বল্গ : স্বগতোক্তি/ ১৩ । পুজো বিক্রি অনলাইনে


পুজো বিক্রি অনলাইনে

তড়িৎ রায় চৌধুরী 

শান্তিনিকেতনে মহালয়ার দিন বিকালে কয়েকঘণ্টার একটা মেলা হয়। আনন্দ বাজার। শুরুর দিকে এর অন্য আরেকটা নাম পাওয়া যায় ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’। আশ্রমের মহিলারা করেছিলেন বলেই হয়তো এই নাম। ঠিক জানি না। তবে এটা জানি হাট-বাজার এসব শব্দ সুশীল বাঙালি সমাজ তেমন ভালোবাসে না। কেমন ব্যবসা ব্যবসা গন্ধ, বেচাকেনার ভাব। অনেকে তাই মুখ চলতি বলেন আনন্দমেলা। মেলা মানে মিলন— আহা কি ভাল! কি ভাল! আচ্ছা ব্যবসায় দোষ কি? ‘‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী”। তো লক্ষ্মী তো বাঙালির ঘরে ঘরে পূজিতা।

ঠাকুর পরিবারের সকল পুষ্টির মূলেই ছিল ব্যবসা। তাই তাদের উত্তরাধিকারে হয়তো বাজার শব্দটা অত শ্রুতিকটু লাগেনি। কিন্তু তারপর দীর্ঘ দিন নিশ্চিত নিরাপত্তায় চাকরি করতে করতে বাঙালির কানে বাজার শব্দটা আর ঠিক মধুর লাগে না। বাজার সে যায় মূলত ক্রেতা রূপে বিক্রেতা হিসাবে না। কেন না ব্যবসা মানে লোক ঠকানো, মনুষ্যত্ব নষ্ট। থ্যাংক্স গড (কোন ভগবানকে জানি না) এখন সে মনোভাব অনেকটাই দূরীভূত।

অথচ ইতিহাস বলে বাঙালি ব্যবসাতে যথেষ্ট প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল খ্রীষ্টের জন্মের আগে থেকেই। নীহাররঞ্জন রায় বলেন ‘‘খ্রীষ্টীয় প্রথম দ্বিতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ সপ্তম শতক পর্যন্ত কিছুটা উন্নত চাষবাস এবং গৃহশিল্প ধন উৎপাদনের বড়ো উপায় হলেও প্রধানতম উপায় ছিল ব্যবসা বাণিজ্য”— আমরা যে মসলিন ও মসলা ব্যবসার এত সুখ্যাতি শুনেছি তা কি সম্ভব হতো বাঙালি ব্যবসাবিমুখ হলে? সমাজে বণিকদের সম্পর্কে পরম শ্রদ্ধা না থাকলে কি তৈরি হতো চন্ডীমঙ্গল কাব্য? সম্ভবত গুপ্ত যুগের পর থেকে বাঙালির ব্যবসায় ভাঁটা পড়তে শুরু করে পাল যুগে যা ছিল তাও বন্ধ হয়ে যায় সেন যুগের রক্ষনশীলতার দাপটে। পরবর্তী সময়ে মোগলরা দখল করে নেয় হুগলি বন্দর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বিদেশি নাবিকদের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে, পিছু হটতে থাকে বাঙালি বণিক। ইংরেজ আমলে পুরাতন সংকট কাটিয়ে বাঙালি পুনরায় জেগে উঠতে শুরু করে। দ্বারকানাথ এবং প্রফুল্ল চন্দ্রকে প্রতিনিধি স্থানীয় দুই প্রকার ব্যবসায়ী বলা যায়। একটা নির্দিষ্ট সেক্টরে আটকে না থেকে ব্যবসাকে দ্বারকানাথ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন স্তরে। কয়লা খনি থেকে চা বাগান; জমিদারি থেকে পার্টনারশিপ সবেতেই ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য পদ্ধতিটি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি শিল্পপতি হয়ে উঠেছিলেন। পাশাপাশি উচ্চস্তরের বিজ্ঞানী হয়েও প্রফুল্ল চন্দ্র বেঙ্গল কেমিক্যালস তৈরি করতে দ্বিধা করেননি। সৃজনশীল মেধার ব্যবসা করার পথ প্রদর্শক তিনি।

আসলে আমাদের ব্যবসায়ী মন ভারি জটিল। পুজোর রাস্তায় নাস্তিকরাও বই বিক্রি করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের কৃতিত্ব ঘোষণা করেন। তারই পাশে ভক্তিমানও ভয়ংকর ব্যথিত হয়ে পড়েন পুজো বিক্রির প্রস্তাবে। বাজারে এখনও আমরা মূলত রিসিভার পয়েন্টে। পুজোর বাজারে আমরা ইটি উটি সেটি এমনকি ঠাকুরের মূর্তি আর পুরোহিত পর্যন্ত কিনে আনি। কিন্তু কিছুই বিক্রি করতে রাজি না। আর এর প্রধান বাধা অবশ্যই আমরা। মানে বড়রা। চাকরির দাসত্ব করে করে আমাদের মানিয়ে নেবার মন তৈরি হয়েছে কিন্তু উদ্যোগ নেবার উন্মুখতা হয়নি। তাই যে কোনও নতুন প্রস্তাবেই প্রথমে ক্ষতির খতিয়ান করতে বসি। আর তার বেশিরভাগই অতীন্দ্রিয়। ভক্তি, আদর্শ, আন্তরিকতা, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য (যাদের স্বরূপ নিজেরাও বুঝি না তেমন) এইসবের ইনজেকশন দিয়ে পঙ্গু করতে চাই নবীন যৌবনের উদ্যমকে। এত কথা মনে এলো কেতকীর ফোনটা পেয়ে।

— দাদা এবার আমরা অনলাইনে পুজো বিক্রি করছি।

— পুজো বিক্রি! 

— হ্যাঁ দাদা। এতদিন অনলাইন ক্লাস করে এখন তো আমরা অনলাইনে স্পেশালিস্ট। বৃষ্টির কাকু থাকেন বিদেশে। তিনিই দিলেন প্রস্তাবটা। বীরভূমের অখ্যাত গ্রামের ভগ্ন জমিদার বাড়ির পুজো দেখুন, টিকিট কেটে।

— বিক্রি হচ্ছে?

— হয়ে যাবে দাদা। সঙ্গে শহুরে মানুষদের জন্য গ্রাম ভ্রমণ জুড়ে দেবো। ফেলুদা টাইপ আর কি।

— ফেলুদা?

— সেই যে আপনি বলেছিলেন। রহস্যের সঙ্গে ভ্রমণ মিশে থাকা ফেলুদার জনপ্রিয়তার একটা কারণ।

হুম। কে যে কখন কি শিখে নেয়। এখন তো অর্থই সর্ব শক্তি। শিল্পপতি আর অর্থনীতিবিদ-রাই সবজান্তা। আজকের ভারতের অর্থনীতির ভিত্তি তো মিডিয়াম এন্ড মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ গুলোই। অসংগঠিত ক্ষেত্রই এখন নতুন আবাদ ভূমি। সফট স্কিলের রমরমা তো সুযোগ দিচ্ছে মস্তিষ্ক প্রয়োগের। এইতো সময়। মনটা ভারি ভাল হয়ে গেল। দেবীরা জেগে উঠছেন। দেবীপক্ষে এর চেয়ে ভাল খবর আর কি-ই বা হতে পারত?

Post a Comment

0 Comments