আনন্দপাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

প্রিয় বন্ধুরা, 

দেখতে দেখতে আমরা বিপুল আনন্দে পৌঁছে গেলাম দুর্গোৎসবের দোরগোড়ায়। কিন্তু তোমরা একটু ভেবে বলো তো, সত্যিই কি এখন আমাদের সমস্ত কষ্ট, আতঙ্ক, সংকটের কথা ভুলে আনন্দে মেতে ওঠার সময়? একেবারেই নয় বন্ধুরা। এই যে মাসের পর মাস সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সারা দেশে, রেল বন্ধ, লক্ষ লক্ষ মানুষ অর্থাভাবে, চাকরি খুইয়ে চরম দারিদ্র্য ভোগ করছেন তাঁরা তো আমাদের দেশেরই জনগণ! তাঁদের কথা ভেবে একটা বছর কি আমরা ‘পুজোয় চাই নতুন জামা, নতুন জুতো’ বলতে বলতে সমস্ত সংকট উপেক্ষা করে ‘পুজোর বাজার’ করতে ঝাঁ চকচকে মলে উপচে প’ড়ে ভিড় না করে পারতাম না?

জানি না বন্ধুরা, তবে মানুষের মধ্যে এই দ্বৈতসত্তায় বড় বিচলিত লাগে। একদিকে দুখি, রোগক্লিষ্ট মানুষের জন্য ফেসবুক জুড়ে কষ্ট ও সমব্যথী হওয়ার পোস্ট, অন্য দিকে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনাকে তুড়ি মেরে মাস্কবিহীন হয়ে ‘পুজোর বাজারে’ উপচে ওঠা মানুষ...! 

তোমরা বড়দের দেখে এসব শিখো না। তোমরা সত্যিকারের অনুভূতিশীল নাগরিক হও। তোমাদের কাজে, তোমাদের আচরণে যেন এই চরম সঙ্কটময় অতিমারির কালে অকারণ উল্লাস না ঝ’রে পড়ে। 

সৎ সাহিত্য পড়ো, লেখালেখি করো আর অবশ্যই যারা কষ্টে আছেন তাদের কথা লোকদেখিয়ে নয়, সত্যি করে ভাবো। আর উৎসবে মেতে করোনা অতিমারিকে আরও বৃহৎ আকারে ছড়িয়ে পড়া থেকে বড়দের বিরত করো। 

তোমাদের বন্ধুদাদা

ছবি : অনুভব মন্ডল, তৃতীয় শ্রেণি, হেমশীলা মডেল স্কুল

ধারাবাহিক/ ৪

জলে জঙ্গলে সুন্দরবন

প্রকাশ কর্মকার

আমরা সবাই নিচে শোবার জায়গায় গিয়ে বসলাম আর ব্রজেশ কাকু সেই অতীতকালের গল্প বলা শুরু করলেন—

‘‘আজ থেকে প্রায় চার’শো বছর আগে এই সুন্দরবনের গহীন অরণ্যের কিছু দ্বীপে মানুষের বসতি ছিল। তখন সুন্দরবন দু’ভাগে ভাগ হয়নি। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার পাখির পায়ের মতো ছড়ানো নদীজালে এই সুন্দর বিশাল ম্যানগ্রোভ বনভূমি অঞ্চল তখন তার আদিম আবহে লুকিয়েছিল সভ্য জগত থেকে অনেক দূরে। অরণ্যে মানুষজনদের অনেক সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হত। কখনও প্রবল সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড় আবার কখনও জলদস্যুদের আক্রমণ, আর বনের হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে জীবন জীবিকার তাগিদে লড়াই তো ছিলই। এই অঞ্চলে রাজত্ব করত রাজা সুতোঞ্জয়। যেমন প্রজাপালক ছিল তেমনি ছিল দয়ালু। চারদিকে ছিল রাজার জয়জয়কার। প্রজারাও এই রাজার রাজত্বকালে খুব সুখেই ছিল। তার একমাত্র সুযোগ্য পুত্র অলোঞ্জয়। রাজপরিবারের নিয়ম বংশ পরম্পরায় রাজার ছেলেই রাজা হবে। তাই অলোঞ্জয়ের রাজ্যাভিষেকের সময় আসন্ন হল। অলোঞ্জয়কে মা এত দিন বুকে আগলে ছিল কোনও বিপদ যাতে তাকে আঘাত না করতে পারে। কিন্তু আর যে তাকে ধরে রাখা যাবে না কারণ ভবিষ্যতে অলোঞ্জয়-ই হবে এই দ্বীপের রাজা যে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে প্রজাদের রক্ষা করবে। রাজপরিবারের নিয়ম, ছোট্ট দ্বীপের নতুন শাসককে তার অকুতভয় দৃঢ়তা আর অদম্য সাহসের পরীক্ষা দিতে হবে। সেটি হল রাজপুত্রকে একাই তার তীরের ফলার আঘাতে এই সুন্দরবনের জঙ্গল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে কালো অভিশাপ রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে হত্যা করতে হবে। হিংস্র, সুবিশাল এই হলুদ পার্থিব দানবের মুখোমুখি দাঁড়াতে বড় বড় বীরদেরও বুক কাঁপে। রাতের আঁধার হোক কিংবা দিনের আলো, কত মানুষকে জঙ্গলের গভীরে টেনে নিয়ে গেছে এই বিশাল দানব তার হিসাব নেই। আজ রাজকুমার অলোঞ্জয়কে সেই মানুষখেকো দানবকে বধ করেই দিতে হবে রাজ্যাভিষেকের যোগ্যতার পরীক্ষা। এই কথা যেই রাজমহলের অন্দরে পৌঁছোয় সেই মুহূর্তে রানিমা অর্থাৎ অলোঞ্জয়ের মা রাজার কাছে ছুটে গেল। রাজা, রানির উদগ্রীব অবস্থা দেখে বলল, ‘‘দেখো রানি অলোঞ্জয় শুধু আমাদের একমাত্র পুত্র নয় ও হল এই সুন্দর দ্বীপের ভবিষ্যৎ মহারাজা, ও যদি এই সামান্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারে তাহলে প্রজাদের ও কিভাবে এই দ্বীপের বিভিন্ন অজানা বিপদ থেকে রক্ষা করবে?’’ 

বাঘ শিকারের কথা শুনে অলোঞ্জয় বিন্দুমাত্র ভয় পেল না কারণ ছোটবেলায় তার বেশিরভাগ সময় কেটেছে এই অঞ্চলের নদী নালায় মাঝি মাল্লাদের সঙ্গে। দাপিয়ে বেরিয়েছে সে গহন অরণ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ভয় কাকে বলে তা অলোঞ্জয়ের অজানা। একদিন সে বজরা সাজিয়ে সঙ্গী সাথী নিয়ে বেরিয়ে পড়ল খাল পেরিয়ে মূল নদীর দিকে। তার লক্ষ্য পশ্চিমের ঘন জঙ্গল, সুন্দরবনের গভীর অরণ্য যেখানে বাস করে তার শত্রু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। নিয়ম অনুযায়ী অলোঞ্জয়ের সঙ্গীদের হাতে কোনও অস্ত্র ছিল না, শুধু তার হাতে ছিল তীর ধনুক। সঙ্গী সাথীদের নিয়ে অলোঞ্জয়ের নৌকা নদীর জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে। চারিদিকের নিস্তব্ধতা আরও ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমের আকাশে সূর্য লাল বর্ণ ধারণ করেছে। জঙ্গলের মায়াবী রূপ আরও মায়াবী আকার নিয়েছে। কোনও এক বিপদের জন্য অপেক্ষা করছে এই বনভূমি। পশ্চিমের আকাশে কালো মেঘ জমেছে। মাঝে মাঝে বিজলির ছটা বুকে শিহরণ ধরিয়ে দিচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে আঁধার নেমে আসছে। একটু পরে আর কিছুই দেখা যাবে না। খাল পেরিয়ে নৌকা ছুটছে তীরের মতো। অলোঞ্জয়ের সজাগ দৃষ্টি বনের গভীরে। কোথায় লুকিয়ে তার প্রতিপক্ষ? পশ্চিমের মেঘটা জমাট বেঁধে আছে, হঠাৎ বনের মাঝে শোনা গেলো এক বিকট বজ্রপাতের শব্দ। বজরার মধ্যে রাজকুমারের সঙ্গী সাথীরা আসন্ন প্রলয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো, তারা ইশ্বরকে ডাকতে লাগলো, ‘‘হে ইশ্বর এই বিপদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো।’’ মায়াবী সুন্দরীর জঙ্গল অন্য দিনের চেয়ে আজ যেন বড্ড বেশি শান্ত। বনের ভিতরে যেন লুকিয়ে গভীর কোন ষড়যন্ত্র চলছে। আকাশের কালো মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আঁধার নামলে ঝাপসা হয়ে আসবে বনের চারপাশ। নদীপথে বৃষ্টির সময় নৌকা চালাতে অসুবিধা হয় তাছাড়া তখন শিকারকে নিশানা করা খুবই মুশকিল হয়। রাজকুমারের বজরা অন্ধকারের মধ্যে নদীর বুক চিরে দ্রুত এগোতে লাগল গভীরে জঙ্গলের দিকে। হঠাৎ এক হলদে আলোর ছটায় সবাই চমকে উঠল। কি ওটা? বজরার মধ্যে সবাই সজাগ। কেউ কোনও সাড়া শব্দ করলো না, সবাই চুপচাপ, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হলুদ জিনিসটার দিকে। রাজকুমার হাতের ধনুকটা শক্ত করে চেপে ধরলো।’’

‘‘তারপর?’’ মিহির কাঁপা গলায় ব্রজেশকাকুকে জিজ্ঞেস করল।

ব্রজেশ কাকু— ‘‘তারপরের ঘটনা আরও বেদনাদায়ক।’’

আমি বললাম, ‘‘রাত অনেক হয়েছে, আগামী কাল শুনব পরের ঘটনা, এখন খুব ঘুম পেয়েছে আমি ঘুমাবো।’’

হামিদ— ‘‘তোর তো শুধু ঘুম আর ঘুম, বাইরে বেড়াতে এসে শুধু ঘুমালে হবে? আর এত সুন্দর পরিবেশ ও গাইড যখন আমরা পেয়েছি তা কি কখনও হাতছাড়া করা যায়?’’

ব্রজেশ কাকু— ‘‘সকালের টিফিনের ব্যবস্থা করতে হবে, আজ আর নয়, আগামী কাল সন্ধ্যার সময় শেষ করব পরের কাহিনি।’’

(ক্রমশ)


কবিতা 

সুদূরের ডাক

অশোক দাস


একতারা সুর       ডাকছে সুদূর

ওরে মন শোন্      যাব কাশবন

লাল-মাটি টানে    ধু ধু মাঠ পানে

মুখে বকবক        থাকি অপারক

কোথা যাব উড়ি   মনে মনে ঘুরি

শরতের মেঘে      কাশফুল লেগে

রেশমি আলো      সূয্যি ঢালো

শিউলি ঝরে         শিশির পড়ে

দুগ্গা মাগো            এবার জাগো

তোমায় ডাকে      কাজের ফাঁকে

কষ্টে যারা             সর্বহারা--

এই মুঠো সুখ       ভুলে থাকে দুখ

এসো এসো ত্বরা  পথ চেয়ে যারা...

ছোঁয়াটুকু দিয়ে    দুঃখ যাও নিয়ে।।

Post a Comment

0 Comments