খেলা হচ্ছে, খেলছি আমরা


খেলা হচ্ছে, খেলছি আমরা

আবীর মুখোপাধ্যায়


খেলা হল স্যার? ম্যাডাম... কেমন খেললেন? কমরেড, আপনি? 

গত ২৪ ঘণ্টায় আমার দেশে আক্রান্ত ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার, সক্রিয় রোগী ছাড়াল সাড়ে ৩১ লক্ষ। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৮ জনের! কী অসাধারণ— মোক্ষম খেলেছেন। 

খেলা কী শেষ? কী খেললেন বলুন তো— বিশ্বের সব দলের, সব খেলার রেকর্ড ভেঙে তছনছিয়া ভারত! সকল দেশের সেরা!

সংক্রমণে বেলাগাম আমার দেশ!

কী জানেন, একটার পর একটা খারাপ খবরের ফিড দেখতে দেখতে, প্রিয়জন হারাতে হারাতে এখনও কানে বাজছে, আপনাদের দামাল শ্লোগানের সেই কোরাস— ‘‘খেলা হবে, খেলা হবে।’’ এই তো, এই ক’দিন আগেই আপনারা— নাচিয়ে ছিলেন। আর আমরা হাড়-হাভাতে, রঙ্গপ্রিয় বঙ্গবাসী উদ্বাহু হয়ে নেচে ছিলাম। মনে মনে হয়তো কেউ কেউ গেয়েছিলাম— ‘‘সে দিন যেন তোমার ডাকে ঘরের বাঁধন আর না থাকে--/ অকাতরে পরানটাকে প্রলয়দোলায় দোলাতে চাই॥/ কোন্ খেলা যে খেলব কখন্ ভাবি বসে সেই কথাটাই—’’। নাকি আমাদের কী সব তন্ত্র-টন্ত্র আছে— তার শ্রেষ্ঠ উৎসব! তাকে ঘিরে তামাম জনতার উৎসাহ দেখে বুঝি বা হাততালি দিয়েছিল কমিশন!

‘‘খেলা তো হবেই’’— বলেছিলেন না? কখনও নিউজ অ্যাঙ্কারের কথার পিঠে সুর চড়িয়ে, কখনও সংবাদ-প্রতিনিধির বুম ছিনিয়ে হল্লা করছিলেন— ‘‘খেলা হবে, খেলা হবে!’’  

আচ্ছা, খেলা কী শেষ স্যার? ম্যাডাম ছুটি আমাদের? কমরেড— এ বার তাহলে যাই?

হাসছেন? এই তো দেখুন। হাতে নিশান। ভোট দিয়েছি স্যার। বিশ্বাস করুন, সক্কাল সক্কাল লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট— ভোট। জিতে যাবেন স্যার। রাষ্ট্র-যন্ত্রে শব্দ হয়েছে। আঙুলে দাগ— এই দেখুন। স্যার খেলা হবে তো এ বার? 

আমরা কাশছি স্যার। কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। তালুর কাছটা কেবলই শুকিয়ে আসছে। জল খাচ্ছি বার বার, তবু ঘুমোতে পাচ্ছি না ম্যাডাম। এত কাশি হচ্ছে কেন বলুন তো? কমরেড পড়শি ঘরে দু’জনের ধুম জ্বর— অক্সিজেন নাকি এখন ২২ হাজার যাচ্ছে। রেমডিসিভির ৪৪...! হ্যালো, কমরেড আমাদের বোন কোভিড পজিটিভ! লেবার পেইন উঠেছে। গোটা কলকাতার কোথাও একটা... একটা বেড! একটু অক্সিজেন! বোনটাকে যদি...!

স্যার খেলা হচ্ছে? খেলা হচ্ছে। আমরা পারছি...! আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। 

দেখুন না— খেলতে খেলতে কেমন খেলুড়ে হয়ে পড়ছি আমরাও। কোনও শোক, কোনও মৃত্যুই আর দু’দণ্ড ভাবাচ্ছে না আমাদের। সোশ্যাল মিডিয়ায় সার সার মৃত্যু মিছিল। সারা দেশে দাউ দাউ চিতা জ্বলছে সড়কে। বাতাসে অক্সিজেন কমছে বুঝি— দিল্লি, কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, গুজরাত থেকে শব পোড়া গন্ধ এখানে, আমাদের সেলফোনে। এই বাংলায়! গোটা শরীরে, চোখে-মুখে শব-পোড়া ছাই! আকাশে কালো ছাই উঠছে স্যার। দেখছেন ম্যাডাম— চিতার কালো ছাই সূর্য ঢেকে দিচ্ছে! 

গত এক বছর ধরে চিকিৎসকদের আশঙ্কার কথা আপনারা কেউ শুনলেন না! গোটা একটা বছর সময় পেয়েও ভাবলেন না আমাদের মতো সাধারণের কথা। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ-এর কথা। বরং কেউ নিদান দিলেন, অমুক খান করোনা হবে না। অমুক করুন, করোনা সেরে যাবে। নজির গড়লেন! তামাম পৃথিবী দেখছে, ক্ষমতার কত কাঙাল আপনারা! কত অর্থ-পিশাচ! নইলে, এই সংকট-কালে টিকার দরদাম নিয়ে তরজা চলে? দফায় দফায় ভোট করা গেল, টিকা দেওয়া গেল না— তাই না? অবিশ্বাস্য লাগছে, এখনও অবধি দেশে টিকার ডোজ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ২২ লক্ষ ৪৫ হাজার ১৭৯জনকে! সঙ্কল্প নিয়েছেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যের ক্ষেত্রে টিকার দাম আলাদা কেন? এখানেও খেলা? 

খেলা হবে, স্যার খেলা হবে!

একে অপরের গলা ছাপিয়ে যেন দর হাঁকলেন— খেলা হবে, খেলা হবে। এর কি কোনও দরকার ছিল? এই অবিবেচক আহ্বানের? আহাম্মকির? কী দোষ করেছিলাম বলুন তো আমরা? সবে মারির প্রথম ঢেউ সামলে উঠছিলাম। বন্ধ দোকান খুলছিল। মাঠে ধান। মুখে দু’ মুঠো অন্ন! আবার সকলের মুখে হাসি ফুটছিল। ছেলেমেয়েগুলো পার্কে খেলছিল আবার। ঠিক সেই সময়! হাওয়ায় রটিয়ে দিলেন পথের কু-ডাক— আবারও ভুল করলাম আমরা— সাধারণরা। ভুলে গেলাম মারির পূর্ব-স্মৃতি! চিকিৎসকদের শত-অনুরোধ! অন্য মুলুকের অভিজ্ঞতা!

আবারও ভোট পাখি উড়ল আকাশে। আপনারা ডাকলেন— আমরা খেললাম! গলি থেকে রাজপথ— কাতারে কাতারে জনজোয়ারে ভাসল। 

ভিড় দুলে দুলে উঠল শ্লোগানে— খেলা হবে, খেলা হবে। 

খেলা কিন্তু সত্যি হচ্ছে স্যার। রোজ— প্রতি প্রতি মুহূর্তে! একদল মানুষ অক্লান্ত ভাবে খেলছেন। সে অন্য খেলা। হ্যাঁ। ভয়ঙ্কর খেলা। এই লড়াইয়ে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রতি দিনই তাঁদের কেউ না কেউ আক্রান্তও হচ্ছেন। ইতিমধ্যে মৃত্যুর দীর্ঘ তালিকা সঙ্গে নিয়েই খেলছেন এই করোনাযোদ্ধার। কুর্নিশ তাঁদের। কুর্নিশ সেই সব শশ্মান বন্ধুদের— যাঁরা এই আকালেও— জাত ভুলে কাঠ সাজিয়ে দিচ্ছেন শবদেহের উপর! সেলাম সেই সব বন্ধুদের— যাঁরা বিনিদ্র রাত, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একটা বেড কিংবা একটু অক্সিজেনের খবর পৌঁছে দিচ্ছেন পরস্পরকে!  


যে দেশে পথে পাথর জাগিয়ে ফুল চড়াতে লাখো লোক জমায়েত হয়, ছুটকো দাবিতে ধর্মঘট করে কর্মদিবস নষ্ট হয়, ভোট মানে মুড়ি-ঘুগনি অথবা বাংলা মদের মহোৎসব— সেখানে কোনও দরকার ছিল এমনতরো উস্কানির? এই মারির কালে, জনাদেশের নামে এমন মহোৎসবের! মনে রাখবেন, ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না। পক্ষ নয়, দায় নিন। দোষ স্বীকার করুন সকলে। আসুন সমবেত হয়ে, এ বার অন্তত সভ্যতা বাঁচানোর একটা খেলা খেলি আমরা। প্লিজ... আর রাজনীতির খেলা খেলবেন না স্যার! প্লিজ ম্যাডাম। 

প্রিয় কমরেড, আর না! 

 

Post a Comment

0 Comments