আনন্দ পাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

প্রিয় বন্ধুরা,

আমাদের জাতির শিক্ষক, বাঙালির মেরুদণ্ড পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দু'শো বছর পূর্ণ হল। সেই মহান মনীষীকে প্রণাম জানাতে আজ আমরা সাপ্তাহিক আনন্দ পাঠশালার পাতায় রাখলাম দুটি রচনা আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে। তাঁকে নিয়ে একটি কবিতা থাকল বিশিষ্ট কবি শ্রী বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায়ের, আর তোমাদের অভিনয়ের জন্য ছোট্ট একটি নাটিকা লিখলেন প্রিয় বন্ধুদিদি মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস। আর রইল সুন্দরবনের ধারাবাহিক গপ্পো তোমাদের জন্য, যার পরতে পরতে আছে কৌতুহল, আছে রহস্য— রোমাঞ্চ। প্রকাশ কর্মকারের লেখা আকর্ষণীয় এই ধারাবাহিকটি তোমাদের কেমন লাগছে জানিয়ো কিন্তু। গত রবিবার বিশেষ কারণে তোমাদের এই বিভাগ প্রকাশিত হয়নি। এ বারে তাই বেশি বেশি লেখা। রইল চমৎকার দুটি ছড়াও। তোমরা সব লেখা সম্পর্কে মতামত দিয়ো। লেখা পাঠাবে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে। তোমাদের লেখার অপেক্ষায় আমরা বসে থাকি।

সবাই ভাল থেকো। সাবধানে থেকো।

তোমাদের বন্ধুদাদা

অঙ্কন রায়


দু’শো বছরের শ্রদ্ধাঞ্জলি/ ১

বিদ্যাসাগর

বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায়


সাগর জেনেছি জলোচ্ছ্বাসের

ঢেউ ভাঙাগড়া খেলাতে

যখন শুনেছি ‘বিদ্যাসাগর’

হিসেব পারিনি মেলাতে!


তখন নেহাতই শৈশব পার

সাগর তখনও দেখিনি

মনের মধ্যে সাগরের ছবি

আঁকাটি তখনও শিখিনি!


সেদিন শুনেছি জলহীন এক

অন্য সাগর-কাহিনী

সে সাগর নাকি বিদ্যায় ভরা

দয়ার সাগরও তো ইনি!


যখন দাপট সমাজপতির

ব্রাহ্মণ-বাদ উচ্চে

বিধবা বিবাহে সম্মতি তাঁর, 

সম্মান দেন তুচ্ছে!


বুঝিয়ে দিলেন শিক্ষা-প্রসারে

উন্নত হবে জাতি, দেশ

নারীশিক্ষার প্রসারে ঘটবে

সু-সভ্যতার উন্মেষ!


পুরুষোত্তম বিদ্যাসাগর !

পুণ্য জন্মতিথিতে

সহস্রবার প্রণতি জানাই

তোমার প্রতিকৃতিতে!


নাটিকা

দু’শো বছরের শ্রদ্ধাঞ্জলি/ ২

বেঁচে থাকুন বিদ্যাসাগর

মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

রুমু  :  ঠাকুমা, ঠাকুমা...

ঠাকুমা: ওফ, যেই না বেলা করে খেয়ে  একটু শুয়েছি.... কেন রে? স্কুল থেকে এসেছিস, হাত মুখ ধুয়ে একটু কিছু খেয়ে নে৷ আমায় দরকার কেন?

রুমু : দরকার আছে৷ আমি আসতে আসতে দেখছি ভুতুদের বাগানে সব জড়ো হয়েছে আশে পাশের বাড়ির দিদি দাদারা৷ আমি যেতেই খুকিদি বলল, তুই খুব ছোট, তুই যা৷ 

আরে, কেন জমায়েত সেটা তো বলবে? দিদিভাইকেও দেখলাম ওখানে আছে৷ ওও কিছু বলল না৷ তুমি চলতো, ওদের বকবে৷

ঠাকুমা : তাই তো, আমার এত্তবড় ক্লাস টুতে পড়া দিদিকে অপমান? দাঁড়া, বড়দিদিকে ফোন করি৷ হ্যালো, আমি ঠাকুমা বলছি৷ তোরা কি করছিস রে সবাই?

বড়দিদি ঝুমু : ও ঠাকুমা, তুমি সব ভুলে যাও৷ কালই যে ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর৷ সেই তোড়জোড় চলছে৷ প্রভাত ফেরি, বিকেলের অনুষ্ঠান৷ বাড়ি গিয়ে সব বলছি৷ 

ঠাকুমা : ও... দেখ কান্ড... ভুলে মেরে দিয়েছি৷ ঠিক আছে৷ ঠিক আছে৷ রাখছি৷

রুমু : তুমি বকলে কোথায়? 

ঠাকুমা : বকা গেল না যে৷ ওরা যে খুব ভাল কাজের আয়োজন করছে রে৷ আচ্ছা, বলতো  তুই যখন হাতেখড়ির পর পড়া শুরু করলি তখন দাদু কোন্ বই কিনে দিয়েছিল?

রুমু : সে তো বর্ণপরিচয়৷ 

ঠাকুমা : বইটা কার জানিস?

রুমু: আমার৷

ঠাকুমা : (শব্দ করে হাসি) কার লেখা জানতে চাইছি৷

রুমু : আমায় অত বোকা ভেব না৷ ওটা বিদ্যাসাগরের লেখা৷

ঠাকুমা : বা দিদিভাই! আসলে কালকে ওনার জন্মদিন তো৷ তাই দাদা দিদিরা অনুষ্ঠান করবে৷ 

রুমু : কি মজা৷ কেক কাটা হবে৷

ঠাকুমা : তোরা ইংরেজি স্কুলে পড়ে পাগল তৈরি হচ্ছিস৷ কেক কাটা কোনও বাঙালি প্রথা হল? তাছাড়া সেই কেক কি উনি খাবেন? ওনার জন্মের তো দু’শ বছর হল এবার৷ তাই একটু ধুমধাম, মানে প্রভাত ফেরি, নানান প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসব হবে সারাদিন৷ পাড়ার বড় দাদা দিদিরা অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করছে৷

রুমু: উনি এত শক্ত শক্ত বানান লিখেছেন৷ ওনার জন্যে সে সব করার দরকার কি!

ঠাকুমা  : (খুব হাসেন ) প্রতিটা ভাষাই খুব দরকারি জানবে৷ আমাদের মায়ের মুখের ভাষাটার, মানে বাংলা ভাষাটার উনি নতুন জীবন দান করে ছিলেন৷ তুমি আরও একটু বড় হলে তা বুঝতে পারবে৷ তাছাড়া এই যে তুমি  পড়াশোনা করছ, খেলছ, বাড়ির সবার আদরে আদরে দুষ্টুমি করছ, তাও কিন্তু এই বিদ্যাসাগরের মতো কিছু মানুষের জন্য৷ না হলে তোমার মতো বয়সে তো মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত, এক গলা ঘোমটা টেনে ঘরের কাজ করতে হত, বুড়ো বরের পা টিপতে হত৷ আর কপাল আরও খারাপ হলে বর মরে গেলে কি দুঃখ যে থাকত জীবনে তা অনুমানও করতে পারবে না৷ 

রুমু: বিয়ে হয়ে যেত? বল কি? তা হলে তো তোমার মত আর মায়ের মত সারাদিন কাজ!

ঠাকুমা : আরও যে কত কষ্ট দিদিভাই কি বলব! কিন্তু বিদ্যাসাগর বললেন, না! মেয়েরাও পড়বে৷ মেয়েরাও বিধবা হলে আবার সংসার করবে ছেলেদের মতো৷ তার জন্য ওনাকে কত লড়াই করতে হয়েছে সেই সময়ের সমাজের মাথাদের সঙ্গে৷ ওনার সম্বন্ধে যত জানবে, তত অবাক হবে৷ যেমন একগুঁয়ে, তেমন দয়ালু৷

এখন চলো তো কিছু খেয়ে নেবে৷ তোমাকে ওনার কথা আরও বলবো রাতে শুয়ে শুয়ে৷ আর সন্ধ্যেবেলা মধু কবির লেখা একটা কবিতা শিখিয়ে দেব৷ কাল বলবে অনুষ্ঠানে৷ 

ঠিক আছে?

রুমু : তা হলে তো ভালই হবে৷ তোমার গল্পগুলো আমি স্কুলের বন্ধুদেরও বলবো৷ 

ঠাকুমা : আচ্ছা আচ্ছা৷ তুই এখন মায়ের কাছে যা৷ আমি দেখে আসি ওদের কাজ কত দূর এগিয়েছে৷

দীনবন্ধু করুণাসিন্ধু যদি কেউ থাকেন অভাগা মেয়েদের তা শুধু বিদ্যাসাগর৷ আমিও তাই কাল সারাদিন ওনার জন্য পালিত হওয়া সমস্ত অনুষ্ঠানে হাতে হাত লাগাবো ছেলে মেয়েদের সঙ্গে৷ 

(গুনগুন করে গান ধরেন বাইরে যেতে যেতে)

‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবি হয়ে’


ধারাবাহিক পর্ব-২

জলে জঙ্গলে সুন্দরবন

প্রকাশ কর্মকার 

সালটা দু’হাজার পনেরো। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমরা ঠিক করলাম সুন্দরবন ভ্রমণে যাব, তবে এই ভ্রমণ আর পাঁচটা সুন্দরবন ভ্রমণের থেকে একটু আলাদা হবে। আমাদের দলের সব থেকে সাহসী সদস্যদের মধ্যে হামিদ ঠিক করলো সুন্দরবনের নানা ঘটনা নিজে চাক্ষুষ করবে। সেই জন্য সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তরে তারা বেশ কয়েকদিন থাকবে। তার জন্য নির্দিষ্ট কটা দিন লাগবে তা আগে থেকে ঠিক করা গেলো না। বিভিন্ন লঞ্চ মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিফল হতে হল। কেউ রাজি হল না। তাছাড়া যদিও বা কেউ কেউ রাজি হল কিন্তু তারা যা টাকা দাবি করল সেটা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার কাছে বাসন্তীর একজন বন্ধুর মোবাইল নম্বর ছিল। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা লঞ্চ ঠিক হল। তবে ওই লঞ্চ মালিক রাজি হবার পেছনে কারণ ছিল। কিছু দিন যাবৎ ওই লঞ্চ মালিকের ব্যবসা ভাল যাচ্ছিল না। তাছাড়া আরও একটা কারণ ছিল। লঞ্চ মালিকের একমাত্র ছেলে তিতাসের মৃত্যু এক অজানা কারণে এই সুন্দরবনের নদীপথে হয়েছে, যার রহস্য এখনও কেউ উদ্ধার করতে পারে নি। সেই অজানা কারণ উদ্ধার করার জন্য লঞ্চ মালিক সুন্দরলাল আমাদের মত সাহসী একটি দলের সন্ধানে ছিল অনেকদিন ধরে। আজ সুন্দরলালের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে।  ছেলের মৃত্যুর কারণ জানার আগ্রহ আজও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। ছেলের মৃত্যু সে আজও মেনে নিতে পারে নি। সেই দিনের ঘটনা আজও সুন্দরলালের চোখে ভাসে। 

সব ঠিকঠাক করে ভ্রমণের দিন ঠিক হল পঁচিশ-এ ডিসেম্বর। সুন্দরলালের লঞ্চে যাত্রা শুরু করলাম দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গদখালি থেকে। লঞ্চের ডেকে বসে সুন্দরলালের কাছে সেই দিনের ঘটনা জানতে চাইলে উনি যা বললেন তার সারাংশ এইরকম—

ডিসেম্বর মাসের শীতের রাত্রি। খোলা নদীর উপর হিমেল হাওয়া হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। দুপাশে ঘন সুন্দরীর মায়াবী জঙ্গল অন্ধকারে মিশে গিয়ে যেন এক অজানা ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে। অন্ধকার কালো নদীর উপর আমার মাছ ধরার লঞ্চ ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে সঙ্গে আরও দুটো অন্য দলের মাছ ধরার লঞ্চ ‘মা আনন্দময়ী’ ও ‘মা মনসা’ পাশ দিয়ে আমাদের সঙ্গে সমান্তরালে এগিয়ে চলেছে।  অন্ধকারে আমাদের চোখ সজাগ। আমার ছেলে তিতাস লঞ্চের উপর ডেকের মধ্যে বসে মোবাইল চালিয়ে গান শুনছিল। হঠাৎ পাশের জঙ্গলের ঝোপটা নড়ে উঠলো। অন্ধকারে আলো ফেলে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। আমাদের সঙ্গে থাকা আরও দুটো লঞ্চের মধ্যে মা আনন্দময়ী লঞ্চ থেকে কুবের পানিগ্রাহি চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাবধান, মনে হচ্ছে দক্ষিণরায় কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করছে।’ দক্ষিণরায় অর্থাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ঘটনাস্থলটি হল রায়মঙ্গল নদী আর ইচ্ছামতী নদীর কেন্দ্রস্থল। এই ইচ্ছামতী নদীর এপারে ভারত আর ওপরে বাংলাদেশ। আর এই দুটি নদী বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিভাজন রেখা সৃষ্টি করেছে। আর এই বিভাজন রেখায় না আছে কাঁটা তার, না  প্রাচীর। শুধু রয়েছে বিএসএফ— এর সজাগ দৃষ্টির অনন্ত পাহারা। অন্ধকারে চোখ ছাড়াও অন্যান্য ইন্দ্রীয়গুলোকেও সজাগ রেখে চলেছে দলের সকলেই। পাশের গভীর জঙ্গল থেকে গাছ ভাঙার শব্দ হচ্ছে প্রতি মূহুর্তে। মনে হয় গাছচোররা ঘাপটি মেরে আছে গাছ চুরি করার জন্যে। ফরেস্ট গার্ডরা পাহারা দিচ্ছে, তাদের লঞ্চের আলো অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলের গাছ যাতে চোররা চুরি করতে না পারে তাই এই বাড়তি সতর্কতা। 

সময় কাটে, রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। লঞ্চ নদীর বুক চিরে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ একটা চিৎকার। চিৎকারটা প্রথম শুনতে পায় দীনেশ হালদার। প্রথমটাই বেশ জোরে। তারপর তা যেন চাপা গোঙানিতে পরিণত হল। পশ্চিমের জঙ্গলটার দিক থেকে আরও একবার... আর শেষবার... তারপর সব নিশ্চুপ। আমাদের লঞ্চ তিনটি খুব কাছাকাছি করে এগিয়ে চলেছে। আমি তিতাসকে ডাকলাম কিন্তু সারা পেলাম না। আরও একবার, কিন্তু কোনও উত্তর নেই। আমি উদগ্রীব হয়ে লঞ্চের ডেকের উপর ছুটে গেলাম। কিন্তু তিতাস কই, মোবাইলটা ডেকের মাটিতে প'ড়ে আছে। আমি চিন্তিত হয়ে উপর থেকেই চিৎকার করলাম। আমার চিৎকার শুনে সবাই উপরে উঠে এলো। 

তিনটি লঞ্চ গায়ে গা লাগিয়ে ধীর গতিতে চলছিল তাই  তিনটি লঞ্চের সকলে প্রায় জনা দশ-এগারো ডেকের উপরে উঠে এলো। আমাদের চিৎকার শুনে টহলরত বিএসএফ— এর একটি বোর্ট আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হলে একজন জওয়ান জানতে চায় কি কারণে আমরা চিৎকার করছি। আমি সমস্ত ঘটনা খুলে বলি তাদের। শুনে এক বি. এস. এফ. জওয়ান বলে ‘মনে হচ্ছে এটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কাজ হবে!’ একজন বাঙালি জওয়ান বলল, ‘আমাদের ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় থাকতে হবে, রাতের অন্ধকারে ঘন জঙ্গলে কিছুই ঠাহর করা সম্ভব নয়।’ আমি আমার ছেলে তিতাসের চিন্তায় উদগ্রীব হয়ে পড়লাম। আমি একাই জঙ্গলে প্রবেশ করার মনস্থির করলে বি. এস. এফ. এর জওয়ানরা বাধা দিল। কিছুতেই মন মানতে চাইছে না। আলো ফেলে জঙ্গলের দিকে শুধুই ডাকতে লাগলাম... তিতাস... তিতাস.... তিতাস... কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না।  

ভোরের আলো ফুটতেই বি. এস. এফ. কমান্ডার দুটো ফ্লোটিং বোর্ট পাঠিয়ে দিলেন জঙ্গলের দিকে তল্লাশির জন্য। ভাটার কারণে নদীর জল কমে যাওয়ায় কাদা পাড় পেরিয়ে ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল শিকড়-বাকড় টপকে পাঁচ-জনের একটা দল বনের গভীরে ঢুকে পড়ল। তারপর মিনিট কুড়ি চুপচাপ। কোনও শব্দ নেই। এক নাম না জানা লাল রঙের পাখি বিকট শব্দ করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। ঠিক তারপরই জঙ্গলের মধ্যে যারা প্রবেশ করেছিল তারা একটা বডি ধরাধরি করে তুলে আনল বোটে। মৃতদেহটি কাদায় লেপটে ছিল তাই চেনা যাচ্ছিল না। এক আঁজলা জল মৃতদেহটির মুখে মারতেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। একি! এ তো আমার ছেলে তিতাস! হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম। একজন বি.এস.এফ  জওয়ান চেঁচিয়ে বললেন – ‘এ কাম রয়েল বেঙ্গল কা নেহি, ইসকো শের নে নেহি মারা, ডেডবডি দেখকে পাতা নেহি চল রাহা মৌত ক্যায়সে হুয়া।'

বি. এস. এফ  কমান্ডার অনন্তবাবু তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে ডেডবডিটা পরীক্ষা করতে লাগলেন। ডেডবডিটা সাদা ফ্যাকাশে চেহারা ধারণ করেছে বহুক্ষণ কাদায় পড়ে থাকার কারণে, সারা শরীর কাদায় মাখামাখি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য যেটা, ডেডবডিটার গায়ে বা শরীরের কোনও জায়গায় একটু জখমের চিহ্ন নেই। বাঘের নখের আঁচরের চিহ্ন শরীরের কোথাও পাওয়া গেল না। তাহলে মৃত্যু হল কি করে? বডি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হল ময়না তদন্তের জন্য। কিন্তু ময়না তদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হার্ট ফেল বলা হল। কিছু একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখার কারণে হার্ট ফেল হয়েছে বলে ডাক্তারদের অনুমান। কিন্তু তিতাস সেদিন কি দেখেছিল তা আজও অজানা। 

গল্পটা শুনে আমরা সবাই থ হয়ে গেলাম। লক্ষ করলাম সুন্দরলালের দু'চোখ বেয়ে অশ্রুধারা।

‘খাবার রেডি বাবুরা। খেতে আসুন’— লঞ্চের কেবিন থেকে কুক ব্রজেশ দাস ডাক দিল। আমরা সকলে খাবার খেতে নিচে নেমে এলাম। 

(ক্রমশ)


মল্লার

সুমন ঘোষ

খুচরো কোনও পাখির দরে

সে ছিল এক অশান্ত

জ্যান্ত হাসির কুলুঙ্গিতে

নানান দশা, দশান্তর!


সে ছিল এক কবরখানায়

বাদশা-বেগম আন্দাজে

বিক্রি হবে খুচরো দরে

নয় সে এমন বান্দা যে!


সে নয় এমন সালাম হুজুর

গোলামদারির ঘনিষ্ঠ

সে ছিল এক পাখির শিসে

সকল সুরের কনিষ্ঠ


উড়তে উড়তে চোখের আলাপ

ঘুড়ির সঙ্গে ঘুরন্ত

খুচরো কোনও পাখির দরে

সে ছিল খুব দুরন্ত


সেই সুবাদে বন্দি হল

মাটির নীচে মৃত্তিকায়

সেখান থেকে গান গেয়েছে

আকাশকুসুম কীর্তি চায়!


কীর্তি ঝরে ফিরতি পথে

কবরখানায় কঙ্কালে

ঝুমুরঝামুর ঝামুরঝুমুর

বৃষ্টি এসে টংকালে


কবর থেকে উঠে দাঁড়ায়

দু'হাত বাড়ায় মল্লারে

নিজেই শুধোয় নিজের কাছে

কে ছিল সে বল্ না রে!


বৃষ্টি নামার আগে

অনুভব পাল


অনেক দূরের ঝাউগাছেদের বন

আকাশফুলের গন্ধে সে মাতোয়ারা

গগনপারের কুটুমবাড়ির কোণ

স্বজন আসায়, ওদের ভীষণ তাড়া।


ডালে ব’সে কার বউ-কথা-কও ডাক

চাতকেরও দেখি, আনন্দ আজ ভারি

তাই দেখে-শুনে ফিচেল হেসেছে কাক

আকাশ পরেছে, ময়ূরকন্ঠী শাড়ি।


কালো মেঘে শ্বেত বলাকারা উড়ে যায়

টুকরো হাসিটি লাগে বর্ষার ঠোঁটে

প্রস্তুতি শেষ, যেই বাজ চমকায়

তাল কুড়োবার জন্য ছেলেরা ছোটে।

Post a Comment

0 Comments