ব্লগ : দেশান্তর/ ১১ । আনন্দ ফিরে আসবে, আসবেই

আনন্দ ফিরে আসবে, আসবেই

মৌমন মিত্র

সপ্তাহ তিনেক আগে
প্রায় সাত মাস পর দূরে এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। মুখোশ, দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে, আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মুখোমুখি হলাম ভয়ঙ্কর এক পথ দুর্ঘটনার। গাড়িতে স্বামী, সন্তান, সকলেই উপস্থিত ছিল। দুর্ঘটনায় গাড়ির এয়ার ব্যাগ খুলে আমার ডান হাতে চোট পেলাম। বাকিরা সামান্য আহত হয়েছিল ঠিকই, তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। কাজের পরিমাণ বাড়লে আমার হাতের যন্ত্রণা এখনও বেশ জানান দেয়। সে আছে। আবার ঠিকও হয়ে যায়। এক কথায় আমরা সকলে শারীরিক ভাবে আরোগ্যলাভ করেছি। কিন্তু মনের কোথাও সেই আকস্মিক শক এখনো বাসা বেঁধে আছে। 

কেন, তার কারণ বহুবিধ হতে পারে। একটি প্রধান কারণ হয়তো বর্তমান সময়। মহামারির সময়। আমি যে জীবনে খুব কাছ থেকে মৃত্যু দেখিনি, তা নয়। দেখেছি। তবে সেদিন এই প্রথমবার জীবনের যাবতীয় মুহূর্ত একত্রিত হয়ে কেমন থমকে গিয়েছিল।ক্ষণিকের অভিজ্ঞতা সেই বাঁধভাঙা বিপদের কথা চিরকাল মনে করিয়ে দেবে হয়তো। দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া সেই সড়কে দাঁড়িয়ে আমি সেদিন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ— কিছুই ভাবতে পারিনি। নাস্তিকের অন্ধকার আর আস্তিকের অলৌকিক রাত। সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়! 

এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে দেখলাম মার্কিন রাষ্ট্রপতির করোনা ধরা পড়ল। পরিকাঠামো, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিধি— সব অস্বীকার করে, অগ্রাহ্য করে তিনি ক্ষমতায় ফিরতে চেয়েছেন। হঠাৎ এক বিকেলে দায়িত্বজ্ঞানশূন্য হ’য়ে একটি এস ইউ ভি চড়ে তাঁর ভক্তকূল-কে হাত নাড়াতে, বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ক্ষমতা কী মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে? ক্ষমতার লোভে মৃত্যুভয় কী আর ভয় হয়ে থাকে না?

প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক অঞ্চলের প্রচারভাষার মান কি এতটাই নেমে যাচ্ছে? তা কি ক্রমেই শিষ্টতা, দায়িত্ব, শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন এখন হাটে-মাঠে শোনা যায়।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক করোনা পরীক্ষা নিয়ে এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাবে একটি শব্দও খরচ করেনি হোয়াইট হাউস। এরই মাঝে শনিবার নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। সেদিন দৃশ্যত তাঁকে ‘তরতাজা’ মনে হয়েছে। তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন অধিকাংশ মার্কিনবাসী। সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়ার আগে দ্রুত নাটকীয় ভঙ্গিমায় মুখোশ খুলে ফেলতে দেখা যায় তাঁকে। 

মুখোশ পরা তাঁর কাছে একটি অত্যাচার কিংবা শ্বাস-রুদ্ধ হওয়া হাহুতাশ। এক টুকরো কাপড়ই যে আজ সংক্রমণ-প্রতিরোধী বস্তু, এই বিজ্ঞানসম্মত বার্তাটুকু মার্কিন প্রেসিডেন্ট দিতে অক্ষম। মানুষ তবে কার কাছে ত্রাণ প্রার্থনা করবেন? শৃঙ্খলা শিখবেন?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঝোঁকের মাথায় একটি কাজ করে বসেন। তারপর বেলুন ফেটে গেলে নিজেকে অন্তর্ধান করেছেন। বার বার। তাঁর এই ধরণের আচরণ মেনে নেওয়া এখন যেন এই দেশের রীতি, একটা অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে স্কুল, কলেজের বাৎসরিক নতুন সেশান শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় হুরমুড়িয়ে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। নিউ ইয়র্ক শহরের সাউথ ব্রুকলিন, বোরো পার্ক, মিডওয়ুড, কুইন্স, এবং কিউ গার্ডেনস এলাকায় দ্রুত বাড়ছে সংক্রমণের তালিকা।

জীবনের যাবতীয় অনিশ্চয়তা বয়ে দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে শরৎ এর আলতো রোদ মাখা দিনগুলো।আর শরৎ মানেই বাঙালির শারদোৎসব। যদিও আমার জানলার বাইরে যে নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি মিলিত এক টুকরো আকাশ দেখি রোজ, সেখানে অগণিত মায়েদের আর্তনাদ শুনতে পাই। নারীর কাটা জিভ, কাটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হাথরাস গ্রাম ছাড়িয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের সাবওয়েতে বিদ্যমান। তাঁদের অস্থি ছড়িয়ে দিতে পারবে ধনুচির ধোঁয়াশা?


উৎসবে যদি ক'টা দিন এই ক্ষোভের, কষ্টের সময়গুলো ভুলে  থাকা যায়,মানুষের অবসাদগ্রস্ত মন স্বস্তি পায়। তবে তা হয়তো আর কোনওদিন করোনার সংক্রমণের ভয় এবং তার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আতঙ্ক ছাপিয়ে যাবে না। মানুষ এই ক’মাস অগণিত মৃত্যু দেখেছেন। দেখেছেন গণকবর। যা কোনও উৎসব ভুলিয়ে দিতে পারে না।

নিউ জার্সির সমস্ত পুজো এই বছর অনলাইন। মন্দিরের পুজো অবশ্য দর্শনার্থীদের টাইম স্লট দেবে। যে আধ ঘণ্টা সময়সীমার মধ্যে তাঁরা গিয়ে মায়ের দর্শন করে আসতে পারবেন। প্রতি স্লট পিছু চার জনের পরিবার মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি থাকবে। সর্বত্র সিডিসি নিয়মাবলী অনুসরণ করা হবে। প্রসাদ এবং খাবারের সিল্ড প্যাকেট সকলের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। মন্দিরে ফুল, মিষ্টি গ্রহণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

এমনিতে প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময় এখানে শীত পড়ে যায়। তবে তাতে বাঙালির আনন্দে ভাঁটা পড়ে না। ক্লাব পুজো, মন্দিরের পুজো— সব মিলিয়ে নিউ একটা জার্সি ছোট খাটো কলকাতায় পরিণত হয়ে যায়!

এই বছর মহামারি যেন সব গ্রাস করে নিয়েছে। সময়ের নিয়মে সপ্তমী শুরু হলেই আমরা ক’টা দিন সেজেগুজে হই হুল্লোড়ে মেতে উঠতাম। ছুটির দিন তো বটেই, চেষ্টা চালিয়ে যেতাম একটু যদি কলকাতার বাঁচা বেঁচে নেওয়া যায়। পিচ, বেজ, মেরুন, আসমানি নীল— ছোট, বড়, সকলের পোশাক জুড়ে নানা রং আর প্যাটার্নের খেলা। শঙ্খ ফুঁ দিয়ে, ধুনচি নেচে, মায়ের বরণ করে, আসছে বছর আবার হবে ভেবে। 

তবে এই কুড়ির সনে দাঁড়িয়ে, সত্যি আজ বলতে চাই আসছে বছর আবার হবে। এই বছর হোক-না-হোক। জীবনের বিগত ছ’মাস, না-জানি আরও কত মাস কিংবা বছরে বুঝেছি এবং বুঝব, যে, আমাদের সময় সীমিত। জীবন নামক এই সফরেই ব্যথার বাঁশিতে আনন্দধ্বনি, আনন্দগান বাজিয়ে পরিপূর্ণ আশ মেটাতে হয়। হাতে হাত রেখে।

সর্বোপরি, আমরা সকলেই আজ করোনা আক্রমণিত এক নিশ্চল সময়ের মুখোমুখি। নগণ্য কণাও বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।বিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করে, অগ্রাহ্য করে আমরা নিজেদের বিপদই ডেকে আনব। শৃঙ্খলাবদ্ধ থেকে পুজোর দিনগুলো নিজেদের উচ্ছাস দমিয়ে রাখলে বেঁচে থাকা থাকবে। অর্থনীতি থাকবে। উৎস থাকবে। আনন্দ ফিরে আসবে। আসবেই।

এই মহামারির পর্ব সমাপ্ত হলে, আমরা যখন একে একে শিরস্ত্রাণ খুলে দাঁড়াব, খোলা আকাশের নীচে, আমাদের চোখে মুখে লেগে থাকুক যুদ্ধের অনিবার্য ক্ষত চিহ্ন। ক্ষত দাগের কাটাকুটি খেলা। আমার আহত বাহুর মতো।

ভাবীকালের জন্য এক পরিত্রানহীন সংকটকে লড়তে আবিশ্ব শিখে যাবে। আসছে বছর। বছর বছর।         

Post a Comment

0 Comments