ব্লগ : স্বগতোক্তি/১২ । কমিউনিফেকিং


কমিউনিফেকিং

তড়িৎ রায় চৌধুরী

ফেসবুক নিরপেক্ষ নয়। সে বিদ্বেষ বিষ ছড়ায়—আমেরিকান পত্রিকার এই রিপোর্ট লটঘট লাগিয়ে দিল ভারতীয় সংসদেও। তা লাগুক। তাদের অনেক প্যাঁচ পয়জার ঘেঁটে চলতে হয়। ভোটের অঙ্ক কষে ইস্যু সাজাতে হয়। কিন্তু আপনি, আমি? যারা দেয়ালে রীতিমত বিজ্ঞাপন দিয়ে বন্ধু-বিচ্ছেদ যজ্ঞ করি, আমার না-পসন্দ কে রাখতে চাই না আমার পৃথিবীতে, তারা কি ভুলেই থাকব যে আমরা নিজেরাই খোলা মাঠে আত্মবিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড টাঙানোর গল্পে আছি। ফাঁকা মাঠ ততক্ষণই খোলা থাকে যতক্ষণ মালিক তা চায়। যে ছেলেটি জয়সিংহের মতো আকস্মিক আবিষ্কার করেছে রঘুপতি নিরপেক্ষ নয় ততখানি,সে কি জানত না সব নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে থাকে জীবন জীবিকার কঠিন স্তর? কোন মিডিয়াই কোনদিন চূড়ান্ত নিরপেক্ষ হতে পারে না। পুঁজির প্রয়োগে তারা তো দানছত্র খুলে বসেনি। আর সে একা নয় একগুচ্ছ জীবনের প্রতিপালক। দক্ষিণ ভারতে একবার একটি সংবাদপত্র দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল যে আপনি নিজে যত বেশি বিনিয়োগ করবেন তত বেশি খাঁটি(নিরপেক্ষ) খবর পাবেন। কেননা যত বেশি স্পনসরার তত বেশি নিয়ন্ত্রণ। যে কোনও দেশে ব্যবসা বিশেষত মিডিয়া-ব্যবসা যা জনমত তৈরি করে তা চালাতে গেলে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা খুব জরুরী। আপনি আমার নামে গাল মন্দ করবেন আর আমি আপনার জন্য ফুল চকলেট নিয়ে অপেক্ষা করব এমন বালখিল্য ভাবনা কোন বাস্তবতা?

আসলে সব মানুষের ভিতরেই তো একটা ছেলেমানুষিপনা থাকে। মিডিয়া গবেষণার মাধ্যমে তাকে জাগিয়ে তোলার বিচিত্র সোনালী প্যাক(কাঠি)নিয়ে আসে। ছেলেধরার মতো আমাদের তরল লোভ কে ব্যবহার করে যতক্ষণ পারে আটকে রাখে পর্দায়। এই যে শ্যামলীমাসি,চিরকাল দেখেছি মাথা উঁচু করে। সেদিন দেখলাম ভিক্ষারির মতো;

—আমার রিচ কমে গেছে প্লীজ...।

—মাসি, যে দেখার সে তোমার পাতায় এসে পড়ে যাবে মাসি।

—না বাবা। বাড়ি বয়ে আজকাল আর কেউ দেখা করতে আসে না। সারাদিনটা এতো লম্বা লাগে। কিছু তো একটা...

হোক না ভার্চুয়াল তবু এটাই নিউ নর্মাল। ছেলেভুলানো ছড়া। এভাবেই আত্মপ্রতারণা হয়ে উঠেছে জরুরী, অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী। তঞ্চকতা যে কত মায়াময়। চন্দ্রিল ইচ্ছে করেই ‘কমিউনিফেকিং’ নিয়ে নিজের একটি লেখার শেষে জানান “সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি ধাপ্পা। প্রতিটি তত্ত্ব বানানো। এইসব বই কিচ্ছু নেই। উদ্ধৃতিগুলো সব মনগড়া। আগাপাশতলা ধড়িবাজি ও ভন্ডামির হাট বসানো হয়েছে। বখাটেপনার জন্যই। এটি একটি লিখিত সংযোগ-ভান।” এই সংযোগ-ভানের জালে জড়িয়ে যাচ্ছি রোজ। স্তাবক কে-ই ভাবছি সুহৃদ। বাচ্চাদের মতোই নজরটান প্রবণতা(attention seeking) জন্ম দিচ্ছে নিরাপত্তাহীনতার। অস্তিস্ত্ব কে অনুভব করতে হচ্ছে উচ্চকিত উচ্চারণে। আপনি যত অশালীন আগ্রাসী ভাষণ দিতে পারেন মিডিয়া আপনাকে তত বেশি ফুটেজ দেয়। কেননা আপনি পর্দায় ধরে রাখতে পারেন অন্য কে। TRP দাদা। ধরে রাখার এই খেলায় অশালীন ক্রোধের কদর খুব। কারণ আমাদের ষড়রিপু। কাম ক্রোধ লোভ...আসলে এটা মন-কেমেষ্ট্রির পিরিয়ডিক টেবিল। প্রবণতার তীব্রতার মাপকাঠি। কাম কে খুল্লামখুল্লা স্বীকৃতি দেয় না সামাজিক-মন। আমরা তো ঋষি-মুনির উত্তরসূরী। আমাদের জাতীয় পাখি অযৌন জননে জাত। কিন্তু ক্রোধ স্বাভাবিক। তাকে সংযত করা প্রয়োজনহীন। তাই অন্য দেশের প্রতি, ধর্মের প্রতি, লিঙ্গের প্রতি, এমন কি জাতের লড়াই কেও পৃষ্ঠপোষকতা যোগায় মিডিয়া।যেন তুমুল নিরপেক্ষ, এইভাবে রোজ রোজ যুদ্ধের আগুন জিইয়ে রাখে।অস্ত্র ব্যবসায়ী যেমন চায় বন্দুকের লাইসেন্স পাক সকলেই। সম্পাদক স্বহস্তে আপনার জন্য বেছে দেন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ্গুলি। যা নিয়ে আমরা ভাববো। এই নির্বাচন খুব দামি। টিভিতে যখন খেলার লাইভ টেলিকাস্ট শুরু হল আমি আর মাঠে যাই না। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, রিপ্লে, স্লো মোশেন,— সব মিলে টিভির মজাই আলাদা।


মাঠে কে যায়? ঘন্টাদা যায়। কেন যাও ঘন্টাদা? এ প্রান্তে যখন গোল হয় তখন ও প্রান্তের গোলকিপার কে দেখব বলে। ‘লাইভ শো’ কি সত্যি লাইফ কে দেখায়? খেলা তো শুধু জয়-পরাজয় নয়। নিজের সঙ্গে নিজেই কখন সংযোগহীন হয়ে গেছি। বিশ্বব্যাপী ছড়ানো জালে আটকা পড়েছি রক্তকরবীর রাজার মতো। তার মতোই বলতে হয় “কেবল আমিই জানতে পারিনি। আমাকে ঠকিয়েছে এরা। আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না।” 


Post a Comment

0 Comments