আনন্দপাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

লকডাউন শেষ হয়ে আনলকের বিভিন্ন পর্যায় চলছে এখন বন্ধুরা। আস্তে আস্তে সবই আগের ছন্দে ফিরবে জানি, কিন্তু কতদিন পর আবার নির্ভয়ে, আগের মতো আনন্দে তোমরা ইস্কুল যেতে পারবে তা জানার ও জানানোর সময় এখনও আসেনি। ইতিমধ্যে তোমাদের প্রিয় উৎসবের মরশুম চলে এসেছে। কিন্তু এলে কি হবে! আমরা তো কেউই এখনও আতঙ্কমুক্ত নই। দুর্গোৎসবে অনেক কাটছাঁট হয়েছে। মেলাও বসবে না প্যান্ডেল ঘিরে। তোমরা হয়তো মেপে মেপে পা ফেলে দুয়েকটা মন্ডপে ঠাকুর দেখে আসবে। তাকে কি আর সেই পুরোনো মজা ফিরে পাওয়া বলা যায়? কক্ষনও না। আমরা তাই অপেক্ষায় আছি সত্যিকারের সুদিন ফেরার। 

তবে সঙ্গে আছে আমাদের বই, আমাদের সাহিত্য। সেখানে কোনও বাধা নেই। বিপদ নেই। ঘরে বসে বসে দু'মলাটের মধ্যে চোখ রেখে হারিয়ে যেতেই পারো  তোমরা দেশ থেকে দেশান্তরে। 

আজ আমাদের ছোট্ট বন্ধু প্রোজ্জ্বল লিখেছে গতবছরের মহালয়ায় অনুষ্ঠিত সেই বৃষ্টিমুখর আনন্দবাজারের স্মৃতি।

আর এক প্রিয় লিখিয়ে দাদা প্রকাশ কর্মকার আজ থেকে তোমাদের শোনাতে আরম্ভ করছেন সুন্দরবনের নানান গল্প। পর্বে পর্বে তোমরা তাঁর কাছে পাবে চমকপ্রদ সব অভিযান ও ঘটনার আখ্যান। 

আজকের কবিতাটিতে আছে সেই 'ইস্কুল নেই' এর বেদনার সুর। লিখেছেন সৈকত মুখোপাধ্যায়। 

তোমরা পড়ার জন্য তৈরি তো? পড়ো, পড়ো বন্ধুরা। আমি আবার জোগাড় করতে বেরোই তোমাদের জন্য আরও লেখাপত্র। 

ভালো থেকো সবাই।

তোমাদের বন্ধুদাদা

অঙ্কন রায়


ধারাবাহিক 

জলে জঙ্গলে সুন্দরবন

পর্ব—১

প্রকাশ কর্মকার 

অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম সুন্দরবন নিয়ে কিছু লিখি কিন্তু নানা কারণে সেই কাজ হয়ে উঠছিল না। যাই হোক আমি আজ এই নিয়ে লেখার আগ্রহ পেলাম শান্তিনিকেতন থেকে তোমাদের বন্ধুদাদার আহ্বানে ও সম্পাদকমশাইয়ের আগ্রহে। ওখানে তো জলে জঙ্গলে বাঘ আর ভূত। লেখার অজস্র উপকরণ। আর ঘটনাচক্রে এই সময়ে আমি সুন্দরবনেরই বাসিন্দা কাজের সূত্রে। সুতরাং... আমি রাজি হয়ে গেলাম। আর তাই সুন্দরবনের নানান গল্প নিয়ে, ওখানকার ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিলাম নানান বইপত্রে। ভ্রমণের সঙ্গে রহস্য, গা ছমছম ভূতের গল্প ও বন জঙ্গলের নানান ঘটনার মিশ্রণে এই ধারাবাহিক লেখা। যাঁরা রহস্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান তাঁরা আমার এই যাত্রাপথের সঙ্গী হতে পারেন। 

প্রথমে একটু ভৌগলিক পরিচয় সেরে নিই জায়গাটা সম্পর্কে। 

সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক আশ্চর্যগুলির মধ্যে অন্যতম। দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে এই সবুজ বন। তার চার ভাগের তিন ভাগ রয়েছে বাংলাদেশে আর এক ভাগ রয়েছে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে। গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদী তিনটির অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতখিরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি হল সুন্দরবন যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি।

সুন্দরবন, সত্যিই সুন্দর অপূর্ব এক মায়াবী হাতছানি বনপ্রেমীদের কাছে। চারিদিকে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, হেতাল, গোলপাতার ঘন জঙ্গল, আর ঘন জঙ্গলের মধ্যে বয়ে চলা ছোট ছোট খাঁড়ি, নালা, যার মধ্যে দিয়ে জোয়ারের সময় সমুদ্রের নোনা জল জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করে। কত জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে এখানে। জোয়ার ভাটার খেলায় মেতে থাকে এখানকার বনাঞ্চল। কত রংয়ের পাখির দেখা মেলে, সঙ্গে চিত্রা হরিণের ঝাঁক, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, রিসাস বানর, সমুদ্রের লাল কাঁকড়া আর নোনা জলের হিংস্র কুমির। নদীর স্রোতে ভেসে চলে ছোট বড় নৌকা, সঙ্গে মাছ ধরার লঞ্চ আর সামুদ্রিক বাংলাদেশের জাহাজ। 

সুন্দরবন নামটি সত্যিই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। চারদিকে শুধু জল আর জল, আর পাশে দাঁড়িয়ে সারি সারি সবুজ বনভূমি। জঙ্গলের মধ্যে বয়ে চলা ছোট ছোট খাল, খাঁড়ি কোন অজানা পথে হারিয়ে যায়। নদীর মধ্যে ভাসতে ভাসতে আর নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে রোমাঞ্চ অনুভব করতে করতে ভাসমান পর্যটকের নদীর সঙ্গে নৌকার দুলুনিতেও ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। বর্ষার সময় এখানকার নদীগুলি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে তাই এই সময় পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয় না। বিশেষত শীতকালে নদীর জল শান্ত থাকে তখন পর্যটকেরা নদী ও সুন্দরবন ভ্রমণে আসে। সুন্দরবনে যেসব জায়গায় বিশেষত সেখানকার আয়োজক লঞ্চমালিকরা পর্যটকদের ভ্রমণ করায় সেই জায়গাগুলো হল  দো-বাঁকি, সজনেখালি, হ্যালিডে দ্বীপ, লোথিয়ান দ্বীপ, নেতি ধোপানি, কলস দ্বীপ, যম্মু দ্বীপ, মৌসুমী দ্বীপ প্রভৃতি। লঞ্চ মালিকেরা এক একটা টিপের জন্য থাকা খাওয়া দাওয়া মিলিয়ে একটা চুক্তি করে নেয়। তবে এখানকার লঞ্চের কর্মচারিরা খুব ভাল ব্যবহার করে পর্যটকদের সঙ্গে। পর্যটকদের কোনও রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। যেমন রান্নাবান্না তেমনি থাকার ব্যবস্থা। পর্যটকরা চাইলে বিলাসবহুল লঞ্চও বুক করতে পারে। সব মিলিয়ে ভ্রমণ খুবই আনন্দের হয়। 

বেশ খানিকটা আন্দাজ পেলে তো বন্ধুরা সুন্দরবনের? এরপর আমরা একে একে ওখানকার নানান গপ্পে প্রবেশ করবো যা হবে রোমাঞ্চকর আর রহস্যে ঘেরা। আগামী সপ্তাহে আসছি আবার। সেদিনই শুরু হবে আমার গল্প বলা...।

(ক্রমশ)


আলেখ্য

স্মৃতিই সম্বল

প্রোজ্জ্বল কুমার মন্ডল

সোনাঝুরি গাছগুলো সোনালী বর্ণের ফুলে নতুন করে সেজে উঠেছে। কাশফুল! নীলাকাশ! কোপাইয়ের ঢেউ! সব কিছু  মিলে প্রকৃতিতে শারদোৎসবের গন্ধ! এইসময় পাঠভবনে আমরা থাকি খুব ব্যস্ত!  একদিকে নাটকের রিহার্সাল, তার সঙ্গে আনন্দ বাজারের প্রস্তুতি। দোকানের জন্য গ্রুপ তৈরি, বিভিন্ন উপকরণের প্রস্তুতি, হাতের কাজের জিনিস তৈরি, বন্ধুদের  মধ্যে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া! আমাদের পরিকল্পনা আমাদের গ্রুপের দায়িত্বে বুলবুলদি থাকায় ওঁকে পুরো জানাতাম। এ যেন কর্মযজ্ঞ! সকাল ৬টায় শুরু আবার সন্ধ্যায় নাট্যোৎসবে বন্ধুদের সঙ্গে সামিল হওয়া। দোকানের নাম ঠিক করা, মেনু কার্ড তৈরি আর মাকেও ব্যস্ত করে তোলা আমাদের দোকানের জন্য খাবারের মেনু তৈরি করতে। 

মহালয়ার আগের দিনেই গৌরপ্রাঙ্গণে বাঁশ পড়লো। দাদা দিদিদের সন্ধ্যা থেকেই দোকানের  প্রস্তুতি চললো। আমার তো উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোর ৫ টায় পাঠভবন অফিসের সামনে গিয়ে দেখলাম বুলবুলদির সঙ্গে আদিত্যও এসেছে। তারপর ইনতাজ। মুনতাজকাকু আর বাবা ওই বৃষ্টিতে বাঁশ এনে আমাদের সাহায্য করলো। অবশেষে জায়গা দখল! ঢাকের আওয়াজে এক উন্মাদনা তৈরি হলো! কিন্তু গোল বাঁধালো বৃষ্টি! সকাল ১০টায় ঘোষণা হলো আনন্দ বাজার হবে নাট্য ঘরে! দৌড় শুরু! আবার টেবিল দখলের পালা কারণ প্রত্যেক দোকানের জন্য দুটো করে টেবিল ধার্য হয়েছে। ডালপালা দিয়ে সাজানো হলো দোকান। তারপর টেবিলের নজরদারি! 

আবার বৃষ্টি কমতেই দুটোর সময় ঘোষণা মেলা হবে গৌরপ্রাঙ্গণে। আবার দৌড় আগের জায়গা দখলের লক্ষ্যে। কারোর কাছ থেকে বাঁশ, কারোর কাছ থেকে তার দিয়ে তৈরি হল আমাদের দোকান ‘খাইয়ে মজা’। বিকাল ৩:৩০ থেকে ৫টা! আমাদের দোকানের স্থায়িত্ব! শুরু হল বৃষ্টি। আমাদের তৈরি করা সব কাগজের ফুল, মুখোশ হলো পন্ড। খাওয়া দাওয়া চলল। বৃষ্টির মধ্যেও ওই দিনের আনন্দ আজও স্বর্গীয় সুখ নিয়ে আসে! 

কিন্তু ২০২০ তে! আনন্দ বাজার, শারোদৎসব সব কিছু থেকেই আমরা বঞ্চিত। করোনা করেছে আমাদের গৃহবন্দি। গৌরপ্রাঙ্গণ, নাট্যঘর, শালবীথি, খেলার মাঠ আমায় হাতছানি দেয়। এই সব কিছু যত স্মৃতিতে আসে আরোও মন খারাপ হয়। অপেক্ষায় দিন গুনছি স্বাভাবিক ছন্দে পাঠভবনের দিনগুলো ফিরে পাওয়ার জন্য।

(পঞ্চম শ্রেণি, পাঠভবন, বিশ্বভারতী)


কবিতা

আমার স্কুলে আমি নেই

সৈকত মুখোপাধ্যায়

স্কুলের জন্য তাড়া নেই

ইউনিফর্মের বালাই নেই

বন্ধুর হাতে হাত, উপায় নেই

স্কুলের গেটে  ছোটাছুটি  নেই

আমার স্কুলে আমি নেই...


ক্লাসরুমের দরজা আর খোলা নেই

ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষা নেই

রং - তুলির ক্যানভাস নিয়ে ঘাটাঘাটি নেই

সবুজ খেলার ধুলো মাখামাখি নেই

আমার স্কুলে আমি নেই...


বাক্সবন্দি টিফিন নেই

লুচি পরোটার গন্ধ নেই

গেটের কাছে হজমি নেই

টিফিন বেলায় খেলা নেই

আমার স্কুলে আমি নেই...


ছুটির ঘণ্টার শব্দ নেই

বাড়ি ফেরার তাড়া নেই

ছোটবেলা ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই

নস্টালজিয়ায় প্রবেশের অধিকার নেই

আমার স্কুলে আমি নেই...।

Post a Comment

0 Comments