ট্রান্সপারেন্ট করতে পারত।ঘোমটাও হতো, দেখাও যেত।

-- হু। তা হয় বটে। আসলে সিনেমায় অ্যাকট্রেসের মুখ ঢেকে দিলে এক্সপ্রেশান দেখা যেত না যে। তাই হয়তো...

-- তাই এখন আর কেউ ঘোমটা দেয় না। এক্সপ্রেশানই তো ইমোজি বানায়। সো কিউট।

-- হ্যাঁ, ঘোমটা এখন অনেকটাই বাতিল। 

-- মোটেই না। ঘোমটা ইজ ব্যাক।

-- ঘোমটা??

-- মানে ঘোমটা মানে যদি musk হয় তো।

-- ওঃ। তা বটে।

-- আচ্ছা বাবা, বোরখা পড়লে তো musk লাগবে না বলো?

-- তা লাগবে না বোধহয়।

-- আই থিংক দ্যটস আ অপশান।

-- তুই কি করে জানলি? তুই বোরখা পড়েছিস নাকি?

-- হ্যাঁ। স্কুলে পড়েছি তো।

-- স্কুলে বোরখা!!!

-- আরে নাসরিন তো বাসে বোরখা পরে আসে। স্কুলে ঢুকেই খুলে দেয়। তখন আমরা মজা করে পরি। কেমন একটা অন্যরকম লাগে নিজেকে দেখতে।

-- বোরখাও কি ফ্যাশান ড্রেস হয়ে গেল নাকি?

-- আরে ইট লুকস্ সামথিং ডিফারেন্ট। তুমি না...

-- আচ্ছা। আচ্ছা। বুঝলাম।

-- তুমি কিন্তু সোজা বাংলাটা বললে না বাবা।

-- কিসের? 

-- musk এর।

-- মুখোশ।

-- ওওও। পড়েছি। বিলবোর্ডে ছিল।

-- বিজ্ঞাপনে!?

-- হ্যাঁ। মুখোশের আড়ালে না। মুখোমুখি। কিন্তু সেটা তো আনহাইজিনিক। হাইলি রিস্কি ব্যাপার। তাই না বাবা?

-- হ্যাঁ, না, মানে করোনাকালে শব্দগুলোর মানে পাল্টে যাচ্ছে রে।

-- মানে পাল্টে যাচ্ছে? সে তো ডিকসিনারিতে ফিক্স হয়ে আছে।

-- না রে। সবই পাল্টাতে পারে।... কত কিছুই পাল্টে গেল।

-- সে কি রকম??

-- সে অন্য একদিন বুঝিয়ে বলব। অনেকক্ষণ হয়ে গেল। চল্ হাত ধুয়ে আসি।

হাত ধুয়ে ফেলা কি ‘নিউ নর্মাল’ সময়ের শব্দজব্দ থেকে হাত ধুয়ে ফেলারই অছিলা মাত্র? হয়তো। শুধু শব্দ বোধ কেন, সব বোধই তো কেমন পাল্টে যাচ্ছে।


ছোটগল্প/ ২

অদ্ভুতুড়ে

গৌরী টুডু

পড়াশোনা ছাড়া শিবুর একমাত্র নেশা হল মাছ ধরা। বর্ষা আসার অনেক আগে থেকেই সে প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। কত রকমের জাল আছে তার সংগ্রহে। অল্প জলে পুঁটি, মৌরলা ধরার জন্য গোল জালি। কই মাছ ধরার জন্য বাঁধি জাল। বড় রুই কাতলা মৃগেল ধরার জন্য খেয়া জাল। হাঁটু জলে হাতড়ে ল্যাটা, মাগুর ধরার জন্য পলুই। বর্ষা চলে গেলে ছিপ দিয়ে মাছ ধরার নানা উপাচার। একাঙ্গী, বজ, মিঞা, ভাজা খোল, পাউরুটি, ঘি, মধু, মিষ্টির গাদ আরো কত কি! 

সেবার বর্ষা এল খুব দেরিতে। আষাঢ় মাসটা ছিঁটেফোঁটা বৃষ্টি দিয়ে পেরিয়ে গেল। শিবুর মাছ ধরার সরঞ্জাম তৈরি। কিন্তু তেমন বর্ষার দেখা নেই। শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহে একদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। বড় বড় ফোঁটায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। মাঝে মাঝে থামে আবার শুরু হয়। সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার পর খাল বিল সব ভরে গেছে জলে। জল বইতে শুরু করেছে। এই সময় মাছেরা আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে ডাঙায় ওঠে। এটাই মাছ ধরার আদর্শ সময়। শিবু তার বন্ধুদের জোগাড় করে রাত আটটা নাগাদ মাছ ধরতে গেল ফরেষ্টের পুকুরে। ও জানে ফরেষ্টে মাছ ধরা বারণ, তাই পুরোনো সব মাছ এই সময় ধারে ভিড়ে আসে। তাছাড়া এই দুর্যোগে দারোয়ানেরা কেউ বেরোবে না। 

শিবুরা পাঁচ বন্ধু মিলে মাছ ধরতে বের হল। তাদের সঙ্গে আছে দুটো বড় টর্চ, দুটো বাঁশের লাঠি, একটা ভোজালি, তিনটে থলি ও মাছ ধরার সরঞ্জাম। ঘাস ঝোঁপ ডিঙিয়ে তারা এগোতে লাগলো। রাস্তায় যেতে যেতে পুঁটি মৌরলা কৈ শিঙি মাছে দুটো থলে ভরে এল। রাত দশটা নাগাদ তারা ফরেষ্টের ঝিলের বড় টাওয়ারের দিকটায় পৌঁছল। চারিদিক জলে থৈ থৈ করছে। তাল গাছগুলোর গোড়া ডুবে গেছে। ঝিলে বারকয়েক জাল ফেলা হলো। সব ছোট ছোট মাছ। বড় মাছ উঠছে না একটাও। এদিকটায় লোকজন একেবারেই নেই। নাগাড়ে ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার জলের ধারে ধারে অনেক মাছ লাফাচ্ছে, কিন্তু জালে একটাও ঠেকছে না। বন্ধুরা বিরক্ত হয়ে গেলো। 

শিবু মাছ না ধরে যাবে না। এমন সময় হাওয়া নেই বাতাস নেই পাশের জাম গাছের একটা বড় ডাল ঝড়াস করে জলে পড়ল। সবাই চমকে উঠল। 

শিবুর মাসতুতো দাদা দুদিন হলো গ্রাম থেকে এসেছে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ভাই লক্ষণ ভালো নয়, বাড়ি চল।’

শিবু বিরক্ত হয়ে দুই বন্ধুর সঙ্গে দাদাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। শিবুর সঙ্গে রইল বুদ্ধ। বুদ্ধ শিবুর মতো সাহসী।  অনেক চেষ্টার পর তারা বড় বড় চারটে শোল মাছ পেয়ে জল থেকে উঠল। আর ঝোঁপে ঝাড়ে নয়, তারা রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে। গল্প করতে করতে চলেছে। তাদের গল্পের বিষয় ভূত। তারা শিবুর দাদার ভয় নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। তারপর শিবু বলল, সত্যিই যদি ভূত থেকে থাকে তাহলে এটাই তো ভূতেদের আদর্শ সময়। কই ভূত? কোথায়? দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে ছোট টাওয়ারের কাছে এসে গেছে। 

এমন সময় বুদ্ধ খেয়াল করল, তাদের ডান দিকে পাসে পাসে কি একটা হেঁটে চলেছে। বুদ্ধ ফিস্ ফিস্ করে বলল দারোয়ান। শিবু দারোয়ানকে ভয় পায় না, কারণ সে এ পি সি কমিটির সদস্য। ক্রমে প্রাণিটি সামনে এসে দাঁড়ালো। শিবু ভোজালিটা বাগিয়ে ধরলো। বুদ্ধ টর্চের আলো ফেলল। কিন্তু জিনিষটা কি তারা বুঝতে পারলো না। হরিণ তো নয়, কারণ টর্চের আলোয় তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতো। এ কোন প্রাণী নয়, তারা নিশ্চিত। কি একটা, গোল ঝোঁপের মত জিনিস রাস্তায় বসে পড়ল। সেও নড়ে না, এরাও এগোতে পারে না। শিবু বুদ্ধর হাত শক্ত করে ধরল। এসময় কেউ একজন ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে মুশকিল। দুজনে এক সঙ্গে এগোতে লাগল। জিনিষটাও ক্রমাগত পিছোতে লাগল। এই ভাবে বড় গেটের কাছ পর্যন্ত এসে আর দেখা গেল না। বুদ্ধ সেদিন শিবুর বাড়িতে থেকে গেল। সকালে উঠে দুই বন্ধু মিলে অনেক আলোচনা করল, জিনিষটা কি ছিল? কিন্তু আজও তারা কোন সদুত্তর পায়নি!


কবিতা

মজাহীন পুজো

প্রনীল কুমার মন্ডল

শিউলি আছে, আছে কাশ 

সাদা মেঘের ভেলা আছে

আছে নীল আকাশ। 

বন্ধুদের দেখা নেই, 

নেই স্কুলের খেলা। 

নেই নতুন জামা, 

নেই আনন্দ মেলা। 

জানি না করবো কবে

করোনাকে জয়! 

একসাথে খেলবো সবে

যাবে সব ভয়।

(প্রথম শ্রেণি, পাঠ ভবন, বিশ্বভারতী)

Post a Comment

0 Comments