ব্লগ : হ্যালো হান্ড্রেড/ ৭ । অপারেশন ফিনালে


অপারেশন ফিনালে

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য

হিব্রু ভাষায় ‘মোসাদ’ শব্দের অর্থ ‘ইনস্টিটিউট’ বা প্রতিষ্ঠান। আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের এই গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘দ্য ইনস্টিটিউট ফর ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশন্স’। মোসাদকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা। একে ঘিরে সবচেয়ে বেশি রহস্যজনক ও চাঞ্চল্যকর গল্প চালু আছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদির মৃত্যুর পর বিশ্বের ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের প্রকল্পে শামিল হয়েছিল। ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের কাছে ‘পবিত্র ভূমি’ বলে পরিচিত বৃহত্তর প্যালেস্টাইনকেই তারা বেছে নিয়েছিল নতুন এই বাসভূমির জন্য। 

নাৎসিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হত। এই জায়নিস্ট আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে শুরু থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছে ইসরায়েল। পৃথিবীব্যাপী লুকিয়ে থাকা নাৎসি যুদ্ধপরাধীদের খুঁজে বের করে মোসাদ। একের পর এক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিটলারে নাৎসি বাহিনী যে ৬০ লাখ নিরীহ ইহুদি হত্যা করে তা ইতিহাসের সবথেকে বড় গণহত্যা বা হলোকাস্ট নামে পরিচিত। তবে প্রথম দিকে ইহুদিদের নিয়ে নাৎসি বাহিনীর হত্যার পরিকল্পনা ছিল না। তাদেরকে লেবার ক্যাম্পে বন্দি করে কঠিন সব কাজ করানো হত। ঠান্ডায়। স্বল্পাহারে। 

এরপর নাৎসিদের ইউরোপ দখলের সাথে সাথে ইহুদি বন্দির পরিমাণ বাড়তে থাকে। ফলে লেবার ক্যাম্পে ইহুদি বন্দীদের জায়গা হচ্ছিল না। এছাড়াও বন্দি হওয়া অনেক ইহুদি কাজ করতে অক্ষম ছিল। রোগে জর্জর। বয়স্ক। মহিলা। তাই এই সমস্যার শেষ সমাধান হয় গণহত্যা। ‘ফাইনাল সলিউশান’ সিদ্ধান্তের কারিগর ছিলেন এডলফ আইখম্যান। তিনি ছিলেন হিটলারের এসএস বাহিনীর প্রধান। তবে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি উবে যান। হঠাৎ গায়েব। 

বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ইসরায়েল এবং মিত্র বাহিনীর সদস্যরা পুরো ইউরোপ জুড়ে পলাতক নাৎসি বাহিনীর সদস্যদের শাস্তি দেওয়ার জন্য গ্রেফতার শুরু করে। হিটলার ও তার অনেক সহচরেরা আত্মহত্যা করে। বেঁচে থাকা নাৎসিদের বিচার হয় ন্যুরেমবার্গে। তবে নাৎসি বাহিনীর কিছু বড় অফিসার ইউরোপের বাইরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পরাজয়ের পর আইখম্যান স্রেফ লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায়, অনেকে ধরে নিয়েছিল- সে হয়তো মরে গেছে। এই ভুল ভাঙে ১৯৬০-এ, যখন মোসাদ-এর কাছে জার্মানি থেকে গোপন সূত্রে খবর আসে, আইখম্যান আসলে আর্জেন্টিনায় লুকিয়ে আছে। সেই সময় সুয়েজ খাল নিয়ে মিশরের সাথে ইসরায়েলের ঝামেলা চলছে। মোসাদ প্রধান ইজার হারেল শুরুতে এই তথ্যকে গুজব ভেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। একজন তাকে বলল, ভেবে দেখুন স্যার, যদি সত্যিই আর্জেন্টিনায় দেখা পাওয়া লোকটা আইখম্যান হয়, তাহলে লোকে বলবে মোসাদের একটা ভুলের জন্য ফাইনাল সলিউশনের আর্কিটেক্টের বিচার হয়নি। এই একজনটা হচ্ছেন মোসাদ এজেন্ট পিটার মালকিন।

তৎকালীন আর্জেন্টিনায় ফ্যাসিস্ট সরকার ধন সম্পদের লোভে এবং মনোভাবে মিল থাকার কারণে অনেক পালাতক যুদ্ধাপরাধীদেরকেই আশ্রয় দেয়।  আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে সেনর রিকারডো ক্লেমেন্তকে কেউ চিনত না। কম কথার মানুষ। পরিবার নিয়ে থাকে, কাজ করে একটা জলবিদ্যুৎ কারখানায়। কেউই চিনত না। অবশ্য প্রবাসী নাৎসিরা চিনত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যারা আর্জেন্টিনায় পালিয়ে গিয়েছিল। লোকটার আসল নামটাও তারা জানত- অ্যাডলফ আইখম্যান।

এই খবর ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়নকে জানানো হয়। তিনি কুটনৈতিক উপায়ে আইখম্যানকে শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থ হবেন জেনে আইখম্যানকে জীবিত অথবা মৃত ইজরাইলে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন ইসরায়েল গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে। গোয়েন্দা প্রধান ইসার হারেলের কান কামড়ে অবশ্য অন্য কথা বলেন তিনি। “আমি চাই ওই শুয়োরটাকে জ্যান্ত নিয়ে আসুন। সেটা আমাদের দেশের যুবাদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’’ 

মোসাদ এই অত্যন্ত গোপন মিশনের জন্য তাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু এজেন্টকে নিয়োগ করে। শুরু হয় অপারেশন ফিনালে। মোসাদের এজেন্টদের অনেকেই হলোকাস্টে পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে, তাই কেউ কেউ, আইখম্যানকে হাতে পেলেই শেষ করে দেওয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হলো লোকটাকে জীবিত ধরতে, বিচারের সম্মুখীন করতে; তাদের মানবিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারার পেশাদারিত্বের পাঠ দেওয়া হলো আরেকবার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী মোসাদের গোয়েন্দারা ১৯৬০এর মার্চে আর্জেন্টিনা যায়। তারা লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের পর্যটক এবং ব্যবসায়ী হিসেবে আর্জেন্টিনায় প্রবেশ করে। তিনজন এজেন্ট ক্যালে চাকাবুকোতে রিকারডো ক্লেমেন্তের বাড়ির উল্টোদিকে ঘর ভাড়া নেয়। তাঁরা জানালায় টেলিস্কোপিক লেন্স লাগানো ক্যামেরা বসায়। ক্লেমেন্তের চলা ফেরা, কাজে যাওয়া, বাগানে ঘোরা, প্রতিনিয়ত ছবি তোলা হয়। তাঁর রোজকার নিয়মাবলী নখদর্পণে করে। এর মধ্যে একবার ক্লেমেন্ত পরিবার নিয়ে বাড়ি বদল করে গারিবল্ডি স্ট্রিটে চলে গেলে, এজেন্টরাও সেখানে উঠে যায়। যেহেতু মোসাদ এজেন্টরা বিদেশে বেআইনিভাবে কাজ করছিল, তাই তাঁদের প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে চলতে হচ্ছিল। কোথাও ভুল করার অবকাশ নেই। যে কোনও ছোট ভুলে ইসরায়েল-আর্জেন্টিনা সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। 

যদিও আর্জেন্টিনা অনেক নাৎসিদের সেদেশে থাকতে দিয়েছে, সেদেশ আবার ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যে বড় ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে আর্জেন্টিনা পালিয়ে এসে ক্যাপ্রি বলে একটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থায় সুপারভাইসারের কাজ শুরু করে ক্লেমেন্ত। ১৯৫২ সালে সে তার স্ত্রী ভেরা লিবেলকে একটা অনামী চিঠি পাঠায় অস্ট্রিয়াতে। চিঠির বয়ান ছিল, ‘তোমার ছেলেদের কাকা, যাকে সবাই মৃত ভাবে, সে বেঁচে আছে।’ 

হাতের লেখা বুঝতে পারেন ভেরা। তিন ছেলেকে নিয়ে পাড়ি দেন আর্জেন্টিনা। সেখানে এসে তিনি তার ছেলেদের ‘কাকা’কে বিয়ে করেন। তার তিন ছেলে বুঝতেও পারেনি যে এই কাকাই আদতে তাঁদের বাবা। এরপর রিকারডো আর ভেরার আরেকটি সন্তান হয়। দিব্যি কাটছিল সময়।

ওদিকে অস্ট্রিয়ার লিনজ্‌ শহরে পেপারে একটি মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়। ফ্র’ আইখম্যান, এডলফের মা মারা গেছেন। পরিবারে যারা বেঁচে আছেন তার মধ্যে এডলফ বাদে তাঁর চার ছেলে ও তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের নাম ছিল। এবং, এডলফের স্ত্রী ভেরা আইখম্যানের নাম ছাপা হয়। 

একজন এজেন্ট ভেরার মা মারিয়ার কাছে যায়। ভেরার খবর জিজ্ঞাসা করায় তিনি তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন। শুধু গজগজ করতে এটুকু বলেন  যে ভেরা কোন একজন ক্লেম না ফ্লেমকে বিয়ে করে দক্ষিণ আমেরিকায় আছে। দুই আর দুইয়ে চার হয়।

মায়ের অন্ত্যেষ্টিতে এডলফ আসে না। আসে তার বাকি চার ভাই। এমিল, ফ্রেড্রিক, অটো আর রবার্ট। অন্ত্যেষ্টির ছবি তোলে এজেন্টরা। পুরনো ছবি ঘেঁটে দেখা গেল অটো আর এডলফ প্রায় একরকম দেখতে। অটোর ছবি পাঠানো হলো আর্জেন্টিনাতে। যাতে বয়সের সাথে চেহারার পরিবর্তনের একটা সামঞ্জস্য ধরা যায়।

সবকিছু মিলে যাওয়া সত্ত্বেও মোসাদ খুব ধীরে পদক্ষেপ নিচ্ছিল। অপারেশনের গুরুত্ব অনুধাবন করে মোসাদ প্রধান হারেল স্বয়ং বুয়েন্স আয়ার্সে এসে উপস্থিত হলেন। এরমধ্যে ক্লেমেন্ত একটা কাঁচা কাজ করল, যেটা তার চিহ্নিতকরণে লোপ্পা ক্যাচ তুলে দিল মোসাদকে। ২১ মার্চ অফিসফেরতা ক্লেমেন্ত তার স্ত্রীর জন্য এক গুচ্ছ ফুল কিনে নিল। এরকম ফুল সে কখনও কেনে না। মোসাদ এজেন্টরা আইখম্যানের ফাইলে দেখতে পেল, ২১ মার্চ ১৯৩৫-এ আইখম্যান আর ভেরার আসল বিয়ে হয়েছিল। এটা তাঁদের রৌপ্য জয়ন্তী। 

হিব্রুতে একটা কোডেড টেলিগ্রাম গেল ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিভে। “হাইশ হৌ হাইশ।’’ এই লোকই সেই লোক। এপ্রিলে চারজন ইসরায়েলি কমান্ডো ভুয়ো কাগজপত্র সমেত আলাদা আলাদা ভাবে বুয়েন্স আয়ার্সে পৌঁছালো। আরও দু’জন আর্জেন্টিনীয় ইহুদিকে নেওয়া হল ছজনের টিমে। শেষ দুজনকে বলা হলো অপারেশন সম্পন্ন হলে তাঁদের চিরদিনের জন্য এদেশ ছেড়ে যেতে হবে। 

অপারেশন ফিনালের লক্ষ্য ছিল এডলফ আইখম্যানকে আর্জেন্টিনায় গোপনে গ্রেফতার এবং আইখম্যানের নিজের ইচ্ছায় ইসরায়েলে এনে শাস্তির আওতায় আনা। যা তৎকালীন পরিস্থিতিতে কার্যত অসম্ভব ছিল। কারণ আর্জেন্টাইন ফ্যাসিস্ট সরকার আইখম্যানকে কোনোভাবেই ইসরায়েলকে প্রত্যর্পণ করবে না। 

মোসাদ অন্য পরিকল্পনা ফাঁদল। আর্জেন্টিনার ১৫০ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ইসরায়েল থেকে আর্জেন্টিনা সরাসরি এল-আল এয়ারলাইন্স চালু হবে। প্রথম বিমানে আসবেন ইসরায়েলের বিদেশ মন্ত্রী আব্বা ইবান। সেই প্লেনে করে আগে থেকে গোপনে বন্দি করা আইখম্যানকে লুকিয়ে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হবে। 

১১ মে সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকাল। অনেক আগেই দিন শেষ হয়ে আঁধার নেমেছে। গারিবিল্ডি স্ট্রিটের এক কোণে একটা গাড়ি হুড খোলা অবস্থায় দাঁড় করানো। মেকানিকের বেশে তিনজন নিমগ্ন হয়ে গাড়ি সারাচ্ছিল। চতুর্থ জন, গাড়ির মালিক অধৈর্য হয়ে পাইচারি করছিল। অফিসের গাড়ি কাছেই নামিয়ে দিয়ে যায় আইখম্যানকে। ধীর পায়ে সে যেই গাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, মেকানিকরা তাঁকে জাপ্টে ধরে গাডির মাঝের সিটে ঠেলে দিল। 

সেখানে আগে থেকে বসে থাকা দু’জন এজেন্ট তাকে পায়ের কাছে ঠেসে ধরল। গাড়ির মালিক গাড়ি চালু করে দিল।  গাড়ির গন্তব্য আগে থেকে ঠিক করা সেফ হাউসে। ফ্লোরেন্সিও ভারেলা ডিস্ট্রিক্টে। গাড়ির চালকের ভূমিকায় এজেন্ট ভি আহারোনি স্পিডে গাড়ি চালাতে চালাতে মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন। “হু আর ইউ”? 

কোনও ভনিতা না করে রিকারডো ক্লেমেন্ত পরিষ্কার জার্মানে বলেন, “ইখ্‌ বিন এডলফ আইখম্যান।’’ তারপর নিজেই বলেন যে তিনি বুঝেছেন যে সে ইহুদিদের হাতে বন্দি।

পরিকল্পনা ছিল সেদিনই নতুন বিমানে তাঁকে ইসরায়েল উড়িয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জানা যায় যে প্লেন আসতে এগারো দিন দেরি হবে। অপরদিকে আর্জেন্টাইন কর্তৃপক্ষও আইখম্যান এর নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে যায়। ফলে তারাও পুরো আর্জেন্টিনাব্যাপি অভিযান শুরু করে, যা মোসাদের অপারেশনকে আরো কঠিন করে দেয়। অত্যন্ত চালাকির সঙ্গে মোসাদ এজেন্টরা এগারো দিন এডলফ আইখম্যানকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু একটা বড় সমস্যা এসে দাঁড়ায়। ইসরায়েল এম্বাসি থেকে এজেন্টদের জানানো হয়, লোকটি স্বেচ্ছায় ইসরায়েলে আসতে চায়, এমন স্টেটমেন্টে তার সই নিয়ে তাকে আনতে হবে। মহা বিপদ।

ভি আহারোনি শুরুতে ভদ্রভাবে চেষ্টা করে, একসময় ধৈর্য হারিয়ে মত দেয়, প্রয়োজনে পিটিয়ে আইখম্যানের সই আদায় করা হোক। কিন্তু অন্য এজেন্ট, পিটার মালকিন জানে লোকটা এসএস প্রধান ছিলো, পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেললেও বশ মানবে না। তাই সে আইখম্যানের সঙ্গে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। 

কম যান না আইখম্যান। সে মালকিনকে উত্তেজিত করতে একটা ঘটনা বলে। হলোকাস্টে পিটার মালকিন তার বোন ফ্রুমাকে হারান। ফ্রুমার তিন শিশুসন্তানকেও খুন করেছিলো নাৎসিরা। একবার একসাথে ৫,০০০ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। একটা পরিখা খুঁড়ে, সেখানে লাইন ধরে ইহুদিদেরকে নগ্ন করিয়ে দাঁড় করানো হয়। তাঁদের দিকে নাৎসি সৈন্যদের বন্দুক তাক করা। সৈন্যরা অপেক্ষা করতে থাকে আইখম্যানের নির্দেশের। এক ইহুদি নারী তার বাচ্চাকে উঁচু করে তুলে ধরেছিল, হয়তো ভেবেছিল আইখম্যানের দয়া হবে। ফুটফুটে নগ্ন শিশুটা কাঁদছিল। খিদে, তেষ্টায়, ঠান্ডায়। আইখম্যান তার 

সৈনিকদেরকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে প্রথম গুলি বাচ্চাটার মাথার ভেতর দিয়ে চলে যায়। রক্ত ছিটকে এসে আইখম্যানের ইউনিফর্মে লাগে। আইখম্যান বিশ্বাস করত ইহুদিদের রক্ত নোংরা, তাই সে বিরক্ত হয়ে, ইউনিফর্ম থেকে মুছে ফেলে শিশু রক্তের দাগ। ঘটনাটা শুনিয়ে সে পিটার মালকিনকে বলে, ওই শিশুর মা-ই তোমার বোন না তো!

তারপর সে বলে, আমাকে নিয়ে তোমরা আর কী-ই বা করবে? ফাঁসিই তো দেবে! তার মানে হলো, আমার জীবন ষাট লক্ষ ইহুদির জীবনের সমান, অথচ ওই ষাট লক্ষ ইহুদি, ওরা তো আমার থুতুরও যোগ্য না। মালকিন হয়তো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেরেই ফেলতো লোকটাকে। মেডিকেল ডক্টর হান্নাহ মানবিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারার পেশাদারিত্বের পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে নিরস্ত করেন। মনে করিয়ে দেন, তারা প্রতিশোধ নিতে আর্জেন্টিনায় উড়ে আসেনি। এসেছে ন্যায়বিচারের জন্য।

এর পরেও এগারো দিন তার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করে মালকিন। তাকে খাইয়ে দেয়। শেভ করায়। কৌশলে তার কাছ থেকে সই আদায় করে নেয়। এগারো দিন পর অর্থাৎ ৪ এপ্রিল আর্জেন্টাইন কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে প্লেনের ক্রু সেজে সকল এজেন্ট এবং এডলফ আইখম্যানকে অচেতন করে মদ্যপ ক্রু হিসেবে প্লেনে ওঠানো হয়। বিমান তেল আভিভে অবতরণ করার পরেও ‘মদ্যপ কর্মীকে’ তিরস্কার করে বিমান কর্তৃপক্ষ। বিমানের সব প্যাসেঞ্জার চলে গেলে বিমান ঢোকানো হয় হ্যাঙারে। সেখানে মোসাদের বিশেষ গাড়ি অপেক্ষা করছিল তাঁদের প্রাইজ ক্যাচের।  

দুবছর ধরে আইখম্যানের বিচার চলে। তার বিরুদ্ধে পরিচালিত ১৫ টি মামলার সব গুলোতেই দোষী প্রমাণিত হয়। আইখম্যান ছিল একমাত্র নাৎসি যার বিচার হয়েছিল জেরুজালেমে। যে শহরে সহাবস্থান করে পশ্চিম দেয়াল, চার্চ অফ দি হোলি সেপালক্যার, আর বায়তুল মোকাদ্দাস। তিন ধর্মের পবিত্র তীর্থের শহর জেরুজালেম। এই বিচার পুরো বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনে দেখানো হয়। 

আইখম্যান ১৯৬২ সালের ২৯ মে ক্ষমা ভিক্ষা চেয়ে এক চিঠিতে লেখেন, হলোকস্টের জন্য দায়ী নাৎসি নেতারা।  তিনি নেতাদের হাতের যন্ত্র মাত্র ছিলেন। নেতাদের দেওয়া দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে পার্থক্য টানার প্রয়োজন রয়েছে। আইখম্যান ক্ষমার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে ইসরাইলী প্রেসিডেন্ট আইজাক বেনজবির উদ্দেশে বলেছিলেন, আমি দায়বদ্ধ হওয়ার মতো কোন নেতা ছিলাম না। তাই নিজেকে আমি দোষী মনে করি না। 

তার এই ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন ইসরাইলের সুপ্রিমকোর্ট প্রত্যাখ্যান করে তৎক্ষণাৎ। এ নাৎসি যুদ্ধাপরাধী ইহুদী নিধনযজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। একদম প্রথম সারিতে। তাঁকে ইতিহাসও ক্ষমা করতে পারবে না। ১৯৬২ সালের ১ জুন আইখম্যানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আইখম্যানকে কবর দেওয়া হয়নি। নাৎসিরা নিজেদেরকে আর্য মনে করত, তাই তারা বিশ্বাস করত আগুনে পোড়ানোর প্রথায়। আইখম্যানের লাশ পোড়ানো হলে পোড়া ছাইগুলো জাহাজে করে নিয়ে সমুদ্রে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

(লেখক একজন আইপিএস অফিসার ও গদ্যকার)

Post a Comment

0 Comments