আনন্দপাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

গতকাল শিক্ষক দিবস গেল বন্ধুরা। না না। আমি শিক্ষক দিবসের ইতিহাস আজ বলতে বসছি না। আমি জানি সে তোমরা জানো। আমি শুধু এবছর নিজের মনখারাপের এই দিনটাকে তোমাদের মনখারাপের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেই প্রসঙ্গ তুলেছি। 

টিচার্স ডে বা শিক্ষক দিবস, আর স্কুলের দরজা বন্ধ, এ কি কখনও আমরা ভাবতে পেরেছিলাম বন্ধুরা? কোনওদিন না। কারণ এই দিনটা আমাদের স্কুলের সবচাইতে আনন্দের দিন।

যখন পাঠভবনে শিক্ষকতা করি, একটা নতুন জিনিস দেখলাম যা আগে পূর্ণিয়ায় থাকতে দেখিনি। দেখলাম উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা জুনিয়র ক্লাসে রীতিমতো মাস্টারমশাই হয়ে ক্লাস নিচ্ছে, পড়াচ্ছে। খুব ছোট ক্লাসের কচিকুচিদের কেউ বা দক্ষ হাতে, কেউ অপটু হাতে সামলাচ্ছে। সেই সব একদিনের শিক্ষকেরা কি সুন্দর পরিপাটি ধুতি পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে ক্লাসে আসছে। সারা বছরের মাস্টারমশাইদের সেদিন আরাম। তাঁরা ঘুরে ঘুরে বড় ছেলেমেয়েদের ক্লাস করানো দেখছেন বা কেউ কেউ এদিকে সেদিকে জটলা পাকিয়ে জোরতার আড্ডা জমিয়েছেন। একদিকে হাতে লেখা সুন্দর দেখতে দেয়ালপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে তো অন্যদিকে সন্ধের সময় যে নাটক মাস্টারমশাইরা মঞ্চস্থ করবেন তার স্টেজ তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে আনন্দের একটা জমজমাট হাট হত সেদিন, আর দিনটার জন্য সারা বছর উন্মুখ হয়ে বসে থাকতো ছেলেমেয়ে থেকে মাস্টারমশাইরা সবাই।

পরে অন্য স্কুলে গিয়েও এই আনন্দটা পেয়েছি। কোথাও কোথাও অনুষ্ঠানের নিয়মাবলী একটু আলাদা, কিন্তু আনন্দ আলাদা নয়। এক স্কুলে তো স্টুডেন্টরা এত পেন গিফ্ট করতো যে আমাদের সারা বছরের কলম বাড়িতে জমা হয়ে যেত।  

এ বছরটা অন্য রকম। এ বছর আমাদের ‘নেই’য়ের বছর। এ বছর স্কুল নেই। এ বছর পুজোর উৎসব নেই। এ বছর অনুষ্ঠান নেই পঁচিশে বৈশাখে বা শারদীয়ায়। এ বছর আছে শুধু আতঙ্কের ভাইরাস। আছে শুধু মনখারাপ স্কুলের জন্য, বন্ধুদের জন্য। কারণ ওই ভাইরাসের প্রসার ক্রমবর্ধমান। এর রাশ কবে টানা যাবে এখনই বলা যাচ্ছে না বন্ধুরা। তারই মধ্যে বড়দের কাজকম্মোও শুরু হয়ে গেছে নিরুপায় হয়ে। তোমাদের নেটে পড়াশোনা, পরীক্ষা..  তাও চলছে। 

আমাদের লেখাপত্রে এই সময়ের প্রতিফলনই তাই বেশি। আজও রইলো এমন কয়েকটি লেখা। তোমাদের ছোট এক বন্ধু প্রোজ্জ্বল লিখল পাঠভবনের পুরোনো ঘন্টাতলায় বটগাছ উপড়ে পড়ার কথা, মাস্টারমশাই সুরজিৎ সেনের কবিতায় বন্ধ ইস্কুল ঘিরে বিষন্নতার সুর আর কবি অপূর্বকুমার কুন্ডুর লেখায় শিক্ষক দিবসের কথা। 

এই দুঃসময়েও ভাল থাকার, ভাল রাখার কথাই বলি আমি। আমরা সবাই যেন একে অপরকে আঁকড়ে ভাল থাকি, তাই না?

তোমাদের বন্ধুদাদা

অঙ্কন রায়


ইস্কুল নেই/ ৮

হারিয়ে যাওয়া বন্ধু

প্রোজ্জ্বল কুমার মণ্ডল

পাঠভবনে আমি দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে। তাই তিন পাহাড়ের বটগাছের ঝুরি ধরে ঝোলার আনন্দঘন মূহুর্ত থেকে আমি বঞ্চিত। আমার যত সম্পর্ক ঘন্টাতলার বটগাছটার সঙ্গে। বৈতালিক শুরু হওয়ার আগে, টিফিনের সময় এবং ক্লাস শেষ হওয়ার পর অনেকটা সময় আমরা কাটাতাম  ঘন্টাতলায়। বটগাছটা ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। ওর শিকড় ধরে আমরা যেমন ঝুলতাম তেমনই আবার ওর কোটরে বা ওর ছায়ায় বসে টিফিন শেয়ার করে খেতাম বন্ধুদের সঙ্গে।

গত বছর তো আমাদের হাত থেকে, আমাদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে বাগানের লোকেরা বাঁশ দিয়ে শিকড়গুলো বেঁধে দিয়েছিল। আসতে আসতে একটি একটি করে বাঁশ নষ্ট হয়ে যায়! আমরা আবার ঝুলতে শুরু করি। মায়ের কাছে শুনলাম আমাদের বন্ধু ওই বৃদ্ধ বটগাছটা নাকি ঘন্টার থামগুলো সহ ভেঙে পড়েছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না। তারপর সব পেপারে একই খবর আর ছবি দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।

একে করোনা! লকডাউন! বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না! পাঠভবনের জন্য মন খারাপ! মন খারাপ দাদা দিদিদের জন্য! শালবীথির ওই রাস্তা, প্রত্যেকটা গাছ, খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, আউটিং, সব অনুষ্ঠান হারিয়ে আমরা ঘর বন্দি! এই সব কিছুর সঙ্গে যোগ হল বন্ধুকে হারানোর কষ্ট। আমাদের নিত্যসঙ্গী বটগাছকে আর দেখতে পাবো না ভাবতেই পারছি না! কেবলই মনে হচ্ছে আমরা যদি গাছের ঝুলন্ত শিকড়ের সঙ্গে বাঁধা বাঁশগুলোর যত্ন নিতাম!

(পঞ্চম শ্রেণি, পাঠভবন, বিশ্বভারতী)


কবিতা

তাঁর কাছে তাই ঋণী 

অপূর্বকুমার কুণ্ডু

দুচোখ জুড়ে জ্বেলে দিলেন চলার পথে আলো, 

চলার পথটা যত্ন করে চিনিয়ে দিলেন তিনি।

এগিয়ে চলার স্বপ্ন দিলেন হাতের মুঠোয় তুলে, 

প্রতি পদক্ষেপে এখন তাঁর কাছে তাই ঋণী।


ভুল করেছি অজস্র তার হিসেব করিনি যে, 

শাসন-স্নেহে শুধরে দিতেন দুচোখ যেত বুজে।

শ্রদ্ধাতে তাঁর সম্মুখে ঠিক পড়ত মাথা নুয়ে,

বলেছিলেন ভুলের পাশেই শুদ্ধ পাবি খুঁজে।


যখন দেখি, পথ দিয়ে তাঁর নিত্য যাওয়া আসা, 

যা কিছু ভুল আজও তিনি শুধরে দিয়ে যান।

আমার চোখে আদর্শ এক শিক্ষাগুরু তিনি, 

তাঁরই আশীর্বাদের ধারায় নিত্য আমার স্নান।


প্রতি বছর ইশকুলে যাই দেখি দেয়াল জুড়ে, 

স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে আছেন, বলেন আড়াল থেকে—

আজও বুঝি ভুল করেছিস! ভয়টা কী তোর ওরে, 

এই তো আমি, ভুলটা দে না শুদ্ধ দিয়ে ঢেকে।


গাছেদের মন খারাপ

সুরজিৎ সেন

গাছেরা ভীষণ একা,

ছেলেরা আসে না স্কুলে,

বহুদিন নেই দেখা,

গেছে কি তাদের ভুলে?


গাছেদের মনে ব্যথা,

চুপ করে থাকে বসে,

পাতারা বলে না কথা,

টুপ করে পড়ে খসে।


গাছগুলি মনমরা,

চেয়ে থাকে আশা করে,

কবে যে আসবে তারা,

দোল খাবে ডাল ধরে।


উতরোল কচি স্বরে

ভরে যাবে প্রাঙ্গণ,

দু'হাতে জড়িয়ে ধরে

ভালো করে দেবে মন।


Post a Comment

0 Comments