ব্লগ : স্বগতোক্তি/১৪ । আপনি আত্মনির্ভর দেশের বাসিন্দা


আপনি আত্মনির্ভর দেশের বাসিন্দা

তড়িৎ রায়চৌধুরী

অবশেষে বঙ্গের ভোট ভাঙল। গড় ভাঙার পর এখন ঘর-বাড়ি ভাঙার পালা। তাও দল ভাঙার খেলাটা আগে হয়ে গেছে এবার। ছোট-বড় মিলে ভোট পাঁচ বছরে তিন বার তো হয়-ই; তবে এর ব্যাকরণ খুব বদলায় না। “রাজা আসে যায় রাজা বদলায়/ নীল জামা গায় লাল জামা গায়/ জামা কাপড়ের রঙ বদলায়/ দিন বদলায় না”। কি আশ্চর্য! কবি কি জানতেন লালের পর নীল জামা পড়বে প্রশাসক! কবিরা নাকি দূরদ্রষ্টা হন। উন্নয়নের খড়গ-ই কিভাবে বর্গি বিতাড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠবে তাও কি দেখতে পেয়েছিলেন কবি? ইহলোক আজ নিরুত্তর। তবে বহিঃশত্রুর নামে জোটবদ্ধ হবার রীতি তো নতুন না। দেশের ক্ষেত্রে যাকে গৌরবের জাতীয়তাবাদ ভাবি তাই রাজ্যের ক্ষেত্রে জাতিগত অস্মিতা হয়ে ওঠে। জল জঙ্গল অধ্যুষিত দূরবর্তী বঙ্গদেশ কে বশ করা দিল্লীশ্বরদের কাছে চিরকালই কঠিন ছিল।নইলে কি আর বারো ভুঁইয়ার ইতিহাস তৈরি হয়। ঔদ্ধত্যকে গালি দেওয়াই রীতি। বিশেষত দেবী বন্দনা বহুল বাঙালি, পুরুষতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় একটু নরম মাটির ধাত বইকি। হয়তো তাই প্রাচীনকালে বাঙালিকে ‘বয়াংসী’ বা ‘পক্ষীবিশেষ’ বলা হত। রাখালদাসের ভাষায় “ঈষ্যাপরবশ হইয়া তাঁহারা বাঙ্গালীকে ধর্ম্মজ্ঞানশূন্য এবং ভাষাশূন্য পক্ষী বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন”। ভোট বাজারে পাখির ভূমিকা অবশ্য হেলিকপ্টারের। “হেলিকপ্টার, হেলিকপ্টার নেতা আসছেন নেতা আসছেন...” আহা সুমনের গান এতো অব্যর্থ। তো সেই হেলিকপ্টারের ডেলিপ্যাসিঞ্জারির সময় ঠাকুমা আমাকে প্রায়ই বলতেন “হা রে উরা এতোগুলো দামড়া যেচে আসচে তো তেমন দাপুটে মেয়ে একটাও আনচে না ক্যানে? আমাদের দ্রৌপদী (রূপা গাঙ্গুলী) টো কেও সেই নিয়ে গেল আর ফিরলে না বাপু”। এই মেয়েলি সেন্টিমেন্টটা বুঝেই কি কুশলবাবু ট্যাগ লাইনে ‘নিজের মেয়ে’ শব্দ বন্ধ জুড়েছিলেন? 

আসলে পৃথিবী কিছু শক্তিশালী হাতেই পরিচালিত হয়। শুধু বাইরে তাদের আবেগের বেসাতি করতে হয়। ভেক না ধরলে ভিক মেলে না গো। আফ্রিকার কোর্ট টাই খুলে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে ধুতির সঙ্গে গিলে করা পাঞ্জাবি পরেছিলেন গান্ধীজি। পরের পোশাক তো আইকনিক। সেই শিক্ষাই কি আম আদমীর মাফলার বা হাওয়াই চটির পিছনে রয়ে যায়নি? আসলে জনমোহিনী রাজনীতির সবটুকু খাঁটি হয় না। খাঁটি সোনায় গয়না হয় না,তাতে খাদ মেশাতে হয়। যে দেবতা যাতে তুষ্ট হন। জনতা যেখানে জনার্দন। বিজ্ঞতা তো আর বিন পরিশ্রমে পালে পালে জন্মায় না। অজ্ঞতাই স্বাভাবিক। সে সস্তা রাস্তাতেই খুশি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হয় বিবেচনায় কিন্তু তার সম্পাদনে লাগে বাহুল্য। ভোটের রাজনীতি আর তত্ত্বের শুদ্ধতা এক নয়। খোদ রবিঠাকুর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। আসলে “কইলকাত্তায়(ফেসবুকে) গিয়া দেখি সক্কলেই সব জানে/ আমিই কিছু জানি না/... পথে ঘাটে সবাই দুষ্ট বটে/ নিজে তো কেউ দুষ্ট না”। গণনা পর্যন্ত ‘আমরাই জিতছি’; তারপর ‘বাংলার মানুষ ভুল করেছে’। যারা ভোট রাজনীতিই করি এই সম্ভাবনা কে বুঝতে না পারা তাদের প্রাথমিক ভুল নয়? সামান্য ইউনিয়ন ইলেকশনে ভোটের রাতে নেতা ডেকে নিয়ে গেছে কাল আমরা হেরে যাবো, চল মূল্যবান জিনিস সরাতে হবে। হেরে যাওয়াটা কে মেনে নিলেই হয় না মনে নিতে হয়। আমাদের ছোটবেলা এখন সত্যিই ইতিহাস। জনসংযোগহীনতার খেসারত দিতে দিতে বিধানসভা আজ বাম-কং শূন্য। চমক গমক ধমক-এর মতো সংগঠনও জনগণ কে প্রভাবিত করার বড় পথ। ঐ যে সক্কলেই সব জানে।

ভোট আবার আসবে, করোনার মতোই নিজেদের মিউটেট করে আরো শক্তিশালী হয়েই ফিরবে। যদি জয়ের আনন্দেই মেতে থাকি সেকেন্ড ওয়েভ কে সামলাতে পারব তো? মাঠ ময়দান তো সমুদ্রের মতো। সেখানে তরঙ্গ অনন্ত। “এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ/ তবে কেন শরীর দিয়েছ শুধু/ বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে!”

করোনা হোক বা পলিটিক্স নিজেদের বাঁচার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। আফটার অল, আপনি আত্মনির্ভর ভারতবর্ষের বাসিন্দা।


(লেখক পাঠভবন, বিশ্বভারতীর শিক্ষক)

Post a Comment

0 Comments