মৃত্যুর ফেরেশতা
দ্যুতিমান ভট্টাচার্য
ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলার (Dr. Josef Mengele) জন্ম ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ জার্মানির বাভারিয়ার গুঞ্জবার্গে। কার্ল ও ওয়েলবুর্গা ম্যাঙ্গেলার তিন সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ইয়োসেফের অন্য দুই ভাই কার্ল জুনিয়র এবং এলোইস। কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি উৎপাদন করতেন তাঁর পিতা। ইয়োসেফ ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টের গ্যটে (Goethe) বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখে যথাক্রমে মেডিসিন এবং দর্শন নিয়ে পড়তে চলে যান।
১৯৩৫ সালে ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখ থেকেই নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি অর্জন করেন এবং ১৯৩৭ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের ইন্সটিটিউট ফর হেরেডিটারি বায়োলজি এন্ড রেসিয়াল হাইজিন এর বিজ্ঞানী ড. ওটমার ফ্রেইহার ভন ভার্সচুয়ারের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। ড. ওটমার বংশগতির উপর গবেষণা করতেন এবং যমজদের বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ড. ওটমারের সহকারী হিসেবে ম্যাঙ্গেলার খাঁজযুক্ত চিবুক, ঠোঁট ইত্যাদি বিষয়ের জন্য দায়ী বংশগত কারণগুলোর প্রতি আগ্রহ ছিল।
১৯৩৮এ ম্যাঙ্গেলা হিটলারের এসএস বা সুতজ্টাফেতে (Schutzstaffel, তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী) যোগ দেন। ১৯৪০ সালের জুন মাসে ম্যাঙ্গেলাকে সেনাবাহিনীতে পাঠানো হয় চিকিৎসক হিসেবে। ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে পদোন্নতি পেয়ে এসএস ক্যাপ্টেন হন যার ফলস্বরূপ মে মাসের ৩০ তারিখ বদলী হয়ে অসউইতজে (Auschwitz) চলে আসেন। এই অসউইতজই তিনি হয়ে ওঠেন ‘‘অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ’’ বা ‘‘বিউটিফুল ডেভিল’’।
সুনাম অর্জনের ভাবনায় মগ্ন ম্যাঙ্গেলা তখন বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম চোরাবালিতে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বংশগতির গূঢ় সত্য! এদিকে নাৎসিবাদের জাতিগত তত্ত্বের মতবাদ ছিল যে, জার্মানরা শ্রেষ্ঠ জাতি তথা আর্যদের অন্তর্ভুক্ত। এডলফ হিটলারের মতে, এই আর্য জাতির বিশুদ্ধতা থাকতে হবে অটুট, একমাত্র তবেই একদিন তারা সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে। একজন আদর্শ আর্যের বৈশিষ্ট্য হল— সোনালি চুল, নীল চোখ এবং লম্বা উচ্চতা। যদি প্রতিটি আর্য নারী একজোড়া করে সোনালি চুল আর নীল চোখের সন্তান জন্ম দিত তাহলে তা এই নাৎসিতত্ত্বের জন্য কতটাই না ফলপ্রসূ হত!
ড. ম্যাঙ্গেলা ভাবলেন, যমজের মধ্যেই এ রহস্যের সমাধান লুক্কায়িত। তাই তাদের নিয়ে গবেষণা করার জন্য অসউইতজই তার কাছে আদর্শ স্থান মনে হয়েছিল কেন না সেখানে যমজ ছিল অফুরন্ত। আর, প্রশ্ন করার কেউ নেই।
অসউইতজ বন্দিশিবিরে আনা ইহুদিদের দু’ভাগে ভাগ করা হত— দুর্বল ও সবল। দুর্বলদের গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলা হত আর সবলদের দিয়ে করানো হত অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। এই বাছাইয়ের সময়ে উপস্থিত থাকত ম্যাঙ্গেলা ও তার দলবল, যাতে কোনও যমজ কিংবা বিশেষ দৈহিক বৈশিষ্ট্যধারী মানুষ দুর্বলের দলে না পড়ে। যখন হতভাগা মানুষের দল রেলগাড়ি থেকে নামত, শকুনের চোখ দিয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যধারী মানুষ খুঁজে বেড়াত ম্যাঙ্গেলা ও তার এসএস অফিসারের দল। মাঝে মাঝেই তাঁরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠত। “Zwillinge” (যমজ) বলে। পরিবার থেকে চিরতরে আলাদা হয়ে যেত চিহ্নিত করা যমজশিশুরা। জানা যায়, ম্যাঙ্গেলার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ৭৩২ জোড়া জমজশিশু ছিল।
ম্যাঙ্গেলা যমজশিশুর শরীর থেকে কোনও প্রকার এনেসথেশিয়া ছাড়াই অঙ্গ-প্রতঙ্গ বের করে নিতেন। গুইডো ও নিনা নাম্নী প্রায় বছর চারেকের দুই যমজ শিশুকে ম্যাঙ্গেলা একসাথে সেলাই করে জোড়া দিয়ে দেন। সিয়ামিজ যমজ বানাবেন বলে! তাদের শিরাগুলোও একসাথে জোড়া হয়, তাদের ক্ষতস্থানে পুঁজ হয়ে পেকে উঠতে থাকে। দিনরাত গগনভেদী ব্যথার চিৎকার। তাদের মা স্টেলা আর সইতে না পেরে কোনওভাবে কিছু মরফিন জোগাড় করে তাদের চিরতরে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেন।
ম্যাঙ্গেলার গবেষণাগারে দেয়ালে ছিল নীল, বাদামী, সবুজ চোখের সংগ্রহ। যেন প্রজাপতির সংগ্রহশালা। হেটারোক্রোমিয়া বা যাদের দুই চোখের মণি ভিন্ন ভিন্ন রঙের, তাঁদের নিয়ে আগ্রহী ছিলেন তিনি।
এক যমজ ও তার বোনকে ছোট্ট কাঠের খাঁচায় রেখে তাদের পিঠে ব্যাথাময় ইনজেকশন দেওয়া হতো। চোখের রং পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। প্রায় শতাধিক যমজ শিশুদের মুখ ও জননাঙ্গের রোগ ‘নোমা’ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। অধিকাংশই মারা যায়। যমজদের পাশাপাশি বেঁটে, দৈত্যাকার মানুষ ও রোমাদের নিয়েও ম্যাঙ্গেলা গবেষণা করতেন সেখানে।
১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে পূর্বদিক থেকে অগ্রসরমান সোভিয়েত সেনার ভয়ে অসউইতজ খালি হতে থাকে। এসএস সেনারা ব্যারাকগুলোতে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে সকল প্রমাণ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
২৭শে জানুয়ারি ১৯৪৫। সোভিয়েত সেনারা অসউইতজ বন্দীশিবির মুক্ত করে। বেঁচে যাওয়া ৭,৬০০ বন্দীর নধ্যে কয়েকশত শিশু ছিল যারা প্রত্যেকেই ম্যাঙ্গেলা ও তাঁর সহকারী ডাক্তারদের বিকৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে গিনিপিগের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল।
এর আগেই, ১৭ জানুয়ারি, ম্যাঙ্গেলা তাঁর ‘গবেষনার’ দু বাক্স ফাইল নিয়ে একটা গাড়িতে করে পালিয়েছিল। অস্ট্রিয়ার সীমান্তে জর্জ ফিশারের কুড়ি একর গম আর আলুর ফার্মে সপ্তাহে মাত্র ১০ মার্ক মাইনেতে ঢোকেন তিনি। নতুন নাম নেন ফ্রিৎজ্ হলম্যান।
১৯৪৮এর মাঝামাঝি বেশ কিছু এসএস ডাক্তার ও ম্যাঙ্গেলার সহকর্মীদের ফাঁসি হলে, তিনি ফিশারের ফার্ম ছেড়ে পালান। প্রথমে নিজের ছোটবেলার শহর গুঞ্জবার্গে যান। সেখানে তাঁর বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন তাঁকে কখনো তাঁদের বাড়িতে, কখনও কোনও পরিত্যক্ত গুদামঘরে লুকিয়ে রাখতেন। একমাত্র তাঁর স্ত্রী আইরিন তাঁর এই ফিরে আসা পছন্দ করেননি। তাঁকে আর ছেলে রোলফ্কে নিয়ে তিনজনে দক্ষিণ আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তাব দেন ম্যাঙ্গেলা। সে প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।
ম্যাঙ্গেলা একাই দক্ষিণ আমেরিকা যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। হেলমুট গ্রেগর নামে ভুয়ো পাসপোর্ট তৈরি করেন। ইতালির জেনোয়া বন্দর থেকে পাড়ি দেন আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স। একটি ছোট কাঠকল খোলেন, যাতে আসবাবপত্র ছাড়াও বাচ্চাদের খেলনা তৈরি করতেন। তবে শেষ জীবন অবধি তিনি গোপনে দেশে তাঁর পিতার কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী কার্ল ম্যাঙ্গেলা এন্ড সন্স কোম্পানির মুনাফার অংশ পেতেন। এতে তাঁর জীবনযাত্রার মান একরকম রয়ে গেছে। ইয়োসেফের ভাই কার্ল জুনিয়র মারা গেলে তিনি কার্লের স্ত্রী মারথাকে বিয়ে করেন। ১৯৫৬ সালে হানিমুন করতে সুইজারল্যান্ডেও যান!
আর্জেন্টিনায় ফিরে তিনি মারথার জন্য ভালো বাড়ির খোঁজ করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর ছদ্মনামে তিনি ভালো লোন পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ করেই তিনি বুয়েন্স আয়ার্সে পশ্চিম জার্মান এম্বাসিতে গিয়ে নিজের আসল পরিচয় দেন। কিন্তু ভুলবশত কেউ ‘মোস্ট ওয়ান্টেডদের’ লিস্টটার সঙ্গে তাঁর নাম মেলান না। ফলে তিনি ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা নামেই একটি নতুন পশ্চিম জার্মান পাসপোর্ট হাতে পান। তাঁর বুর্জোয়া জীবনযাত্রা আরো উন্নীত হয়। দুজন আর্জেন্টিনীয়র সাথে যৌথ উদ্যোগে একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক ফার্ম তৈরি করেন। ফাড্রো ফার্ম। তবে ভুল ওষুধের ফলে একটি মেয়ের অপমৃত্যু হলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। পাঁচশো ডলার ঘুষ দিয়ে তিনি ছাড়া পান এবং প্যারাগুয়ে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি ১৯৫৯ সালে সেদেশের নাগরিকত্ব পান।
এই সময় ইসরায়েলি গোয়েন্দারা তাঁর গন্ধ পান। তাঁরা আইরিনের কাছে ১৯৫৪ সালে সই করা ডিভোর্সের কাগজ পান যাতে ম্যাঙ্গেলার ঠিকানা ছিল ক্যালে টাকুয়ারি, বুয়েন্স আয়ার্স, আর্জেন্টিনা। জার্মানির ফ্রেইবারগ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু আর্জেন্টিনা প্রত্যর্পণে নিমরাজি ছিল। তাছাড়া ম্যাঙ্গেলা তখন থাকেন প্যারাগুয়েতে। যদিও এর মধ্যে গোপনে বহুবার আর্জেন্টিনায় ব্যবসায়ীক কাজে এসেছিলেন, ফাড্রো ফার্মের অংশীদারিত্ব বিক্রি করতে।
ইসরায়েলের মোসাদ গোয়েন্দারা ততদিন মারথাকে ফলো করতে করতে প্রায় ম্যাঙ্গেলার কাছে পৌঁছে যাচ্ছিলেন যখন মারথা চিরদিনের জন্য অস্ট্রিয়ার গুঞ্জবার্গে ফিরে আসেন।
এরমধ্যে পশ্চিম জার্মানি ২০০০০ ডয়েশমার্ক পুরস্কার ঘোষনা করেন ম্যাঙ্গেলার জন্য। কিন্তু তাঁর টিকিটির দেখা নেই।
১৯৬০-এ পশ্চিম জার্মান এম্বাসির একজন মহিলা কর্মচারী প্যারাগুয়ের একটি রিসোর্টে ছুটি কাটাতে গিয়ে গোড়ালি মচকে ফেলেন। তিনি কয়েকদিন পরে কাজে যোগ দিয়ে তাঁর বসকে জানান যে এক ডঃ ম্যাঙ্গেলা তাঁর পা সারিয়ে দিয়েছেন।
১৯৬২-তে তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল গ্রিক দ্বীপ কাইথনসে। সেই দ্বীপে দুটো মাত্র বড় বিল্ডিং ছিল। একটি হোটেল, আরেকটি মঠ। রাতের আঁধারে গোয়েন্দারা হোটেলে গিয়ে জানতে পারলেন, হোটেলের একমাত্র গেস্ট, একজন জার্মান আর তাঁর স্ত্রী বারো ঘন্টা আগে একটি বিলাসবহুল ইয়াচে করে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছেন। ছবি দেখালে হোটেল ম্যানেজার চিনতে পারে ম্যাঙ্গেলাকে।
১৯৬৩-তে জার্মান চ্যান্সেলর কনরাড এডেনাওয়ার, প্যারাগুয়ের রাষ্ট্রপতি আলফ্রেডো স্ত্রোয়েসনারকে বলেন যে তাঁরা প্যারাগুয়েকে ১০ মিলিয়ন ডয়েশমার্ক অনুদান দেবে যদি ম্যাঙ্গেলাকে প্রত্যর্পণ করা হয়। রাষ্ট্রপতি রাজি হননি। এই সময়কালে ম্যাঙ্গেলা পারানা নদীর তীরে জঙ্গলের মাঝে একটা ছোট বাড়িতে থাকতেন। শুধু দুটো সরু রাস্তা বাড়িটা অবধি যেত। প্যারাগুয়ের পুলিশ ও সেনারা সেই রাস্তা পাহারা দিত। তাঁদের কাছে নির্দেশ ছিল যে কোনো অনুপ্রবেশকারীকে গুলি করার। বাড়ির চারপাশে ম্যাঙ্গেলা চারজন নিজস্ব বডিগার্ড রেখেছিলেন। আধুনিক অস্ত্র আর ওয়াকিটকি সমেত। যদি কেউ সেনা-পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে আসে, নিস্তার পাবে না।
অন্য একটা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬১তেই উলফগ্যাং গারহার্ড নামে একজন প্রাক্তন নাৎসি, ম্যাঙ্গেলাকে ব্রাজিলে যেতে সাহায্য করে। সেখানে, সাও পাওলোর থেকে ৪০ মাইল দূরে একটি ফার্মে তিনি পিটার বা পেড্রো নামে কাজ করতে শুরু করলেন। ফার্মটি এক হাঙেরিয়ান স্ট্যামার দম্পতির। ক্রমে ‘পিটার’ তাঁর বদমেজাজ আর টাকা দিয়ে স্ট্যামার দম্পতিকে ভয়ভীত করে তোলে। তাঁরা ম্যাঙ্গেলার আসল পরিচয় জেনে ফেলেও কাউকে জানাতে ভয় পায়। কফি আর গো-পালনের ফার্মটায় ম্যাঙ্গেলা অনেক টাকা লগ্নি করে। সেখানে তিনি ১৫টি রাস্তার কুকুর নিয়ে চলাফেরা করতেন। কুকুরগুলোকে তিনি খুব হিংস্র করে তুলেছিলেন। তাঁর নির্দেশে সেগুলো মানুষের টুঁটি ছিড়ে ফেলতে পারত।
১৯৬৪-তে আবার তাঁর খবর পাওয়া যায়। রাত ১ টায় গোয়েন্দারা প্যারাগুয়ের হোটেল টায়রলের ২৬ নম্বর স্যুটের দরজা ভাঙ্গে। ঘর খালি। ঘুম জড়ানো চোখে হোটেল মালিক দৌড়ে আসেন। ম্যানেজার এসে জানান যে ‘ডঃ ফ্রিৎজ্ ফিশার’ মিনিট দশেক আগে পায়জামা পড়েই বেরিয়ে গেছেন। আবার পাখি ফুরুৎ।
এরকম ম্যাঙ্গেলা-দর্শনের খবর প্রতি বছর পাওয়া যেত।
১৯৭২-এ ম্যাঙ্গেলার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় থাকাকালীন তিনি একটা মোটা গোঁফ রেখেছিলেন এবং সেই গোঁফের ডগাগুলো চিবানো তাঁর মুদ্রাদোষ হয়ে গেছিল। এটাই তাঁর কাল হয়েছিল। বছরের পর বছর সেই লোম তাঁর অন্ত্রে জমে গিয়েছিল। অস্ত্রপচার জরুরি। সাও পাওলোর একটি হাসপাতালে তিনি উলফগ্যাং গারহার্ড নামে ভর্তি হন।
১৬ মে ১৯৭৬-এ ম্যাঙ্গেলার একটি সেরেব্রাল অ্যাটাক হয়। বাঁ হাত আর বাঁ পা প্যারালাইসিস হয়ে যায়।
১০ অক্টোবর ১৯৭৭-এ ম্যাঙ্গেলার সাথে সাও পাওলোতে দেখা করতে আসে তাঁর ছেলে রোলফ্। দিন পনেরো সে বাবার কাছে ছিল। বামপন্থী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ ছেলে বাবার কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে ঘৃণা পোষণ করত। রোলফ্ তাঁকে বলেছিলেন যে কেন তিনি আত্মসমর্পণ করছেন না। তাঁর উত্তরে ম্যাঙ্গেলা জানান যে পৃথিবীতে কোনো বিচারক নেই, শুধুই প্রতিশোধকারী রয়েছে।
১৯৭৮-এ আবার স্ট্রোক হয় ম্যাঙ্গেলার। ১৯৭৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলে সাঁতার কাটার সময়ে স্ট্রোকের কারণে তার মৃত্যু হয়।
১৯৮৫ সালে ‘উলফগ্যাং গারহার্ড’ নামক এক ব্যক্তির কবর খুঁড়ে যে দেহাবশেষ পাওয়া যায় তার ডিএনএ রিপোর্ট (১৯৯২) প্রমাণ করে যে, এই দেহাবশেষ কুখ্যাত ড. ম্যাঙ্গেলার। সারাজীবন গোয়েন্দাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যান তিনি। তাকে ধরার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ইসরায়েলি এজেন্ট এবং নাৎসি সন্ধানী দলগুলোর সকল প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল।
মানবতাবিরোধী কাজ ও অমানুষিক নির্যাতনের জন্য ড. ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা এক কুখ্যাত নাম। নাৎসিদের নির্মম কাজের ভয়াবহতার রূপকারদের একজন। ম্যাঙ্গেলা মানবজাতির ইতিহাসে কালিমাযুক্ত একটি নাম।
(লেখক একজন আইপিএস অফিসার ও গদ্যকার)
0 Comments